অনেকের চোখেই তিনি ‘সর্বকালের সেরা’। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ‘ডেইলি মেইল’ এক প্রতিবেদনে তুলে ধরার চেষ্টা করেছে, কেন পেলেকে সবার সেরা বলা হয়। এখানে রইলো তার সারসংক্ষেপ।
Published : 30 Dec 2022, 08:20 PM
দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে বড় দেশ ব্রাজিল, আর তার দক্ষিণ-পূর্ব অংশের শহর সাও পাওলো। প্রায় দুই কোটি লোকের বসবাস এ শহরে। জনসংখ্যার বিচারে এটি দেশটির সবচেয়ে বড় শহর।
এখানেই এক দারিদ্রক্লান্ত বস্তিতে ১৯৪০ সালে ২৩ অক্টোবর পেলের জন্ম, পুরো নাম ‘এদসোঁ আরাঁচ দু নাসিমেঁতু’।
সাও পাওলোর ধুলোময় অলিগলিতে পুরনো মোজা মুড়িয়ে ফুটবল বানিয়ে খেলতো বস্তির টিংটিঙে ছেলেরা। পেলে যোগ দিতো তাদের সঙ্গে, ওই অল্প বয়সে পায়ের জাদুতে দুর্দান্ত সব মুহূর্তের জন্ম দিতো বস্তিবাসী পেলে।
চারদিকে হৈহৈ রব উঠতো, তাকে কাঁধে করে নাচতো বাকি ছেলেরা। বস্তি-বাড়ির দরজা ঠেলে, ভাঙা জানালার পাল্লা মেলে কিংবা জীর্ণ দালানের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে এ দৃশ্য দেখতো মা-খালারা।
তার বাবা-মায়ের একটি ফুটবল কিনে দেওয়ারও সামর্থ্য ছিল না। সেই ছেলেটি মাত্র ১৫ বছর বয়সে সান্তোসের মূল দলে খেলে সবার নজর কাড়ে, ব্রাজিল জাতীয় দলে সুযোগ পায় মাত্র ১৬ বছর বয়সে। তারপর সুইডেনে ১৯৫৮ বিশ্বকাপে ১৭ বছর বয়সে মাঠে নামেন পেলে, পায়ে তার সাও পাওলোর রাস্তার ধুলি তখনও লেগে আছে। ৪ ম্যাচে ৬ গোল করে ব্রাজিলকে জিতিয়ে দেন বিশ্বকাপ। হয়ে যান সবচেয়ে কম বয়সে বিশ্বকাপজয়ী ফুটবলার।
সেই বিশ্বকাপের আগে পায়ে চোট পেয়েছিলেন পেলে। কিন্তু তার সতীর্থ খেলোয়াড়রা ধরেবেঁধে পেলেকে সুইডেনে বিশ্বকাপ খেলতে নিয়ে যান। তার দুই পা ততদিনে হয়ে ওঠেছে বিস্ময়-জাগানিয়া, সেই বিশ্বকাপে পেলে ৬ গোল করেন, ফাইনালে করেন জোড়া গোল। ম্যাচ শেষে আনন্দে জ্ঞান হারিয়েছিলেন পেলে। জ্ঞান ফেরার পর প্রতিপক্ষ সুইডেন দলের মিডফিল্ডার সিগভার্দ ইমানুয়েল পার্লিং (১৯৩০-২০১৬) পেলেকে বলেছিলেন, ‘তোমার দ্বিতীয় গোলটা দেখে হাততালি দিতে মন চাইছিলো’।
ব্রাজিলের এক ক্রীড়া-সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন, ব্রাজিলের সেরা গোলকিপার কে? সালদাইয়া উত্তর দিলেন, ‘পেলে’।
চিলিতে ১৯৬২ বিশ্বকাপে চোটের কারণে কেবল দুই ম্যাচ খেলতে পেরেছিলেন পেলে। মেক্সিকোর বিপক্ষে জয়ের প্রথম ম্যাচে একটি গোল করেন, চেকোস্লোভাকিয়ার বিপক্ষে খেলতে গিয়ে চোট পান এবং বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে যান। সেবার ব্রাজিলকে চ্যাম্পিয়ন বানাতে নেতৃত্ব দেন গ্যারিঞ্চা (১৯৩৩-১৯৮৩)। ১৯৬৪ সালে যুক্তরাজ্যে পরের বিশ্বকাপে নির্মম ট্যাকলের (প্রতিপক্ষ থেকে বল কেড়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা) শিকার হন পেলে। চোট পেয়ে বিদায় নেন প্রথম রাউন্ড থেকেই, তার সঙ্গে ব্রাজিলও বিদায় নেয়।
