মিছিলের পুরোভাগে এক কিশোর। তার দৃষ্টিতে সেদিন ছিল না কোন ভয়...
Published : 12 Aug 2023, 01:21 PM
‘তোমার পতাকা যারে দাও/ তারে বহিবারে দাও শক্তি।’ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সেই পতাকা বহিবার শক্তি ছিল মাজহার আহমদের। শহীদ স্মরণে উড়ানো কালো পতাকা নামিয়ে বা পুড়িয়ে ফেলেছিল পাকিস্তানবাদী অপশক্তি। এ ঘটনা বিক্ষুব্ধ করেছিল ছাত্রসমাজকে। সেই বিক্ষোভের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কিশোর মাজহার আহমদ। পতাকার মর্যাদার লড়াইয়ে জীবনের মূল্যে জয়ী হয়েছিলেন তিনি।
তখন পূর্ববাংলা জুড়ে চলছিল গণআন্দোলন। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের দুই অংশের বৈষম্য তুলে ধরে পেশ করেন ৬ দফা দাবি। ১৯৬৮ সালের নভেম্বরে ছাত্র অসন্তোষকে কেন্দ্র করে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে আইয়ুবী শাসনের বিরুদ্ধে। ৮ ডিসেম্বর প্রধান বিরোধী দলগুলোর ডাকে গোটা পূর্ববাংলায় পালিত হয় হরতাল। ৪ জানুয়ারি ১৯৬৯-এ গঠিত হয় ‘ছাত্র সংগ্রাম কমিটি’ এবং ১১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। ৮ দফা নিয়ে ৮ জানুয়ারি গঠিত হয় ‘ডেমোক্রেটিক অ্যাকশান কমিটি’ (ডাক)।
১৯৬৯ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আইয়ুববিরোধী গণআন্দোলন সোচ্চার হয়ে ওঠে। ছাত্রদের ওপর হামলা ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ২০ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্রসভা ও প্রতিবাদ মিছিলের কর্মসূচি নেওয়া হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে মিছিলে পুলিশের গুলিতে ছাত্র ইউনিয়ন নেতা আসাদুজ্জামান মারা গেলে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। ২৪ জানুয়ারি দেশব্যাপী হরতালে পুলিশের গুলিতে নবকুমার ইনিস্টিটিউটের দশম শ্রেণির ছাত্র মতিউর এবং ছুরিকাঘাতে রুস্তম নিহত হলে ঢাকার পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
১৫ ফেব্রুয়ারি ক্যান্টনমেন্টে আগরতলা মামলার অভিযুক্ত সার্জেন্ট জহুরুল হকের নির্মম হত্যাকাণ্ড গণআন্দোলনকে দান করে চূড়ান্তরূপ। ১৮ ফেব্রুয়ারি ইপিআরের বেয়নেটের আঘাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শামসুজ্জোহা নিহত হন। গণবিক্ষোভে ফুঁসতে থাকে পূর্ববাংলা। ২১ ফেব্রুয়ারি বেতার ভাষণে আইয়ুব খান পদত্যাগের ঘোষণা দেন। আইয়ুব সরকার ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা মামলা প্রত্যাহারে বাধ্য হয়। ২৫ মার্চ আইয়ুব খান সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। এই পটভূমিতে শহীদ মাজহারের আত্মদানের ঘটনা বিবেচ্য।
