রৌদ্রের অক্ষরে লেখা অনন্য স্লোগান

১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর গণতন্ত্রের সংগ্রামে জীবন দিয়েছিল অমিত সাহসী যুবক নূর হোসেন, যার বুকে পিঠে লেখা ছিল ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’।

শফী আহমেদশফী আহমেদ
Published : 10 Nov 2022, 09:18 AM
Updated : 10 Nov 2022, 09:18 AM

নূর হোসেন দিবস আজ। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর গণতন্ত্রের সংগ্রামে জীবন দিয়েছিল অমিত সাহসী যুবক নূর হোসেন, যার বুকে পিঠে লেখা ছিল ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’।

নূর হোসেনের মতো শত শহীদের রক্তের পথ বেয়ে গণতন্ত্র মুক্তি পেয়েছিল। কিন্তু গণতন্ত্রের প্রকৃত সুফল বাংলাদেশের জনগণ ভোগ করতে পারেনি। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বারবার বাধা পেয়েছে। মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো রয়ে গেছে উপেক্ষিত। গণতন্ত্রের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ রাজনৈতিক সংস্কৃতি, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসূমহ যথাযথভাবে বিকশিত না হওয়ায় আমরা এখনও রয়ে গেছি অসম্পূর্ণ গণতন্ত্রের সংগ্রামে।

১৯৮৭ সাল, ১০ নভেম্বর। বাঙালি জাতি নিষ্পেষিত হচ্ছে সামরিক শাসনের জাঁতাকলে। ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে সামরিক শাসনের যাত্রা শুরু হয়। অনেক নারকীয় ঘটনা-দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ ক্ষমতা দখল করেন সামরিক জান্তা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ১৫ অগাস্টের বিয়োগান্তক ঘটনার পর থেকেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী, গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তিসমূহ সামরিক শাসন অবসানের লক্ষ্যে আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করছিল। কিন্তু জগদ্দল পাথর এত সহজে সরানো যায় না।

মিছিলের অগ্রভাগে ছিল নূর হোসেন। খণ্ড মিছিলে অংশগ্রহণকারী যুবকদের উদোম গায়ে লেখা ছিল স্বৈরাচারবিরোধী স্লোগান।

জেনারেল জিয়াউর রহমান খুন হয়ে যাওয়ার পর রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে চেপে বসা জগদ্দল পাথরের নব্য সংস্করণ ও ধারাবাহিকতা এরশাদের সামরিক শাসন। ১৯৮২ এর ২৪ মার্চ থেকেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ছাত্র সংগঠনগুলো ও ১০ দলীয় ঐক্যজোট প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করে। সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন ১৯৮৩-এর মধ্য ফেব্রুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে এক কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলে। শহীদ হন জাফর, জয়নাল, মোজাম্মেল কাঞ্চন, দীপালি সাহাসহ হাজারও সাথী, যাদের লাশ গুম করে ফেলে স্বৈরশাসক। আন্দোলনের নবতর যাত্রায় নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে ছাত্রসমাজ ও জনগণ ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে। রাজনৈতিক দলগুলো আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৫ দলীয় ঐক্যজোট গঠন করে।

পাশাপাশি খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ক্ষমতাচ্যুত বিএনপি ৭ দলীয় ঐক্যজোট গঠন করে। কিন্তু আন্দোলনের যাত্রাপথে ১৯৮৬-এর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ১৫ দলীয় ঐক্যজোটের মধ্যে ভাঙনের সৃষ্টি হয়। ৮ দল, ৫ দল ও ৭ দল এই তিনটি জোটের আবির্ভাব ঘটে। সবার লক্ষ্যই এক ও অভিন্ন। সামরিক শাসনের অবসান ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া।

