অনূদিত গল্প
‘বাবা আমাকে ক্লাসে নিয়ে আসেন। আমার হাতটা তার বড় মুঠোয় ধরে রাখেন। উনি যখন আমাকে এখানে একলা রেখে যান তখন আমাকেও শক্ত থাকতে হবে।’
Published : 19 Nov 2024, 12:59 PM
মার্কিন কথাসাহিত্যিক টনি মরিসন গল্প বলার নিপুণ কারিগর। তার যুগান্তকারী উপন্যাস ‘বিলাভড’ ১৯৮৮ সালে পুলিৎজার পুরস্কার পায় কল্পকাহিনি ক্যাটেগরিতে। তিনি ১৯৯৩ সালে ‘কালো নারী’ হিসেবে প্রথম সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান।
‘রিমেম্বার’ তার ছোটদের জন্য লেখা প্রথম ইতিহাস বিষয়ক বই। বইয়ের ফ্ল্যাপে লেখা আছে, “১৯৫৪ সালের ১৭ মে যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট সাদা কালোর আলাদা শিক্ষাব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক বলে রায় দেয়। এই রায় আমাদের জাতীয় জীবনে মুখ্য ভূমিকা রাখে, যার ফলাফল এখনো রয়ে গেছে।”
‘সরু গলি’, ‘দরজা খুলে গেল’, ‘দূরের পথ’- এই তিন শিরোনামের তিনটি ছোট অধ্যায়ে বইটি ভাগ করা হয়েছে।
সরু গলি
অনেক অনেক বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন বর্ণের শিশুরা একসঙ্গে স্কুলে যেতে পারতো না। কর্তৃপক্ষ শিশুদের গায়ের রঙের উপর ভিত্তি করে তাদের জন্য স্কুল নির্ধারণ করে দিত। আইনে বলা ছিল এসব আলাদা আলাদা স্কুলে শিশুরা যেন সমান সুযোগ সুবিধা পায়। যাই হোক, কালোদের অনেক স্কুলের মানই সাদাদের স্কুলের তুলনায় বেশ খারাপ ছিল।
তখন আমার মনে প্রশ্ন জেগেছিল কেন আমি সাদা গায়ের রঙের শিশুদের সঙ্গে স্কুলে যেতে পারি না? তারা কি আমার মোজা, আমার চুলের বেণি দেখে ভয় পায়? কিন্তু আমার তো তাদের মতোই একই বয়স, মাত্র সাত বছর। তারা আমাকে দেখে কেন ভয় পায়?
আমার একটা খেলনা পুতুল ছিল, যার নাম জেসমিন। যখন এটা আমার চাচাতো বোনের কাছে ছিল, তারা নাম রেখেছিল ‘বেটি’। তারপর যখন এটা আমার বোন হাতে পেল, সে নাম দিয়েছিল ‘অ্যালিস’। তারপর এটা আমার হাতে আসে। তখন থেকে তাকে আমি ‘জেসমিন’ নামে ডাকি। এটা অনেক পুরোনো একটা পুতুল ছিল। শুরুতে সেটা দেখতে কেমন ছিল সেটা এখন শুধুই অনুমান করা যায়।
আমার মনে হয়, শুরুতে তার তার পোশাকের রং ছিল লাল, যার মধ্যে সাদা রঙের ফুটকি ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সেগুলো ছিঁড়ে গিয়েছিল। কিন্তু তবুও পুতুলটা কান্নাকাটি করতে পারতো না। এখন তার শুধু হলুদ রঙের বিবর্ণ চুল আর সবুজ রঙের চোখ দুটোই অক্ষত আছে। আমি ওর সঙ্গে খেলতে পছন্দ করি। সে কখনও আমাকে দেখে ভেংচি কাটে না বা আমাকে গালি দেয় না। আমি যখন শহরে যাই, তখন সে সাদা শিশুদের মতো আমার দিকে আঙুল তুলে না বা আমাকে দেখলে মায়ের আঁচলে গিয়ে লুকায় না।
আমাদের স্কুলগুলোতে তেমন কোন সুবিধাদি ছিল না। ক্লাসরুমগুলো ছিল ছোট আর অন্ধকারাচ্ছন্ন। বাইরের দুনিয়ায় আকাশ ছিল নীল। আর ঘাসগুলো ছিল লম্বা। সেখানে মৌমাছি ও প্রজাপতি উড়ে বেড়ায়। গাছে গাছে পিচ ফল ধরে। সেগুলো অনেক মিষ্টি আর শাঁসালো। মাটিতে পড়লেই সেগুলো ভেঙে যায়।
