একদিন ছোট্ট পশুরা ভালুক আর খরগোশের কাছে গেল। বলল, আমরা একটি সমস্যায় আছি। সিংহ প্রতিদিন আমাদের ভয় দেখাচ্ছে।
Published : 15 Jan 2024, 11:32 AM
এক বনে এক সিংহ ছিল। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে সে চারদিকে হাঁটত। আর গর্জন করত। ভয়ানক হিংস্র ছিল সে গর্জন। গর্জন করতে করতে বলত, ‘আমি এবং আমিই একমাত্র এ বনের রাজা। আমি এবং আমিই একমাত্র এ বনের রাজা।’
সে বনে আরও অনেক ছোট-বড় পশু ছিল। ওরা কেবল ভয় পেতো। ভয়ে সূর্য উঠার সঙ্গে সঙ্গে বাইরে চলে যেত। কেউবা শিকারে যেত। কেউবা মাছ ধরতে যেত। অথবা যে যা পারে করত। ওরা ভয়ে ভয়ে এসব কাজ করত। তারা একে অপরের কাছে জানতে চাইত, ‘আমরা এখন কী করতে পারি?’ কাঠবিড়ালি ভয়ে গাছের এক শাখা থেকে আরেক শাখায় ছোটাছুটি করত। ওর পশমগুলো ভয়ে খাড়া হয়ে থাকত। নড়ত না।
সিংহ শুধু এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াত। আর বুক ফুলিয়ে গর্জন করত, ‘আমি এবং আমিই একমাত্র এ বনের রাজা। আমি এবং আমিই একমাত্র এ বনের রাজা।’ অন্য পশুরা কথা বলাবলি শুরু করল। একজন একজন করে। দু’জন দু’জন করে। সবাই মিলে। সবাই মিলে আলোচনা করে ঠিক করল- ওরা ভালুক আর খরগোশের কাছে যাবে। তারা জানত, ওরা কাছাকাছি কোথাও আছে।
একদিন ছোট্ট পশুরা ভালুক আর খরগোশের কাছে গেল। বলল, আমরা একটি সমস্যায় আছি। সিংহ প্রতিদিন আমাদের ভয় দেখাচ্ছে। প্রতিদিন সকালে হেঁটে হেঁটে গর্জন করে। আর বলে, ‘আমি এবং আমিই একমাত্র এ বনের রাজা। আমি এবং আমিই একমাত্র এ বনের রাজা।’ ভালুক তখন জানতে চাইল, ‘কেন সে এমন করে?’ ‘এর মাধ্যমে কি সে কিছু বলতে চাইছে?’ খরগোশ জানতে চাইল। ‘আমরা জানি না কেন সে এমন করে। তবে মনে হয়, সে কিছু একটা ইঙ্গিত করছে’, অন্য পশুরা জবাব দিল।
ওরা আরও বলল, ‘আমাদের শিশুরা এতে ভয় পাচ্ছে। তাকে এ থেকে বিরত রাখা উচিত।’ ভালুক বলল, ‘ঠিক আছে, আমি ওর কাছে যাব এবং কথা বলব। আমি দীর্ঘদিন ধরে ওকে জানি।’ ‘আমিও তোমার সঙ্গে যাব’, খরগোশ বলল। সে আরও বলল, ‘তোমার মতো আমিও দীর্ঘদিন ধরে ওকে জানি।’ ভালুক আর খরগোশ দু’জনে বনের ভিতর দিয়ে এগোতে থাকে। এমন সময় তারা কিছু একটার আওয়াজ শুনতে পেল। ঘর্ঘর আওয়াজ শুনছিল। কোনো কিছু বোঝা যাচ্ছিল না। তারা আরও একটু বনের ভেতর ঢুকল। তখন শুনতে পেল সিংহের সে গর্জন, ‘আমি এবং আমিই একমাত্র এ বনের রাজা। আমি এবং আমিই একমাত্র এ বনের রাজা।’
‘ঠিক আছে। ঠিক আছে। আমি বুঝতে পেরেছি। সে ভীত না। সে বনের মধ্যে ঘুরছে। আর নানান কিছু দেখছে’, ভালুক বলল। ‘আমি, আমি, আমি', বলে খরগোশ মূলত সিংহকে ভয় না পাওয়ার জন্য চেষ্টা করছিল। তারপর সে বলল, ‘এখন সিংহ অনেক হিংস্র হতে পারে। তোমাকে জানতে হবে কী করে তাকে থামানো যায়।’ ভালুক আর খরগোশ দাবি করল, ‘এই পাহাড়ের উপরেই এখন কোথাও এক জায়গায় আছে সিংহ।’ অবশেষে তারা পেয়েও যায়। তারা একটু দূরে দাঁড়িয়ে যায়। সিংহ তাদের দেখছে। তারাও সিংহকে দেখছে। একসময় তাদের মনে হলো সিংহের মন-মেজাজ আজ ভালো।