সেদিন ছিল ৮ দল, ৫ দল ও ৭ দলের নৌপথ, রেলপথ ও রাজপথ অবরোধের কর্মসূচি। কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে সচিবালয়ের সামনে অবস্থান ধর্মঘট কর্মসূচি। কার্তিকের কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে দলে দলে জনতা সমবেত হতে থাকে নিজ নিজ জোটের ব্যানারে। এর মধ্যে ৮ দলীয় জোটের অবস্থান ছিল বর্তমান নূর হোসেন স্কয়ারে। ৫ দলীয় জোটের অবস্থান ছিল হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশনের সামনে ও ৭ দলের অবস্থান ছিল দৈনিক বাংলা মোড়ে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ৮ দলীয় জোটের অবস্থানে মিলিত হলো একদল সাহসী যুবকের খণ্ড মিছিল।

ওই মিছিলটি গুলিস্তান থেকে তোপখানা মোড় পর্যন্ত বারবার প্রদক্ষিণ করছিল এবং আন্দোলনকামী জনতাকে অনুপ্রাণিত করছিল। মিছিলের অগ্রভাগে ছিল নূর হোসেন। খণ্ড মিছিলে অংশগ্রহণকারী যুবকদের উদোম গায়ে লেখা ছিল স্বৈরাচারবিরোধী স্লোগান। আমরা যারা ৫ দলের ছাত্রকর্মী ছিলাম, তারাও হাউজ বিল্ডিং থেকে জিরো পয়েন্ট আবার কখনও দৈনিক বাংলা পর্যন্ত সমবেত আন্দোলনকারীদের স্লোগানে প্রকম্পিত করে উদ্দীপ্ত করার চেষ্টা করছিলাম। ততক্ষণে জননেত্রী শেখ হাসিনাও আন্দোলনস্থলে উপস্থিত হয়েছেন।

সেদিন নূর হোসেনের জীবনদান ছিল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের এক মাইলফলক, ভিসুভিয়াসের আগ্নেয়গিরির এক জ্বলন্ত লেলিহান শিখা

স্বৈরাচারী এরশাদের পুলিশ বাহিনী প্রথমে টার্গেট করে গুলি করে নূর হোসেনকে হত্যা করে, পরবর্তী সময়ে শুরু হয় জননেত্রী শেখ হাসিনা যে অস্থায়ী মঞ্চে ছিলেন সেই মঞ্চকে টার্গেট করে গুলিবর্ষণ। সৌভাগ্যক্রমে সেদিন জননেত্রী শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। ৫ দল ও ৭ দলের অবস্থানের ওপরও পুলিশ জলকামান ও টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করে সমবেত জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। কিন্তু জনতার রুদ্ররোষ ঠেকানোর ক্ষমতা স্বৈরাচারের ছিল না।

সেদিন নূর হোসেনের জীবনদান ছিল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের এক মাইলফলক, ভিসুভিয়াসের আগ্নেয়গিরির এক জ্বলন্ত লেলিহান শিখা, সেদিন নূর হোসেন হয়ে উঠেছিল সমগ্র বাঙালির বাংলাদেশ। ক্ষুদিরাম, মাস্টারদা সূর্যসেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার প্রমুখ শহীদ যে পথ দেখিয়ে গেছেন সেই পথেই নূর হোসেন যুক্ত হলেন আরেক স্বাধীনচেতা আত্মোৎসর্গকারী যুবক হিসেবে।

কবি শামসুর রাহমান লিখেছেন ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’, সবার অলক্ষ্যে নূর হোসেনের প্রশস্ত ললাটে আঁকা হয়ে যায়, যেন সে নির্ভীক যোদ্ধা, যাচ্ছে রণাঙ্গনে। উদোম শরীরে নেমে আসে রাজপথে, বুকে-পিঠে রৌদ্রের অক্ষরে লেখা অনন্য স্লোগান, বীরের মুদ্রায় হাঁটে মিছিলের পুরোভাগে এবং হঠাৎ শহরে টহলদার ঝাঁক ঝাঁক বন্দুকের সীসা। নূর হোসেনের বুক নয়, যেন বাংলাদেশের হৃদয় ফুটো করে দেয়; বাংলাদেশ বনপোড়া হরিণীর মতো আর্তনাদ করে, তার বুক থেকে অবিরল রক্ত ঝরতে থাকে, ঝরতে থাকে।