এ আঘাত পেয়ে মেক্সিকোতে ১৯৭০ বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করাই অনিশ্চিত ছিল পেলের। তবে এ বিশ্বকাপেই ‘গোল অব দ্য সেঞ্চুরি’ তকমা পাওয়া পাসটি ছিল তার পায়ের। শতাব্দীর সেরা ফুটবলারের সিগনেচার পাস ছিল এটি। ইতালির বিপক্ষে সেই ফাইনাল ব্রাজিল ৪-১ গোলে জিতেছিল। এ ম্যাচে পেলেকে মার্কিং (বিপক্ষ দলের স্ট্রাইকার যেন বল না পায় তেমন সংঘবদ্ধ প্রতিরোধ) করেছিল ইতালির ডিফেন্ডার তারচিজিও বোরনিচ (১৯৩৯-২০২১)। তিনি বলেছিলেন, ‘ম্যাচের আগে ভেবেছিলাম সে (পেলে) আমাদের মতোই রক্তমাংসের কেউ। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম’।
সেবার মেক্সিকোতে বিশ্বকাপের আগে রাজনৈতিক কারণে বহিষ্কার হয়েছিলেন ব্রাজিল জাতীয় দলের কোচ জোয়াও সালদাইয়া (১৯১৭-১৯৯০)। ব্রাজিলের এক ক্রীড়া-সাংবাদিক তাকে প্রশ্ন করেছিলেন, ব্রাজিলের সেরা গোলকিপার কে?
সালদাইয়া উত্তর দিলেন, ‘পেলে’।
সেই ক্রীড়ালেখক আবার প্রশ্ন করেন, ওহ, তাহলে সেরা রাইটব্যাক?
এবারও উত্তর পাওয়া গেলো, ‘পেলে’।
দলের প্রায় অর্ধেক পজিশনে পেলের নাম বলার পর সালদাইয়া হেসে ফেললেন। বললেন, 'পেলে মাঠের যে কোনো অবস্থানে বিশ্বের সেরা ফুটবলার'।
মাঠের বাইরে পেলের জীবনটা সেলেকাওদের বিখ্যাত হলুদ শার্টের মতোই রঙিন ছিল। পেলের দুই পা যেন বিদ্যুৎ, মাধ্যাকর্ষণ এড়িয়ে বাতাসে উড়তো।
সান্তোস এফসি ফুটবল ক্লাব, ব্রাজিলের জাতীয় দল এবং নিউ ইয়র্ক কসমসের হয়ে মোট ৪০ ট্রফি জিতেছেন পেলে। তিনি ও ফরাসি ফুটবলার ফ্রাঞ্জ বেকেনবাউয়ার (১৯৪৫- ) মিলে ফুটবলের ভিত গড়েন যুক্তরাষ্ট্রে। উয়েফার সাবেক সভাপতি মিশেল প্লাতিনি একবার মন্তব্য করেছিলেন, ‘ফুটবলার পেলে ও মানুষ পেলে, কিন্তু পেলে যখন ফুটবল খেলেন তখন ঈশ্বর হয়ে উঠেন'।
ইতিহাসও সে সাক্ষ্য দেয়। ১৩৬৬ ম্যাচে ১২৮২ গোল, ব্রাজিলের ‘কালো মানিক’ যেন সেই রত্ন- তীক্ষ্ণ ধার, চকচকে এবং ত্রুটিহীন। ব্রাজিলের তিনবারের বিশ্বকাপ জয়ের প্রতিটি মাত্রায় নিখুঁত এবং ফুটবলের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ হিসেবে একা দাঁড়িয়ে ছিলেন।
মাঠের বাইরে পেলের জীবনটা সেলেকাওদের বিখ্যাত হলুদ শার্টের মতোই রঙিন ছিল। পেলের দুই পা যেন বিদ্যুৎ, মাধ্যাকর্ষণ এড়িয়ে বাতাসে উড়তো। ৮২ বছর বয়সে পেলের চলে যাওয়ায় ফুটবল হারিয়েছে ‘দ্য কিং’। এতদিন ধরে তাকে 'সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়' হিসেবে সমাদৃত করা হয়েছিল, কিন্তু কে আসলেই সর্বকালের সেরা? পেলে, ম্যারাডোনা, ক্রুইফ, মেসি নাকি রোনালদো!
এ প্রশ্নের উত্তর যেন দিয়েছেন নেদারল্যান্ডসের খেলোয়াড় ইয়োহান ক্রুইফ (১৯৪৭-২০১৬), তিনি পেলেকে এই বলে শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন- ‘পেলেই একমাত্র ফুটবলার যিনি যুক্তির সীমানা ছাড়িয়ে গেছেন’।
কিডজ ম্যাগাজিনে বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা [email protected] সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!