মানুষ দেখার জন্য সিংহকে নিয়ে ভালুক আর খরগোশ নিচের দিকে যাত্রা শুরু করল। তারা একসঙ্গে বনের বাইরের দিকে গেল। খুব শীঘ্রই তারা একটা খালি জায়গায় চলে এলো।
তখন ওরা দুজন বলল, ‘শুনছি, আপনি নাকি সবাইকে ভয় দেখাচ্ছেন। শিশুরা ভয় পায় আপনার গর্জনে।’ ‘আমি গর্জন করি যখন আমি খুশি থাকি’, সিংহ জবাব দিল। ‘সকালের এই গর্জন কি না করলে নয়? তাহলে ছোট ছোট পশুরা তাদের সুবিধামতো খাওয়া-দাওয়া করতে পারত’, ভালুক বলল। সিংহ বলল, ‘শোন।’ বলেই সে আবার গর্জন শুরু করল, ‘আমি এবং আমিই একমাত্র এ বনের রাজা। কেউ আমাকে বলতে পারবে না, আমি কখন কী করব আর কী করব না।’
খরগোশ বলল, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমাকে কিছু বলতে দিলে ভালো হয়। আমি একজন মানুষকে দেখেছি। সেই হলো সত্যিকার অর্থে বনের রাজা।’ খরগোশের কথা শুনে সিংহ নীরব হয়ে গেল। তারপর সে ছোট্ট খরগোশের দিকে এমনভাবে তাকাল যেন সে কিছুই শুনেনি, কিছুই বুঝেনি। সে ভালুকের দিকে তাকাল। ওর সঙ্গে বুঝি কথা বলা যায়। সিংহ বলল, ‘ভালুক, তখন তুমি কি কাছাকাছি ছিলে?’ ভালুক বলল, ‘এটা সত্যি। আমি সব জায়গায় যাই। আমি পুরো বনে ঘুরি।’ সিংহ বলল, ‘তাহলে তুমি অবশ্যই কিছু জানবে।’ ভালুক বলল, ‘আমি অনেক কিছু জানি। ধীরে সখা ধীরে। তুমি আগে মন ভালো কর।’ সিংহ বলল, ‘লোকটির ব্যাপারে তুমি কী জান আমাকে বল। সে কি নিজেকে বনের রাজা মনে করে?’ ভালুক বলল, ‘ঠিক আছে, আমি তোমাকে বলব। আমি কাছাকাছি ছিলাম। আমি যে মানুষকে জানি, সে মানুষের সাথে আমার কখনও দেখা হয়নি। কথাও হয়নি।’
সিংহ আবার খরগোশের দিকে তাকাল। যদিও সে তা করতে চায়নি। কিন্তু করতে হলো। খরগোশের দিকে তাকিয়ে সিংহ বলল, ‘তাতে কী?’ খরগোশ বলল, ‘তুমি মানুষটিকে দেখতে চাইলে তোমাকে নিচে যেতে হবে। আমি তোমাকে দেখাব।’ সিংহ একদিন ভাবল। পরেরদিন সে রাজি হলো। আবার একবার সে গর্জন করল, ‘আমি এবং আমিই একমাত্র এ বনের রাজা। এখন আমাকে সে মানুষকে দেখাও।’
মানুষ দেখার জন্য সিংহকে নিয়ে ভালুক আর খরগোশ নিচের দিকে যাত্রা শুরু করল। তারা একসঙ্গে বনের বাইরের দিকে গেল। খুব শীঘ্রই তারা একটা খালি জায়গায় চলে এলো। ওখানে ছোট্ট একটা শিশু খেলা করছে, যার বয়স নয় বছর হতে পারে। সিংহ প্রশ্ন করল, ‘এই মানুষ?’ খরগোশ বলল, ‘কেন নয়? হতেও পারে। তবে এটা ঠিক সে মানুষ নয়।’ ওখান থেকে ওরা চলে গেল। তারা একটা গাছের আড়ালে গেল। এর নিচে নানা বয়সী মানুষ বিশ্রাম করছে। কারো কারো বয়স ৯০ বছরের বেশিও হবে। সিংহ বলল, ‘না, এরাও সে মানুষ না। আমি জানি, সে বেশি দূর যায়নি। কাছাকাছি কোথাও আছে।’ খরগোশ বলল, ‘এরা সে মানুষ নয়। ওটা তুমি জানবে, যখন তুমি ওই মানুষকে দেখবে।’
