ভোরবেলা মা যখন ডাকলেন, তখন রুহানের ঘুম ভাঙতে চাইছিল না। মাথার ভেতর যেন তুলোর তৈরি একরাশ স্বপ্ন লেপ্টে ছিল।
Published : 05 Mar 2025, 02:08 AM
রুহান আজ খুব খুশি। সে এত খুশি যে, মনে হচ্ছে, যদি সে চাইত, তাহলে আকাশের চাঁদটাকে ছুঁয়ে আসতে পারত। কিন্তু চাঁদ ছোঁয়ার দরকার নেই, কারণ চাঁদ তো তার দিকেই তাকিয়ে আছে। আজ যে তার জীবনের এক বিশেষ দিন!
সে এবারই প্রথম রোজা রাখতে চায়। মা একটু হাসলেন, বাবা গম্ভীর মুখে তাকালেন। বাবা যখন গম্ভীর হন, তখন বোঝা যায়। তিনি ভেবেচিন্তে কথা বলবেন। “তুমি তো এখনো ছোট, রুহান,” বাবা বললেন। রুহান গাল ফুলিয়ে বলল, “ছোট কোথায়? আমার ক্লাসের মুনাও তো রোজা রাখে!”
মা হাসলেন। “তুমি যদি পারো, তাহলে চেষ্টা করতে পারো, কিন্তু রোজা মানে শুধু না খেয়ে থাকা নয়। তোমাকে ধৈর্য ধরতে হবে। ভালো কাজ করতে হবে। আর কাউকে কষ্ট যেন না দাও!” রুহান চোখ বড় বড় করে তাকাল। “আমি তো কাউকে কষ্ট দিই না, মা!” মা বললেন, “তাহলে তো ভালো কথা! দেখি, তুমি পারো কিনা!”
রুহানের মনে হলো, সে ঠিকই পারবে। কেন পারবে না? এটা তো একটা চ্যালেঞ্জ! সে রোজা রাখবে। আর মা-বাবাকে প্রমাণ করে দেখাবে যে, সে আর ছোটটি নেই। তার বুকের ভেতর রক্তের মতো নতুন একটা উত্তেজনা দৌড়াতে লাগল। রাতে চাঁদ ওঠার পর মা ডাকলেন, “চলো, মাগরিবের নামাজ পড়ো, তারপর ঘুমাতে হবে। সেহেরির জন্য উঠতে হবে কিন্তু!”
সেহেরি! আহা, কী রোমাঞ্চকর ব্যাপার! রাতের বেলা খাওয়া! এই যে রাতের বেলা সবাই ঘুমিয়ে থাকে, তখন সে উঠে খাবে, তারপরে ভোরের আকাশ দেখবে, এ এক নতুন আনন্দ! সে বিছানায় শুয়ে থাকল, ঘুম আসছিল না। মনে হচ্ছিল, কালকের দিনটা এক বিশাল অভিযান। সে একজন যোদ্ধা, যে নিজের ক্ষুধার বিরুদ্ধে লড়াই করবে।
মা ঘরে এসে হাসলেন। “এখনও ঘুমাচ্ছ না?” রুহান বললো, “মা, কাল আমি পুরোটা দিন রোজা রাখব!” মা আলতো করে তার মাথায় হাত রাখলেন। “সাহসী ছেলেটা আমার! দেখা যাক, কাল তোমার ধৈর্যের পরীক্ষা হয় কিনা!” রুহান চোখ বন্ধ করল। বাইরে রাতের আকাশ ঝলমল করছিল, আর তার মনে হচ্ছিল, এই রাত যেন এক নতুন অভিযানের শুরু।
ভোরবেলা মা যখন ডাকলেন, তখন রুহানের ঘুম ভাঙতে চাইছিল না। মাথার ভেতর যেন তুলোর তৈরি একরাশ স্বপ্ন লেপ্টে ছিল। কিন্তু মা যখন বললেন, “সেহেরির সময় শেষ হয়ে যাবে,” তখনই সে লাফিয়ে উঠল। সেহেরি খেতে খেতে তার মনে হলো, আহা, রোজা রাখার কী মজা! ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে খাওয়া। এ এক নতুন অভিজ্ঞতা! মা তার সামনে ডিম রাখলেন। একগ্লাস দুধ দিলেন। আর বাবার কণ্ঠে নরম সুর, “ধীরে খা, তাড়াহুড়ো করিস না।”
