পায়ের ছাপটা বিশাল বড়। সচরাচর এত বড় জন্তু দেখা যায় না। সবাই মনোযোগ দিয়ে পায়ের ছাপ দেখল।
Published : 18 Jun 2023, 03:07 PM
আরো আধা ঘণ্টা ঠায় সেদিকে তাকিয়ে থাকার পর কুয়াশা কিছুটা কাটল। দেখা গেল সূর্যকে। আকাশে উঠে বসে আছে। সাগরের ভেতর থেকে ওঠেনি। উঠেছে আকাশ থেকেই।
ভুটো বলল, আমার মনে হয় এরকম কিছু হয় সেটা টুটুল ভাই জানত। সেজন্য নিজেও ওঠেনি। কাউকে ডাকেনি। আমরা বোকামি করে..
কিসুল রেগে উঠল, তোর টুটুল ভাই সব জানে। জানে কখন কুয়াশা হবে। আর এই শত শত লোক কিছুই জানে না, হাবা কোথাকার!
ঝন্টু ওদের ঝগড়া থামিয়ে বলল, চল মূল বিচে যাই। ওখানে কিছু নাস্তা করে কোনো দিকে বেড়াতে বের হলে কেমন হয়!
পলাশ হাতে কিল দিয়ে বলল, সবচেয়ে ভাল হয় একটা বোট ভাড়া করে কোন দ্বীপের দিকে গেলে। কাল দেখলি না লোকজন সব ট্রলারে উঠে ফাতরা না মাতরার দ্বীপ না কোনদিকে গেল। আমরা চারজনই তো সাঁতার জানি ভয় কি...
ভয়ের প্রসঙ্গ এলে কিশোররা কখনও পিছপা হয় না। মুহূর্তেই চারজন রাজি হয়ে গেল। উত্তেজনায় সকালের খিদেও চলে গেছে যেন। নাস্তাটাও ভালো মতো করতে পারল না।
ঘাটে এসে খুঁজতেই মনের মতো একটা ইঞ্জিনচালিত বোট পেয়ে গেল ওরা। উপরে ছাউনি নেই। চাদর গায়ে বছর তের চৌদ্দের এক ছেলে বসে আছে বোটের মুড়োয়। ঝন্টুই এগিয়ে গেল নেগোসিয়েশনের জন্য। এই মাঝি ফাতরার দ্বীপে যাবি?
না।
না কেন? নৌকা নিয়ে বসে আছিস যাবি না কেন?
নৌকা আমার না। বাবার। বাবায় দুপুরে নৌকায় করে শুটকি আনতে যাবে।
আরে দুপুর পর্যন্ত লাগবে না তো। তার মধ্যে আমাদের ফিরিয়ে এনে দিবি। চারজনে পঞ্চাশ করে দুইশ টাকা দেবো। টাকাটা তোর থাকবে। তোর বাবা জানবে না। ভেবে দেখ।
দুপুরের মধ্যে ফিরে আসবেন তো?
অবশ্যই। নৌকা তো তোর হাতে। তুই ফিরিয়ে নিয়ে আসবি।
ঠিক আছে তাহলে ওঠেন। দুপুরে বাবা ঘাটে নৌকা না দেখলে পিটিয়ে আমার পিঠের চামড়া তুলে ফেলবে।
গান বন্ধ করে মাঝি শুকনো মুখে বলল, মনে হয় আমরা সাগরে পথ হারিয়ে ফেলেছি! তার মানে? চারজনে একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল।
ওরা চারজন নৌকায় উঠতে উঠতে বলল, তোর পিঠের চামড়া পিঠে রাখার দায়িত্ব আমাদের। ফাতরার দ্বীপ চিনিস তো? বোট সেই দ্বীপে নে। যত তাড়াতাড়ি যাবি তত তাড়াতাড়ি ফিরতে পারবি।
নৌকায় উঠেই সাগরের ঠান্ডা হাওয়ায় চারজন জমিয়ে বসে আড্ডাবাজি শুরু করল। লিংকিন পার্ক থেকে শুরু করে ভিডিও গেমস সবই চলে এলো সেই গুলগাপ্পাবাজিতে। গানের প্রসঙ্গে সবাই নিজেরা হেড়ে গলায় কিছুক্ষণ গাইল। এক মনে বোটের হাল ধরে থাকা মাঝির দিকে তাকিয়ে তারা গাইতে অনুরোধ করল। নামও জেনে নিল মাঝির। জামাল। জামাল মিয়া কিছুক্ষণ ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে গানে টান দিল, মাঝি বাইয়া যাওরে। অকূল দরিয়া..
৫
ভুটো অধৈর্য হয়ে পড়ল, কিরে জামাইল্যা, তোর ফাতরার দ্বীপ আর কতদূর? যেতেই তো দুপুর তো হয়ে এলো মনে হয়!