১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯। জায়মান বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের প্রভাব পড়েছিল ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জ মহকুমার বৈদ্যের বাজারে। সেখানের ছাত্রসমাজ উজ্জীবিত হয়েছিল গণআন্দোলনে। বেলা সাড়ে তিনটায় নারায়ণগঞ্জের বৈদ্যেরবাজার থানার নবীনগরে পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির চিফ হুইপ এম এ জাহেরের বাসভবনে শোভাযাত্রাকারী ছাত্রজনতা কালো পতাকা উত্তোলনের দাবি জানায়।
কিন্তু বাড়ির লোকজন তাতে বাধা দেয়। বিষয়টিকে কেন্দ্র করে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। এসময় বাড়িতে প্রহরারত পুলিশদল ছাত্রদের উদ্দেশ্যে রাইফেলের ফাঁকা আওয়াজ করে। ফলে ছাত্ররা আরো উত্তেজিত হয়ে পড়ে। তখন চিফ হুইপের ভাই নূর মোহাম্মদ বাড়িতে প্রহরারত পুলিশের একজনের হাত থেকে রাইফেল কেড়ে নিয়ে ছাত্রজনতার উপর বেপরোয়া গুলিবর্ষণ করে। ফলে ঘটনাস্থলে স্থানীয় হোসেনপুর হাই স্কুলের প্রবেশিকা পরীক্ষার্থী মাজহার আহমদ নিহত হন। আহত হন ৬-৭ জন।
সমবেত ছাত্রদের কাছে মাজহার জিজ্ঞেস করেছিলো- আপনারা কে কে আজ বন্দুকের সম্মুখে দাঁড়াতে প্রস্তুত? যারা হাত তুলেছিল তাদেরকে মিছিলের পুরোভাগে গিয়ে দাঁড়িয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন। (‘লুটিয়ে পড়লো মাজহার’, দৈনিক পূর্বদেশ, ১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭০)
ঘটনার অন্য একটি ভাষ্য হচ্ছে- এর আগে ছাত্ররা চিফ হুইপ এম এ জাহেরের বাড়িতে একটি কালো পতাকা স্থাপন করে। এই পতাকাটি বাড়ির লোকজন পুড়িয়ে ফেলেছে বলে ছাত্ররা খবর পায়। বৈদ্যের বাজার থানার বিভিন্ন বিদ্যালয়ের ছাত্ররা হোসেনপুর হাইস্কুল মাঠে মিলিত হয়ে সভাশেষে কালো পতাকাটি পুনরায় স্থাপনের জন্য মিছিল করে এগিয়ে যায়। তখনই ঘটে ইতিহাসের এই মর্মান্তিক ঘটনা।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও জনৈক বন্ধুর সূত্রে শামসুল হক আলী নূর সচিত্র নিবন্ধে শহীদ মাজহার আহমদের আত্মদানের কাহিনি লিখেছিলেন, ‘মিছিলটি সেদিন (১৯৬৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি) এগিয়ে চলছিল নবীনগরের সংকীর্ণ মেঠোপথ দিয়ে। মিছিলের পুরোভাগে ছিল কালো পতাকাবাহী এক কিশোর। তার দৃষ্টিতে সেদিন ছিল না কোন ভয়, বরং তার অভিব্যক্তিতে ছিল শপথের দৃঢ়তা। দৃঢ় প্রতিজ্ঞায় অটল বলিষ্ঠ পদক্ষেপে এগিয়ে চলছিল সে জোরে, আরো জোরে, পেছন থেকে ওর এক বন্ধু চিৎকার করে বলে ওঠলো: যাসনে মাজহার, যাসনে!