খাওয়া শেষ হলে বাবা ফজরের নামাজে দাঁড়ালেন, মা দাঁড়ালেন, রুহানও দাঁড়ালো। নামাজ শেষে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখল, আকাশ ফিকে হয়ে এসেছে। পাখিরা জেগে উঠছে, গাছের পাতার গায়ে ভোরের হাওয়া ছুঁয়ে যাচ্ছে। রুহান মনে মনে হাসল। আহা, কী সুন্দর একটা দিন! সে আজ রোজা রাখবে! কিন্তু সকালটা যতই মিষ্টি ছিল, দুপুরের গরমটা যেন ততটাই তীব্র।
সকাল বেলা সে খেলতে বেরিয়েছিল। বন্ধুরা ক্রিকেট খেলছিল। দুই ওভার ব্যাটিং করতেই যেন শরীর থেকে সব শক্তি ফুরিয়ে গেল। রোদটা এমন লাগছে, যেন সূর্য তার ওপর রেগে আছে! সে ঘরে ফিরে এলো। মা বললেন, “তুই একটু শুয়ে থাক, তাহলে বুঝবি না কেমন করে সময় চলে যাবে।”
রুহান বিছানায় শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ রাখল, তারপর আবার খুলল। সময় কি একটু নড়ল? না, মনে হচ্ছে, ঘড়ির কাঁটাগুলো ইচ্ছে করেই থেমে আছে! “মা, এখন কয়টা বাজে?” মা হাসলেন। “দুপুর একটা।” বাহ! একেবারে অসহ্য! কেবল একটা বাজে? আর কত সময় বাকি? সে আবার শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পর আবার বলল, “মা, এখন কয়টা?” মা এবার আর হাসলেন না। “একটা পাঁচ মিনিট!”
রুহানের মাথা ঘুরে গেল। আহা, কীভাবে সময় কাটবে? তখনই সে বারান্দায় গিয়ে বসল। বাইরের রোদে পথটা যেন আগুনের মতো গনগনে। হঠাৎ দেখল, পাশের বস্তির ছেলেটি রাস্তার ধারে বসে আছে। গায়ে ময়লা জামা, হাতে কিছু নেই। ছেলেটি বিস্ময়ভরা চোখে পাশের দোকানের খাবারের দিকে তাকিয়ে আছে। রুহান হঠাৎই নিজের ক্ষুধার কথা ভুলে গেল। তার মনে হলো, তার চেয়েও বেশি ক্ষুধার্ত তো এই ছেলেটি! তার হাতে খাবার নেই। তার কোনো ইফতারও নেই।
রুহান ক্ষুধার্ত ছিল, কিন্তু ছেলেটির দিকে তাকিয়ে তার ক্ষুধাটা যেন কোথায় মিলিয়ে গেল। রাস্তার ধারে বসে থাকা ছেলেটির চোখে যে অভিব্যক্তি। সেটা রুহানের মনটাকে নাড়া দিল। সে দোকানের কাচের ওপারে তাকিয়ে আছে। সেখানে জিলাপি, বেগুনি, সমুচা সাজানো আছে। কিন্তু তার জন্য কিছুই নেই। ছেলেটি তো কিনতে পারবে না।
রুহান দাঁড়িয়ে রইল। তার পেটে ক্ষুধা, গলায় তেষ্টা। কিন্তু ছেলেটির চেহারা দেখে মনে হলো, সে যেন আরও বেশি তৃষ্ণার্ত। সে দ্রুত ঘরে গেল। মা তখন ইফতারের জন্য রান্না করছেন। “মা,” রুহান ডাকলো। মা চমকে তাকালেন। “কী হয়েছে?” “আমি কিছু খাবার নিতে পারি?” মা অবাক হয়ে বললেন, “কেন? এখনো তো ইফতারের সময় হয়নি” রুহান বলল, “একটা ছেলেকে দিতে চাই। ওর কিছুই নেই, মা।”
মা একটু থামলেন। তারপর একটা প্লেটে খেজুর, কিছু মুড়ি, বেগুনি ভাজা, আলুর চপ, ছোলা, একটি আপেল দিয়ে বললেন, “যা, দিয়ে আয়।” রুহান প্লেট হাতে নিয়ে দৌড় দিলো। ছেলেটি তখনো রাস্তার ধারে বসে। ম্লান চোখে তাকিয়ে আছে। “ভাইয়া,” রুহান বলল, “এই নাও।” ছেলেটি তাকাল, তার চোখে বিস্ময়। যেন সে বিশ্বাসই করতে পারছে না। কেউ তাকে কিছু দিচ্ছে! সে লজ্জায় একটু ইতস্তত করল, তারপর ধীরে ধীরে প্লেটের দিকে হাত বাড়াল।