ভুটোর কথায় সবাই ঘড়ির দিকে তাকাল। তাইতো। সাড়ে এগারোটা বাজে। একটানা বোট চালিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু ফাতরার দ্বীপের খোঁজ নেই। অথচ গতকাল লোকজন আধাঘণ্টার ট্রলার চালিয়েই দ্বীপে যাচ্ছিল। এক রাতে দ্বীপ ভাসতে ভাসতে দূরে সরে গেল নাকি?
গান বন্ধ করে মাঝি শুকনো মুখে বলল, মনে হয় আমরা সাগরে পথ হারিয়ে ফেলেছি!
তার মানে? চারজনে একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল।
চারদিকে তাকিয়ে দেখেন। কোন ডাঙা দেখা যায় না। না কোন গাছপালা। কোন নৌকা পর্যন্ত এদিকে নেই।
সবাই ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে উঠল, পথ হারিয়ে ফেলেছিস মানে? তুই ফাতরার দ্বীপ চিনিস না?
মাঝি মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, চিনতাম তো। বাবার সঙ্গে কতবার এসেছি। নিজে একলা একলা একবারও আসিনি।
এখন কী উপায়? যেদিক থেকে এসেছিলি সেদিক চল। আমাদের সিবিচে নামিয়ে দে।
সেটা পারলে তো দিতাম। তীর হারিয়ে ফেলেছি।
কিসলু তার বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে চারদিকে দেখে বলল, ওই দিকে গাছপালার মতো কী যেন দেখা যাচ্ছে। মন হয় সিবিচ। সঙ্গে সঙ্গে সবাই দেখি দেখি করে বাইনোকুলার নিয়ে সেদিকে দেখে বলল, হ্যাঁ। চল ওদিকেই বোট চালিয়ে নিয়ে যাই। জামাল মিয়া ওদিকেই বোট চালাও।
বোট সেই গাছপালার কাছাকাছি আসতেই মাঝি বলল, এইটা সিবিচ না। দ্বীপ। মনে হয় সেই খারাপ দ্বীপটা।
কি বলছিস আবোলতাবোল! খারাপ দ্বীপ মানে!
আছে। সবাই বলে এখানে একটা খারাপ দ্বীপ আছে। ভয়ের দ্বীপ। ভূত আছে। জিন আছে। দৈত্য আছে। দানব আছে। কেউ যায় না। গেলে প্রাণ নিয়ে ফেরে না। মৃত্যুর দ্বীপ।
ডানপিটে ঝন্টু বললো, রাখ তোর বকাবকানি। আগে দ্বীপে গিয়ে নামি। মাটিতে একটু রেস্ট নিয়ে দ্বীপটা ঘুরে দেখে আবার বোট নিয়ে সাগরে নামবো। অন্য বোটের সন্ধান পেলেই হবে। অত চিন্তার কিছু নেই। এখনও গোটা দিন পড়ে আছে।
দ্বীপের চরায় নৌকা লাগাতেই সবাই শুকনো বালির উপর লাফ দিয়ে নামে। একটু এগুতেই তীরজুড়ে ছোট ছোট বরইগাছের সারি। পেকে লাল হলুদ হয়ে আছে। হাত বাড়িয়েই পাড়া যায়। ভুটোই আগে মুখে দিয়ে বলল, বেশ খেতে। টক টক মিষ্টি মিষ্টি।
আর যায় কোথায়। সবাই হামলে পড়ল বরইগাছের উপর। ভুটোর মুখের কথায় বিশ্বাস নেই। খেয়ে প্রমাণ। বরইয়ের স্বাদ পেয়ে এরকম মাগনা জিনিসে সবাই যেন উন্মত্ত হয়ে উঠল। টুকটাক কুলের কাঁটা উপেক্ষা করে বরই পাড়ার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল।
এতো বরই পাড়া হলো। এখন রাখা যায় কোথায়? কিসলু বিকল্প পাত্র বের করল। পায়ের কেডস খুলে মোজাই হয়ে গেল বরইয়ের থলে। চার মূর্তি থলে ভরায় ব্যস্ত। জামাল এসব বুনো বরই খায় না। সে চরার ওদিকে ঘুরতে লাগল।
হঠাৎ করে ঝন্টুর মনে হলো এই মচমচানি ওদের নয়। এর ধরণই যেন কেমন। কোন বিশালাকায় প্রাণী সাবধানে পা টিপেটিপে এগিয়ে এলেই এমনটি হতে পারে।
হঠাৎ করে জামালের চিৎকারে চার মূর্তি সেদিকে এগিয়ে গেল। এইটা কী? কী এইটা?