কিন্তু মাজহার ফিরে তাকায়নি পেছনের ডাকে। দৃঢ় প্রতিজ্ঞা তার। কালো পতাকা সে উত্তোলন করবেই করবে। ঠিক এমনই সময় হঠাৎ করে একটা গুলি এসে বিদ্ধ হলো মাজহারের বুকে। ‘ভায়েরা আমার’ বলে লুটিয়ে পড়লো মাজহার, আর তাই রক্তে ছেয়ে গেল সেই কালো পতাকাটি, নবীনগরের সেই ধুলি-ধূসরিত মেঠোপথ। ঘটনাটি বলতে গিয়ে সেদিন কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিল মাজহারের সেই বন্ধুটি; যে মাজহারকে সামনে এগুতে নিষেধ করেছিল।
মাজহারের আরেক বন্ধুর সঙ্গে সেদিন আলাপ হয়েছিল আমার। বন্ধুটি কান্না ভেজানো কণ্ঠে মাজহারের শহীদ হবার কাহিনি বর্ণনা করে গেলো- “সেদিন ছিল শনিবার। ১৯৬৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি। নবীনগরে একটা বাড়িতে যে কালো পতাকা পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল তারই প্রতিবাদে সভা। ‘ভায়েরা আমার’ বলে উদাত্ত কণ্ঠে সেদিন মাজহার বলেছিল, ‘ওরা যে কালো পতাকা পুড়িয়ে ফেলেছে আমরা আজ তা পুনরায় উত্তোলন করবো। প্রয়োজন হলে আরও রক্ত দেবো। কিন্তু আসাদ ভাই, মতিউরের রক্তকে ব্যর্থ হতে দেবো না।”
তারপরই সমবেত ছাত্রদের কাছে মাজহার জিজ্ঞেস করেছিলো- আপনারা কে কে আজ বন্দুকের সম্মুখে দাঁড়াতে প্রস্তুত? যারা হাত তুলেছিল তাদেরকে মিছিলের পুরোভাগে গিয়ে দাঁড়িয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন। (‘লুটিয়ে পড়লো মাজহার’, দৈনিক পূর্বদেশ, ১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭০)
সেদিন বিক্ষোভকারী ছাত্র-জনতার উপর গুলিবর্ষণের খবর নারায়ণগঞ্জে পৌঁছলে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হয়। পূর্ববাংলা জুড়ে যে গণবিক্ষোভ চলছিল, এ ঘটনা সে অঞ্চলকে আন্দোলিত করেছিল বিপুলভাবে। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ অফিসে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। মাজহার আহমদ এবং ক্যান্টেনমেন্টে সার্জেন্ট জহুরুল হককে হত্যার প্রতিবাদে ১৭ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জে হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত হয় এবং মাজহার হত্যার প্রতিবাদে বৈদ্যেরবাজার থানার মোগড়াপাড়া হাইস্কুল মাঠে ছাত্র-জনসভা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ১৮ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জ মহকুমা আওয়ামী লীগ কার্যকরী সংসদের এক জরুরি সভায় অবিলম্বে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবসহ মামলায় অভিযুক্ত সব ব্যক্তিকে বিনাশর্তে মুক্তি দিয়ে দেশে শান্তি ও শৃংখলা ফিরিয়ে আনার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
একুশ বছরের উৎপীড়ন ও অত্যাচারে মুক্তিকামী বাঙালি যখন অতিষ্ঠ তখন বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা ও ছাত্রসমাজের ১১ দফা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি সমাজ খুঁজে পেয়েছিল তাদের মুক্তির সোপান। তাই আইয়ুববিরোধী আন্দোলন হয়ে উঠে তীব্র। একজন ছাত্র হিসেবে, সচেতন ঘরের সন্তান হিসেবে মাজহার এ জাগরণের বাইরে ছিলেন না।
কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি উপজেলার গোবিন্দপুর ইউনিয়নের মির্জানগর গ্রামের প্রাক্তন জেলা বোর্ড সদস্য ও সমাজসেবী মফিজউদ্দিন আহমদের তৃতীয়পুত্র মাজহার আহমদ। পড়াশোনার সূত্রেই হোসেনপুরে অঞ্চলে এসেছিলেন মাজহার। তিনি প্রাণ দিলেন দেশের জন্য, দেশবাসীর মুক্তির জন্য। স্কুলছাত্র মাজহার উদীপ্ত হয়েছিলেন উনসত্তরের শহীদদের স্মরণে কালো পতাকা উত্তোলনে। এর পেছনের তত্ত্বকথাটি ছিল বাঙালির স্বাধিকার সংগ্রামের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য, বাঙালির আত্মবিকাশের প্রতি সমর্থন এবং ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে দ্রোহ।