তারপর তারা আরও এগিয়ে গেল। সিংহ হাঁটতে হাঁটতে আর পারছিল না। তাই আবার সে গর্জন করল, ‘আমি এবং আমিই একমাত্র এ বনের রাজা। আমি এবং আমিই একমাত্র এ বনের রাজা।’ ভালুক ভয়ে, হতাশায় হঠাৎ দৌড়ে একটা গাছে উঠে বসল। খরগোশ ওকে বলল, ‘তুমি নেমে আস।’ কিছু সময় পর ভালুক গাছ থেকে নেমে আসল। তারপরও সিংহ থেকে দূরে। তারা তাদের যাত্রা আবার শুরু করল। তারা নীরবে এবং ধীরে ধীরে এগোতে থাকল।
মানুষটি আরও কাছে আসল। বুড়ো সিংহটিকে ভালো করে দেখল। তারপর সে হাঁটু গেড়ে বসে ঘাড়ের বন্দুকটি ওর দিকে তাক করল।
কিছুদূর যাওয়ার পর তারা সড়কে চলে আসল। এবার তারা মানুষের পথ ধরে চলতে থাকল। যেতে যেতে খরগোশ দেখল, একজন মানুষ আসছে। মানুষটির বয়স কুড়ি বছরের মতো হবে। খুব সামর্থ্যবান পুরুষ। তার কাঁধে একটা বন্দুক আছে। খরগোশ বলল, ‘ওই যে! সিংহ মহাশয় ওদিকে দেখ। ওই যে মানুষ। তুমি বরং ওর সাথে কথা বলল।’ সিংহ বলল, ‘আমি বলব। অবশ্যই আমি বলব।’ তারপর সে তার বুক চাপড়াল। গর্জনও করল, ‘আমি এবং আমিই একমাত্র এ বনের রাজা। আমি এবং আমিই একমাত্র এ বনের রাজা।’
মানুষের সব পথ জুড়ে গর্বিত সিংহের সে গর্জন ছড়িয়ে পড়ল, ‘আমি এবং আমি নিজে। আমি এবং আমি নিজে।’ খরগোশ বলল, ‘ভালুক ভাই তাড়াতাড়ি আস। চল পালাই।’ ভালুক জানতে চাইল, ‘কেন?’ খরগোশ বলল, ‘ভালো চাও তো তাড়াতাড়ি আস।’ তারপর সে ভালুককে ঝাপটে ধরে ঝোপের আড়ালে নিয়ে যায়। সেখানে খরগোশ তার সাথে ভালুককেও আড়াল করল।
মানুষটি আরও কাছে আসল। বুড়ো সিংহটিকে ভালো করে দেখল। তারপর সে হাঁটু গেড়ে বসে ঘাড়ের বন্দুকটি ওর দিকে তাক করল। সিংহ মাথা নেড়ে গর্জন করল, ‘আমি এবং আমিই একমাত্র এ বনের রাজা। আমি এবং আমিই একমাত্র এ বনের রাজা।’ মানুষের বন্দুক তখনই গর্জে ওঠল, পা...লু...উ..ম। পুরুষ সিংহ একটু পিছিয়ে এলো। তার লেজ শক্ত হয়ে উঠলো। মানুষটির বন্দুক আবার গর্জে ওঠল, পা...লু...উ...ম।
এবার সিংহ শূন্যে লাফ দিয়ে ঝোপের মধ্যে গিয়ে পড়ল। ভালুক বলল, ‘তুমি মানুষ দেখলে?’ সিংহ বলল, ‘হ্যাঁ, আমি তাকে দেখলাম।মানুষটি আমার সঙ্গে অভদ্রের মতো কথা বলল। তার কাঁধে কিছু একটা আমাকে বড় ধমক দিচ্ছিল। তার লাঠি থেকে আলো বের হয়। এটা খুবই খারাপ। এতে আমার শরীর খারাপ হয়। আমাকে লাফ দিতে হলো।
লোকটি আবার সে লাঠিটি আমার দিকে তাক করে খুব জোরে আওয়াজ করল। তারপর আমি এখানে চলে আসলাম। কারণ মনে হচ্ছে, প্রতিবার গর্জনের সময় সে আমার দিকে কিছু একটা ছুড়ে মারছে। খরগোশ বলল, ‘তাহলে তুমি মানুষের দেখা পেয়েছ? তুমি সঠিকভাবে জানলে মানুষ কেমন!’ সিংহ বলল, ‘আমি বুঝেছি মানুষ কেমন। মানুষ খুব খারাপ।’
মানুষটির সঙ্গে দেখা হওয়ার কিছুসময় পর সিংহের মনে হলো, বন ওর জন্য অনেক ভালো ছিল। ভালুক আর খরগোশ আগেই জানত মানুষ কেমন। তাই ওরা মানুষের কাছ থেকে দূরে থাকতে চেয়েছে। তারপর থেকে বনের ছোট ছোট পশুদের আর ভীত হয়ে থাকতে হয় না। সিংহ একেবারে নীরব হয়ে গেলো। সে আর আগের মতো গর্জন করে ঘুরে বেড়ায় না। এখন সে যা বলে তা অনেকটা এরকম, ‘আমি এবং মানুষ এ বনের রাজা। আমি এবং মানুষ একমাত্র এ বনের রাজা।’ সিংহের এই গর্জনে আগের মতো আর হিংস্রতা নেই।