জামাল ‘এইটা কী’ বলে যেটা দেখে শোরগোল তুলেছে সেটা একটা জন্তুর পায়ের ছাপ। তবে পায়ের ছাপটা বিশাল বড়। সচরাচর এত বড় জন্তু দেখা যায় না। সবাই মনোযোগ দিয়ে পায়ের ছাপ দেখল। পলাশ জামালের কাছে জিজ্ঞেস করল, এদিকের দ্বীপে কি বাঘ ভাল্লুক আছে নাকি? ছাপ তো দেখে সেরকমই মনে হয়। তবে আরো বড়।
জামাল দুদিকে মাথা নাড়ল। সেরকম কিছু কখনও কারো মুখে শুনিনি। কোন দ্বীপে বাঘ ভাল্লুক থাকলে সরকার কি লোকজনকে এভাবে দ্বীপে যেতে দিত?
ভুটো বলল, আমার কি মনে হয় জানিস? কেউ শয়তানি করে এগুলো বানিয়ে রেখেছে। যাতে বরইগাছ থেকে বরই পাড়তে এলে ভয় পায়।
ভুটোর কথায় অন্য সময় গুরুত্ব না দিলেও এখন সবাই একমত হলো। দিনের এই উজ্জ্বল আলো, নৈসর্গিক পরিবেশ, সুনীল সমুদ্র, সামান্য বিশাল আকৃতির পায়ের ছাপ তাদের মনে ভয়ের রেখাপাত করল না। তীরে এত বরই, তাহলে ভেতরে আরো কত না ফলফলাদি সম্পদ আছে?
ওরা চারজনে হৈ হৈ করে ভেতরে ঢুকে পড়ল। জামাল বোট পাহারা দেওয়ার জন্য বোটের আশপাশেই থাকল। শুধু মৃদু স্বরে বলল, এট্টু তাড়াতাড়ি ফিরেন!
বরইগাছের পাশ দিয়ে ভেতরে ঢুকতে থাকে ওরা। আরো কয়েকটা অপরিচিত গাছে কি সব টসটসে লাল বুনো ফল ঝুলছে। ভুটো এগিয়ে গেলে কিসলু নিষেধ করল, আন্দাজে না জেনে কিছু খাসনে। মাকাল ফলটল হতে পারে। শেষে পাগল হয়ে দ্বীপ কন্ট্রোল করবি।
ঝন্টু কিছু একটা দেখে পিছিয়ে পড়েছিল। কোন একটা বুনো প্রাণীর কংকাল হবে। কেউ খেয়ে হাড়গোড় ফেলে রেখেছে। তার বুক দুরু দুরু করে কাঁপতে লাগল। সত্যিই কি অশুভ কিছু আছে এই দ্বীপে? এই হাড়গোড় কোন মানুষের নয়তো?
ভেতরে আরো গহীন বন। বাকি তিনজনকে ঝন্টু গাছের ঝোপের কারণে দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু ওরা যে এগিয়ে যাচ্ছে সেটা শুকনো পাতায় পায়ের মচমচানিতে বুঝতে পারল।
হঠাৎ করে ঝন্টুর মনে হলো এই মচমচানি ওদের নয়। এর ধরণই যেন কেমন। কোন বিশালাকায় প্রাণী সাবধানে পা টিপেটিপে এগিয়ে এলেই এমনটি হতে পারে। মচমচানির শব্দ দূরে যাচ্ছে না। এগিয়ে আসছে।
ঝন্টু ‘ভুটো…কিসলু’ বলে ডাকতে গিয়ে হা করেই রইল। গলার স্বর ফুটল না। তার থেকে মাত্র দশ গজ সামনেই গাছের আড়াল থেকে তার দিকেই তাকিয়ে আছে বিশালাকায় একটা প্রাণী!
আকৃতিতে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের প্রায় দ্বিগুণ। সমস্ত শরীর মিশকালো। কালো লোমেভর্তি। চোখ জোড়া জ্বলছে আগুনের গোলার মতো। কিন্তু গোটা মুখটাতে বিড়ালের আকৃতি। গোঁফ আছে। বাঘ সম্প্রদায় যে বিড়ালগোত্রীয় এটাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু পৃথিবীর কোথাও কি এরকম কালো বাঘ আছে?
ঝন্টু যেন সম্মোহিতের মতো হয়ে আছে। ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে কালো বাঘটা। ঝন্টু দাঁড়িয়ে আছে স্ট্যাচুর মতো। নিশ্বাস বন্ধ করে আছে সাক্ষাৎ মৃত্যুর জন্য। কালো বাঘটা ঠিক তার সামনে এসেই বিশাল একটা ‘মিয়াও’ শব্দ করে লাফিয়ে পড়ল তার উপর।
চলবে…