অনূদিত গল্প
মরিসন সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান ১৯৯৩ সালে। এছাড়া পেয়েছেন প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অফ ফ্রিডম এবং পুলিৎজার পুরস্কার।
Published : 07 Oct 2024, 01:14 PM
সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মার্কিন ঔপন্যাসিক টনি মরিসন। যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইওর লরেনে একটি শ্রমজীবী পরিবারে ১৯৩১ সালে জন্ম নেন তিনি। ছোটবেলায় প্রচুর পড়তেন মরিসন। আফ্রিকান-আমেরিকান ঐতিহ্য থেকে নেওয়া তার বাবার গল্প, পরে তার নিজের লেখার একটি উপাদান হয়ে ওঠে।
মরিসন ওয়াশিংটন ডি.সিতে হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষা নিয়ে পড়াশোনা করেছেন এবং পড়িয়েছেন। ১৯৬৪ সালে একটি প্রকাশনা সংস্থার সম্পাদক হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৯৭০ সালে লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর থেকে তিনি প্রিন্সটনসহ বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করেন।
টনি মরিসনের কাজ আফ্রিকান-আমেরিকানদের জীবন ঘিরে, তাদের ইতিহাস ও নিজেদের সময়ে উভয়ই। তার লেখা প্রায়শই কঠিন পরিস্থিতি এবং মানবতার অন্ধকার দিককে চিত্রিত করে, কিন্তু সততা ও মুক্তির কথা বলে। তার ব্যক্তিগত জীবনের গল্পেও চরিত্রগুলোর মধ্যে অন্তর্দৃষ্টি, বোঝাপড়া এবং সহানুভূতি প্রকাশ পায়। পাওয়া যায় তার অনন্য বর্ণনার কৌশল।
শিশু-কিশোরদের জন্য লেখার পাশাপাশি মরিসনের উপন্যাসগুলোর মধ্যে রয়েছে- ‘দ্য ব্লুয়েস্ট আই', ‘সং অফ সলোমন’ এবং ‘বিলাভড’। তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান ১৯৯৩ সালে। এছাড়া পেয়েছেন প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অফ ফ্রিডম এবং পুলিৎজার পুরস্কার। ২০১৯ সালে নিউ ইয়র্কে মারা যান এই লেখক।
মরিসনের লেখা ৮টি গল্পের বই নিয়ে ‘অ্যা টনি মরিসন ট্রেজারি’ নামে ২০২৩ সালে একটি সংকলন প্রকাশ করে মার্কিন প্রকাশনী সংস্থা ‘সাইমন অ্যান্ড শুস্টার’। গল্পগুলো ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ পাবে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে। আজ রইলো এর দ্বিতীয় পর্ব।
শিল্প ও জীবন
ফক্সি নামের এক ঘাসফড়িঙের সঙ্গে কিড নামের এক পিঁপড়ার গলায় গলায় ভাব। তারা সারাদিন পার্কে খেলে বেড়ায়। সূর্য ডুবে অন্ধকার হওয়ার আগ পর্যন্ত তাদের হুল্লোড় থামে না। তারা গাছে চড়তে গিয়ে হাঁটুর ছাল তুলে ফেলে।
ফক্সি ও কিড অনেক দূর থেকে বাস্কেটবল ছুড়ে জালের মধ্যে ফেলে। তারা পুলের সেখানটায় সাঁতার কাটে যেখানটায় পানি ছিল ঠান্ডা। তারা পাখা ঝাপটিয়ে গিটারের মতো শব্দ করে গান করে।
একদিন অনেক গরম পড়লো। সেদিন দুই বন্ধু ছায়ার মধ্যে শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিল। হঠাৎ কিড তার বন্ধুর দিকে ঘুরে বলল, এবারের গ্রীষ্মকালটা অনেক মজার। এখন আমাদের উঠে পড়তে হবে। শীত আসার আগে অনেক কাজ করতে হবে। ফক্সি বলল, দাঁড়াও বাপু আমি মনে মনে সবে একটা নতুন সুর তুলেছি। তুমি এটা শুনেই দেখো! এটা এতোটাই সুমধুর যে বাজানোর সঙ্গে সঙ্গে চাঁদে পৌঁছে যাবে।