আমি জানি, আমিও লেখাপড়ায় অনেক ভালো করতে পারি, যদি একটা সত্যিকারের টেবিল পাই, সঙ্গে অনেক বই আর দরকারি জিনিস। আমাদের বাবা মায়েরা তাই শিক্ষাবোর্ডের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিল। ব্যাপারটা এমন না যে তারা শিক্ষাবোর্ডকে ঘৃণা করতো। আসলে তারা আমাদের ভালোবাসে। আর আমাদের কষ্ট উপলব্ধি করতো। তারা শুধুই আশাবাদী ছিলেন না, তাদের সংকল্পও অনেক দৃঢ় ছিল। পথ যতই সরু আর দীর্ঘ হোক না কেন, তারা সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে চলল।
দরজা খুলে গেল
১৯৫৪ সালের ১৭ মে। যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট একটা রায় দিল। ছাত্রছাত্রীদের স্কুলে যাওয়ার ধরন বদলে গেল। ‘কালো বনাম শিক্ষাবোর্ড’ নামের সেই মামলার শেষে সুপ্রিম কোর্ট জানিয়ে দিল, সাদা কালোর আলাদা আলাদা শিক্ষাব্যবস্থা একটা বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা। এই রায়ে আইন বদলে গেল, যাতে স্কুলগুলো আর আলাদা আলাদা না থাকতে পারে। তারা বলল, এই দিনটা যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
অনেকের জন্যই এটা একটা তাৎপর্যপূর্ণ দিন ছিল, কিন্তু সবার জন্য নয়। স্কুলে যখন শরৎকালীন নতুন বছর শুরু হলো, তখন অনেকেই সাদাদের সঙ্গে স্কুলে গেল। এটা একটা অভূতপূর্ব ঘটনা ছিল। কিন্তু অনেক জায়গায় মানুষ সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ের বিরোধিতা করলো। আমি মনে মনে অনেক বিভ্রান্তি নিয়ে স্কুলে গেলাম। সেখানে দেখলাম আমার বয়সী অনেক সাদা শিশুই এসেছে। কিন্তু আমি সাহস করে তাদের সঙ্গে কথা বলে উঠতে পারছিলাম না। ভাবছিলাম যদি তারা আমাকে ঘৃণা করে!
তারপর আমরা ধীরে ধীরে বন্ধু হয়ে গেলাম। একসঙ্গে অনেক আনন্দ করতে শুরু করলাম। সাদা বন্ধুরা অনেক ক্ষেত্রেই ভুল ছিল, কিন্তু তারা আমার বন্ধু ছিল। আর বন্ধুরা একজন অজানা অচেনা মানুষের চেয়ে বেশি আপন। কিন্তু অনেক জায়গায় কালো শিশুরা স্কুলে আসায় সাদা শিশুরা আসা বন্ধ করে দিল। তাদের বাবা-মা তাদের স্কুলে আসতে নিষেধ করে দিল। অনেক জায়গায় সাদা মানুষেরা কালো শিশুদের স্কুলে ঢুকতে বাধা দিল।
অনেকেই আমাদের শুধু কালো বলে ঘৃণা করতো। আমাদের কাজের জন্য নয়। ফলে আমরাও তাদেরকে তাদের গায়ের রঙ এবং কাজের জন্য ঘৃণা করতে পারতাম। ঘৃণার বিপরীতে ভালোবাসা দেখাতে গেলে অনেক সাহসের প্রয়োজন হয়। আমরা তবুও চেষ্টা চালিয়ে গেলাম। অনেক সময় সৈন্যরা আমাদের রাস্তা আগলে দাঁড়ালো। আমরা ভয় পাচ্ছিলাম তাদের কথা না শুনলে যদি আমাদের উপর গুলি চালায়!
টিফিনের সময় আমাদের অনেক সময় একা একা খেতে হতো। আমি সাহস করে মুখ তুলে তাদের দিকে তাকাতে পারতাম না। তাদের দেখলে আমরা ফুটপাত ছেড়ে দিয়ে হাঁটতাম। আমার সামনে বসা সাদা মেয়েটি আমার চোখে শুধু একজন মেয়েই ছিল। আর তার চোখে আমিও। আমরা হয়তোবা বন্ধু নই, কিন্তু আমরা দুজনেই মেয়ে ছিলাম। অনেকেই আমাকে ভয় দেখাতে চেষ্টা করতো। আমি মনে মনে বলতাম, তাদের কি আমার বয়সী কোন সন্তান নেই যে আমাকে ভয় দেখাতে চাইছে! আরও ভাবতাম, তারাও তো একসময় শিশু ছিল। তাহলে তারা কি জানে না, ভয় পেলে শিশুদের কেমন লাগে!
