তার কবিতার একটি বৈশিষ্ট্য হলো বিনোদন, আছে সুখী শুরু ও সমাপ্তি।
Published : 17 Jan 2024, 03:37 PM
টাপুর টুপুর মেঘের দুপুর/ ভেজা গাছপালা, বন/ আকাশ তাহার মেঘের পাহাড়/ সাজায় সারাক্ষণ। (টাপুর টুপুর মেঘের দুপুর/ মহাদেব সাহা)
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি মহাদেব সাহা। তিনি ১৯৪৪ সালের ৫ অগাস্ট সিরাজগঞ্জ জেলার রায়গঞ্জ উপজেলার ধানগড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। কবি প্রায় শতাধিক বই লিখেছেন।
চার দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলা কবিতাকে সমৃদ্ধ করে চলেছেন তিনি। তার কবিতা হৃদয়স্পর্শী; নান্দনিক উপাদানে ভরপুর। বড়দের পাশাপাশি তিনি শিশু-কিশোরদের জন্যও সৃষ্টি করেছেন বেশকিছু কবিতা। তার উল্লেখযোগ্য কিশোর-কবিতার বই হচ্ছে: টাপুর টুপুর মেঘের দুপুর, ছবি আঁকা পাখির পাখা, আকাশে-ওড়া মাটির ঘোড়া, সরষে ফুলের নদী, গোলাপ ফোটার গন্ধ প্রভৃতি।
প্রকৃতির বিভিন্ন দৃশ্য এমনকি মেঘ, বৃষ্টি, আকাশ, বাতাস ও সূর্য ইত্যাদির সঙ্গে নিত্য জীবন নিয়ে মনোরম সব কবিতা নির্মাণ করেছেন মহাদেব সাহা। তার কিশোর-কবিতাগুলো যেন আনন্দলোকের নাগরদোলা। যে নাগরদোলায় চড়ে কিশোররা দৃশ্য দেখে, বিশ্ব দেখে। হৃদয়কে করে তোলে পুলকিত। সঙ্গে নিজের চেনা ও অচেনা পরিবেশের সঙ্গে পরিচিত হয়।
প্রায় সব ঋতু নিয়েই একাধিক কবিতা আছে তার। আমার আকাশ আমার নদী, জোনাকি, মেঘ ভেসে যায়, ভোরবেলা, এত যে এই খোলা বাতাস, শরতের কবিতা, বৈশাখ, পাখিদের সব কাণ্ড দেখেছ, মধুমাসের এই দেশে প্রভৃতি শিরোনামের কবিতাগুলো শৈশবে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। আনন্দলোকে নিয়ে যাবে, নাগরদোলায় ঘুরতে ঘুরতে সবকিছু দেখাবে, মনে করাবে।
শিল্পী সব্যসাচী হাজরার প্রচ্ছদে ২০১৬ সালে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয় কবি মহাদেব সাহার ‘কিশোর কবিতাসমগ্র’। এর কবিতাগুলো কিশোরদের সবসময়ের সঙ্গী হতে পারে। এখানে ফুলপাখিদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ, মা ও মাতৃভাষা নিয়ে লেখা কবিতাগুলো যেন স্নেহের পরশ বোলায়। মুজিব ফিরে আসে, এই ইতিহাস এই কবিতা, কোথায় মুজিব নাই, কলম্বাসের জাহাজের মতো কবিতাগুলো ইতিহাসের শিক্ষা দেবে। যেমন-
শোনো, একদিন এই দেশটাতে / মুক্তিযুদ্ধ হয়/ আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির/ ঘোচাতে দুঃখ-ভয়;/ এই দুটি হাত/ স্বাধীন-অবাধ,/ হয়ে উঠে দুর্জয়/ হে কিশোর, শোনো,/ আমরা সেদিন যুদ্ধ করেছি জয়। (হে কিশোর শোনো)
এ বইয়ে কবির বিভিন্ন বাছাইকবিতার সঙ্গে অগ্রন্থিত কিছু কবিতাও আছে। বইটি পড়লে মহাদেব সাহার কিশোর-কবিতার সমৃদ্ধি অনুধাবন করা সম্ভব। মনে পড়বে পালিয়ে পাখির পিছে ছুটে যাওয়া, ফল-ফুলের গন্ধে মাতাল হওয়ার স্মৃতি।
মহাদেব সাহার কিশোর-কবিতার একটি বৈশিষ্ট্য হলো তা অনায়াসে উচ্চস্বরে আবৃত্তি করা যায়। কবিতাগুলোর শৈলী, স্বর, বিষয়বস্তু ও আখ্যান চিত্রের মতো পাঠক ও শ্রোতাকে আকৃষ্ট করে। সহজ বাংলায় লেখা কবিতাগুলো যে কোন বয়স ও সামর্থ্যের পাঠক সহজেই মুখস্থ করতে পারবে এবং মনে রাখতে পারবে। কিছু কিছু কবিতা এতো সুরেলা যে গান হিসেবেও গাওয়া যেতে পারে। যেমন-
ওই এলো বৈশাখ,/ খর রোদ্দুর/ হঠাৎ আকাশ মেঘে/ টইটম্বুর;/ নামবে বৃষ্টি আর/ উঠবে কি ঝড়,/ থেকে থেকে মেঘ ডাকে/ কাঁপে অন্তর। (টইটম্বুর)
শিক্ষামূলক উদ্দেশ্য ছাড়াও তার কিশোর-কবিতার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো বিনোদন, প্রতিটি কবিতার মধ্যে আছে সুখী শুরু ও সমাপ্তি। কবিতার চরিত্র, কার্যকলাপ ও বিন্যাস কিশোরদের আনন্দ দেয়। কিশোর চরিত্রে নৈতিকতা গড়তেও ভূমিকা রাখে। কিশোরদের উপযোগী ভাষা, শব্দ, ছন্দ ও চিত্রকল্প নির্মাণে মহাদেব সাহার দক্ষতা অসাধারণ। তিনি যেন মমতা মেখে সাজিয়ে তোলেন একেকটি কবিতা। তার শব্দ-চয়ন ও সৃষ্ট আবহ কিশোর-মনে সুখ অনুভব করাতে সক্ষম। যেমন-
দেখি আমি দুই চোখ মেলে/ শাদা শাদা মেঘগুলি/ আকাশ বেড়ায় হেসেখেলে;/ কে যেন রে ডাক দেয় দূরে,/ মেঘ আসে পৃথিবীটা ঘুরে।(মেঘগুলি)
কাঁঠালচাঁপার গন্ধে, সরষে ফুলের নদী, ছবি আঁকা পাখির পাখা, আকাশে ওড়া মাটির ঘোড়া, আমার আকাশ আমার নদী, ফুলের গন্ধে পাখির ছন্দে, আকাশে সোনার থালা, কণ্ঠে নিস পাখির শিস, মধুমাসের এই দেশে, কাজলাদিদির জন্য, গোলাপ ফোটার গন্ধে, গল্প শোনায় নদী, কলম্বাসের জাহাজ, দুচোখ ভরা সন্ধ্যাতারা শিরোনামের কবিতাগুলো কৈশোর মনে করিয়ে দেয়। মনে হয়- আহা, হারিয়ে গেল সোনালি দিনগুলো!
মহাদেব সাহার কিশোর-কবিতায় সেই আহ্বান পাই আমরা। বলে ওঠি- এই আকাশের কাছে/ মেঘ কোথা থাকে তার/ ঠিকানাটা জানবার আছে।(মেঘগুলি)।