তারপর ফক্সি তার পাখাগুলো উঁচু করে ধরলো। সেগুলো খুব জোরে জোরে ঘষতে শুরু করলো। এমন একটা সুর তৈরি হলো, যেটা শুনে উপস্থিত জনতা মোহিত হয়ে গেল। তারা আনন্দে হাততালি দিতে শুরু করলো। কিড বলল, তোমার সুরটা দারুণ ফক্সি, কিন্তু আমার কথা শুনো। ছুটি শেষ হয়ে গেছে। আমরা সারাজীবন এই বাস্কেটবল কোর্টে জীবন কাটিয়ে দিতে পারবো না।
শুনে ফক্সি বলল, ঠিক আছে। তাহলে তুমি তোমার রাস্তায় যাও, আমি আমার রাস্তায় যাই। কে তোমাকে আটকাচ্ছে? আমি এখন আমার সুর সাধা নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত আছি। আর তুমি তো জানো, সুর সাধা কোন সহজ কাজ নয়। একটা সুর সাধতে অনেক কসরত করতে হয়। কিড বলল, ঠিক আছে, তুমি থাকো তাহলে। আবার দেখা হবে।
কিড বাসায় ফিরে অনেক কাজ করলো। সে পুরো বাড়ি ভ্যাকুয়াম দিয়ে তকতকে পরিষ্কার করল। তারপর বাজার করে নিয়ে আসলো। এভাবে সে দিন পেরিয়ে রাত করে ফেলল। অন্যদিকে ফক্সির সুর খুব জোরে এবং পরিষ্কারভাবে বেজে চলল। খুবই মিষ্টি সে সুর আর তালও দুর্দান্ত।
সেটা শুনে ঘরের মধ্যেই কিড নাচতে শুরু করে দিল। নাচে এতটাই মশগুল হয়ে গেল যে তার কাজগুলোও ঠিকঠাক করতে পারছিল না। তার ফাঁকে ফাঁকেই সে রান্নাঘরের স্টোভ ঠিক করলো। আঙিনায় গাছের পাতাগুলো পরিষ্কার করলো। আর ছোট গাছগুলোকে ঢেকে রাখলো যাতে সেগুলো ঠান্ডায় জমে না যায়। সে জ্যামের বয়ামগুলো উঁচু তাকে সুন্দরভাবে সাজিয়ে রাখলো। ইতোমধ্যে শীতকাল দরজায় এসে কড়া নাড়লো।
তখনও ফক্সি বাইরে কনকনে ঠান্ডার মধ্যে তার সুর সাধার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। সে একটা হার্ডবোর্ড বাক্সের মধ্যে আশ্রয় নিয়ে রাত আসার আগেই আরেকবার করে তার সুরগুলো ঝালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সে দেখতে পেল ঠান্ডায় তার পাখনা দুটো ভেঙে যেতে শুরু করেছে। সে সেগুলো মেরামত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তার আঙুলগুলো কাঁপছে। ক্ষুধায় এবং ঠান্ডায় ফক্সি এতটাই কাতর হয়ে পড়লো যে তার অজ্ঞান হয়ে যাবার জোগাড়। অনেক চেষ্টা করেও সে আর কোন সুর বাঁধতে পারলো না। লজ্জায় সে পার্ক থেকে বেরিয়ে পড়লো। তার আর কিছুই করার নেই। সব গর্ব বিসর্জন দিয়ে লোকালয়ে ফিরে এলো ফক্সি, খুব চেষ্টা করলো যেন সে না কাঁপে, না ভেঙে পড়ে।
একসময় সে কিড এর দরজায় এসে কড়া নাড়লো। বললো, কিড! আমার কোন খাবার নেই, আর আমি ঠান্ডায় জমে যাচ্ছি। আমার পাখাগুলো জমে গেছে আর পা দুটো অবশ হয়ে গেছে। আমার একটু উষ্ণতার খুবই দরকার। আমি কি একটু ভেতরে আসতে পার? কিড তার ডোনাটে একটা কামড় দিয়ে বলল, তুমি নিজের দিকে এক নজর তাকিয়ে দেখ। তুমি শীতে আক্রান্ত, ক্ষুধার্ত আর তোমার থাকার জায়গাও নেই। তা আমি কী করতে পারি বলো? আর আমাকে দেখ, আমি আগে থেকেই পরিকল্পনা করে রেখেছিলাম। তাই আমার এখন কোন সমস্যা হচ্ছে না।
এটা শুনে ফক্সি কান্নায় ভেঙে পড়লো। সে দুঃখে হাঁটু ভাঁজ করে বসে পড়লো। এখন তার কিডকে অনুরোধ করা উচিত, কিন্তু তার দম্ভ তাকে বাঁধা দিচ্ছে সেটা করতে। বলল, সুর তুলে তোমাদের আত্মার খোরাক জুগিয়েছি, তার বিনিময়ে তুমি কি আমাকে তোমার বাসায় এক কোণে ঠাঁই দিতে পারো না?