ক্লাসরুমের খোলা দরজার সামনে এসে দাঁড়ালে আমি সামনে শুধুই অন্ধকার দেখতে পাই। আমার বাবা আমাকে ক্লাসে নিয়ে আসেন। আমি জানি, সে অনেক বুদ্ধিমান এবং শক্তিশালী। বাবা আমার হাতটা তার বড় মুঠোয় ধরে রাখেন। উনি যখন আমাকে এখানে একলা রেখে যান তখন আমাকেও শক্ত থাকতে হবে। আমি জানি আমি সেটা পারবো। আমি জানি সামনে যতই অন্ধকার থাকুক আমি এগিয়ে যাবোই।
দূরের পথ
যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যেকটা সমাজেই সাদা কালোর জন্য আলাদাভাবে সমান অধিকারের বিষয়টা চালু ছিল। সেখানে আলাদা আলাদা রেস্তোরাঁ ছিল। সাদা কালোর জন্য পানির কলও ছিল আলাদা। সিনেমা হলে সাদা কালোর জন্য আলাদা সিট বরাদ্দ ছিল। বাসে ট্রেনেও একই অবস্থা ছিল।
আফ্রিকান-আমেরিকানরা সহজেই ভোট দিতে পারতো না। তারা বাসাবাড়ি কিনতে পারতো না। এমনকি তারা ভালো চাকরিও করতে পারতো না। অনেক কালো মানুষ তাই সাদাদের সহায়তায় সমতা ও নাগরিক অধিকারের জন্য আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিল।
পাশাপাশি দুটো পানির কল দেখে আমার মনে প্রশ্ন জাগতো, আমি ও একজন সাদাতো আসলে একই পানি পান করছি! তাই দুটো আলাদা কল রাখা আমার কাছে নিতান্তই বোকামি মনে হতো। এটা আমার কাছে শুধুই বাড়তি খরচ মনে হতো। অবস্থা দেখে মনে হতো, পানি যেন জানে যে কে তাকে পান করছে। আসলে কালো মানুষকে ছোট করে দেখানোটাই ছিল মুখ্য। অবশ্য আমি এ-ও জানি, অনেকেই নিজেকে বড় করে দেখানোর জন্য যেকোনো কিছু করতে রাজি।
রেস্তোরাঁয় আলাদা বসে খাবার খাওয়াটা ছিল খুব কঠিন। কারণ মানুষ সহজেই বুঝে যেত আমি কোন দলের অন্তর্ভুক্ত। যেকোনো জনসমাগমে যেতে পারাটা খুবই সহজ একটা ব্যাপার হওয়া উচিত ছিল। সেখানে বসে এক কাপ কফি বা সোডা অর্ডার করতে পারাটা খুবই দরকার ছিল। এর চেয়ে সহজ সাধারণ ব্যাপার আর কী হতে পারতো!
কিন্তু আইন করে আমাদের আলাদা বসানো হতো। আর অনেকেই চাইতো না আমরা একসাথে বসি। আমি নিশ্চিত ছিলাম দিনশেষে তারা বিজয়ী হতে পারবে না। কিন্তু তাদের চোখেমুখে ঘৃণার অভিব্যক্তি পরিষ্কার ফুটে উঠতো। আমরা তবু চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকলাম।
অনেক মানুষই আলাদা আলাদা থাকতে চাইতো, অনেক সাদা মানুষ রীতিমতো মিছিল করে রাস্তায় নেমে এলো। অনেকেই আমাদের দিকে ডিম এবং পানি ছুড়ে মারতো। আমি মনে মনে চাইতাম, আমাকে যেন সমঅধিকারের জন্য আলাদা বিবেচনা না করা হয়। এর আগে আমি কখনই গ্রেপ্তার হইনি বা জেলে যাইনি। আমি ভয় পেয়েছিলাম, কিন্তু আমি ভীতু ছিলাম না। কারণ আমি জানতাম মাত্র একজন মানুষও যদি রুখে দাঁড়ায়, তাহলেই নিয়ম বদলে যাবে।
তারপর আমরা লুথারের কথায় একজোট হয়ে গেলাম। আমরা কোন ভয় ছাড়াই ক্লাসে গেলাম। আমি ক্লাসরুমের বোর্ডে এক জাদুকরের ছবি আঁকলাম। সে ইচ্ছে করলেই যেকোনো কিছু করতে পারে। আসলেই আমরা চাইলে যেকোনো কিছুই ঘটতে পারে।