রুহান চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। দেখে, কীভাবে ছেলেটির চোখে এক অদ্ভুত আনন্দ ফুটে উঠছে।
ছেলেটি মৃদু স্বরে বলল, “ধন্যবাদ, ভাইয়া।” রুহান মাথা নাড়ল। সে হঠাৎই বুঝতে পারল, সত্যিকারের রোজা কী। শুধু না খেয়ে থাকা নয়। শুধু ধৈর্য ধরা নয়। সত্যিকারের রোজা হলো অন্যের কষ্ট বোঝা। তাদের কষ্ট ভাগ করে নেওয়া। সে হালকা একটা নিঃশ্বাস ফেলল। তার পেটে ক্ষুধা থাকলেও মনে হলো, আজ সে সত্যিকারের পরিপূর্ণতা পেয়েছে।
রুহান যখন ঘরে ফিরল, তখন সূর্য ঢলে পড়েছে। আকাশ লালচে, ইফতারের সময় ঘনিয়ে এসেছে। মা রান্নাঘরে ব্যস্ত। বাবা জায়নামাজে বসে দোয়া করছেন। ঘরে এক অদ্ভুত প্রশান্তি ছড়িয়ে আছে। সে চুপচাপ বসে থাকল। মনে হলো, আজকের দিনটা যেন অন্যরকম। সকাল থেকে এক অদ্ভুত উত্তেজনা ছিল। দুপুরে সেটা ধৈর্যের পরীক্ষায় পরিণত হলো। আর বিকেল আসতে সে যেন এক নতুন সত্য উপলব্ধি করল।
মা একটা বড় থালায় ইফতার সাজাচ্ছিলেন। খেজুর, মুড়ি, ছোলা, বেগুনি, ঠান্ডা শরবত, সবকিছু কী সুন্দর দেখাচ্ছে! মা তাকিয়ে বললেন, “কী রে, চুপচাপ বসে আছিস কেন?” রুহান মাথা নিচু করল। আসলে কী বলবে, বুঝতে পারছিল না। বাবা পাশে এসে বসলেন। “রোজাটা পারলি তো?” রুহান আস্তে করে মাথা নাড়ল। তারপর ধীরে ধীরে বলল, “বাবা, রোজা শুধু না খেয়ে থাকার নাম নয়, তাই না?” বাবা একটু অবাক হলেন। “কেন, তোর কী মনে হচ্ছে?”
রুহান একটু থামল, তারপর বলল, “আজ দুপুরে খুব কষ্ট হচ্ছিলো। মনে হচ্ছিল, সহ্য করতে পারব না। কিন্তু যখন দেখলাম, একটা ছেলে রাস্তার পাশে বসে আছে, না খেয়ে... তখন আমার নিজের ক্ষুধাটা ভুলে গেলাম। আমি ওকে খাবার দিলাম। আর তখনই বুঝলাম, রোজা মানে শুধু নিজের কষ্ট না, অন্যের কষ্ট বোঝাও।”
মা চুপচাপ শুনছিলেন। এবার হাসলেন। আলতো করে রুহানের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “আজ তুই রোজার সবচেয়ে বড় উপহার পেয়েছিস, বাবা।” “উপহার?” “হ্যাঁ,” বাবা বললেন। “রোজার উপহার হলো সংযম শেখা। ধৈর্য ধরা। আর সবচেয়ে বড় কথা, অন্যকে ভালোবাসা। যারা কষ্টে আছে, তাদের পাশে দাঁড়ানো। সেটা তুই নিজে থেকে শিখে গেছিস। এটা আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় আনন্দ।”
রুহান মৃদু হাসল। তখনই মসজিদের মাইকে আজানের শব্দ ভেসে এলো। মা খেজুর এগিয়ে দিলেন, বাবা গ্লাসভর্তি ঠান্ডা শরবত তুলে দিলেন। রুহান খেজুরটা মুখে দিল, ঠান্ডা শরবত গলায় নামালো। আহা! কী স্বাদ! এটাই তো রোজার আনন্দ, ত্যাগের পর পাওয়া এক অনন্য তৃপ্তি। সে মনে মনে হাসল। আজকের দিনটা সে কোনোদিন ভুলবে না। আজ সে শুধু রোজা রাখেনি, রোজার আসল অর্থও বুঝেছে। এটাই তার সবচেয়ে বড় উপহার!