কিড বলল, দেখো তোমার আগেই ভেবে দেখা উচিত ছিল, আগামীকাল কী ঘটতে যাচ্ছে? আর সেইমতো নিজেকে তৈরি করা। ফক্সি বলল, আমি একজন শিল্পী আর আমি সেটাই করছিলাম। তুমি যদি আমার সুরকে ভালোবেসে থাকো, তাহলে আমাকেও তোমার সম্মান করা উচিত। তুমি কীভাবে বলো যে, আমি একদিনও কাজ করিনি। শিল্প অবশ্যই একটা কাজ, যদিও এটা দেখতে অনেকটা খেলার মতো।
হাসতে হাসতে কিড বলল, তার মানে তুমি বলতে চাইছো, কোন কিছু করার চেয়ে সেটা অনুভব করা বেশি জরুরি? কিন্তু আমাকে দেখো, আমি দাঁড়িয়ে আছি আর তুমি নিল ডাউন হয়ে আছো। আমি আমার পরিবারের সঙ্গে বিছানায় ঘুমাই। কিন্তু তুমি একলা একটা বাক্সের মধ্যে থাকো। ফক্সি বলল, সুর তোমার আমার সবার জন্যই ভালো। তাই আমি তোমার কাছ থেকে ন্যূনতম সহানুভূতি আশা করেছিলাম।
এটা বলেই ফক্সি বলল, কিড তুমি একটা সুর তৈরি করে আমায় শোনাও তো দেখি, কেমন পারো! আমি অবশ্যই একজন মহান শিল্পী। কিন্তু কিড বলল, তুমি আসলে নকল করো।
এভাবে তাদের মধ্যে ঝগড়া চলতেই থাকলো। অবশেষে ফক্সি বলল, তোমার পেটে খাবার আছে। তোমার উষ্ণ একটা বিছানা আছে। তোমার একটা পরিষ্কার বাড়ি আছে। কিন্তু তোমার তো কোন স্বপ্ন নেই। তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো, আমি কী বলতে চাইছি? এসব শুনে কিড বলল, আমি অতশত বুঝি না, আমি শুধু জানি ঠান্ডা জাকিয়ে আসলেই তোমার দেখা পাওয়া যায়। আমার মনে হয় তোমার এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত।
ফক্সি হোঁচট খেতে খেতে উঠে দাঁড়ালো, তারপর রাতের অন্ধকারে বেরিয়ে পড়লো। গর্বে তার মাথাটা উঁচু করে রাখলো, হাত দিয়ে শক্ত করে তার পাখনা দুটো জড়িয়ে ধরে রাখলো। আর মনে মনে বলল, আমি যখন আমার সুরকে আমার পাখনার মধ্যে আটকে রাখবো তখন কিডের দিন রাত সব বিরক্তিকর আর একঘেয়ে হয়ে যাবে।
নাম, খ্যাতি, দোষারোপ করা, লজ্জা দেওয়া, কোনটা আসলে বড়? প্রশ্নটা হচ্ছে, খেলাটা আসলে কে জিতবে!