হঠাৎ সাপটা তার চোখ দুটো মেলে ধরলো আর লেজটাও একটু নাড়লো। আমি ভয়ে চিৎকার করে উঠলাম।
Published : 16 Oct 2024, 12:41 PM
১৯৯৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী টনি মরিসনের লেখা ৮টি গল্পের বই নিয়ে সংকলন ‘অ্যা টনি মরিসন ট্রেজারি’, ২০২৩ সালে এটি প্রকাশ করে মার্কিন প্রকাশনী সংস্থা ‘সাইমন অ্যান্ড শুস্টার’। আজ প্রকাশিত হলো তার অনূদিত চতুর্থ পর্ব।
হ্রদের ধারের একটা কেবিনে বাস করতো পপি দাদু। প্রতি গরমের স্কুল ছুটিতে তার নাতি নাতনিরা তার কাছে এক মাসের জন্য বেড়াতে আসতো।
একবার গরমের সময় তার নাতি নেট তার কাছে বেড়াতে আসলো। একদিন বিকেলে তারা একটু মাছ ধরলো, একটু সাঁতার কাটলো এবং বুনো ব্ল্যাকবেরি ফল তুললো। তারপর দাদু তার জন্য রাতের সুস্বাদু খাবার তৈরি করলো।
খাবার শেষে তারা ব্ল্যাকবেরি খেতে খেতে গল্প করতে শুরু করলো। নেট বলল, দাদু আমি আর স্কুলে ফেরত যেতে চাই না। দাদু জিজ্ঞেস করলো, কেন তুমি আর স্কুলে যেতে চাও না? নাতি বলল, আমি তোমার এখানে থেকে যেতে চাই। দাদু বলল, সে তো তুমি প্রতি গরমের ছুটিতেই আসছো। আমরা সুন্দর সময় কাটাচ্ছি। আর তুমি প্রতিবারই স্কুলে ফিরে যাওয়ার জন্য উৎসাহী থাকো।
নাতি বলল, না আর যেতে চাই না। দাদু বলল, আমাকে বিষয়টা খুলে বলো তো, ঘটনাটা কী? পপি দাদুর সবচেয়ে প্রিয় নাতি নেট। তাই তিনি একটু চিন্তিত হয়ে পড়লেন। নাতি বলল, আমি খুব বেশি স্মার্ট না, আর আমার পরীক্ষার ফলাফলও ভীষণ খারাপ। দাদু নাতির দিকে গভীর দৃষ্টি দিয়ে দেখলো। তার কাছে মনে হলো, নেট একটু বেশিই দুঃখী। তাকে লজ্জিতও মনে হচ্ছিল।
সে তখন জিজ্ঞেস করলো, তুমি কি ঠিকঠাক তোমার পড়াশোনা আর বাড়ির কাজগুলো করছো না? নাতি বলল, তা করছি প্রায় সঠিকভাবেই। কিন্তু এতেও ফলাফল ভালো হচ্ছে না। দাদু বলল, ব্যাপার না, তুমি আমাকে সব খুলে বলো। নাতি বলল, বাবা বলেন, আমি নাকি অলস আর মা বলেন, আমি নাকি মনোযোগী না।
দাদু বলল, তাহলে আসলে কোনটা? নাতি বলল, আসলে দুটোই ঠিক। আমি পড়তে তো বসি, কিন্তু মন পড়ে থাকে অন্যখানে। আমার মনে হয় স্কুলের কাজ করার চেয়ে অন্য যেকোনো কিছু করাটা বেশি মজার।
দাদু বলল, আচ্ছা। তারপর উঠে গিয়ে আলমারি থেকে এক জোড়া সবুজ রঙের চকচকে জুতো বের করে আনলো। তারপর সেগুলো পরে ফেলল। সেটা দেখে নাতি বলল, তুমি কি এখন বাইরে যাবে? দাদু বলল, না এগুলো আমার স্মরণীয় জুতো। এগুলো আমাকে সবসময় একটা ঘটনা মনে করিয়ে দেয়।
নাতি বলল, সেটা কীভাবে? দাদু বলল, যেমন এগুলো এখন আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে মনোযোগী হওয়ার মানে হচ্ছে নিজেকে নিয়ে আরও একটু বেশি ভাবা। নাতি বলল, বুঝলাম না দাদু। তারপর দাদু খাবার টেবিলটা পরিষ্কার করে নাতির মুখোমুখি বসে আবার গল্প করতে শুরু করলো।
একদিন সন্ধ্যায় গাড়ি চালিয়ে আমি ঘাটে মাছ ধরতে গিয়েছিলাম। মাছ ধরার জন্য আবহাওয়াটা খুব উপযুক্ত ছিল। সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে আসার আগেই বেশকিছু মাছ ধরে ফেললাম। তারপর মাছগুলো সুন্দরভাবে প্যাকেট করে গাড়ির দিয়ে হাঁটা দিলাম। গাড়ির কাছে পৌঁছে দেখলাম, কী যেন একটা গাড়ির পেছনের চাকায় চাপা পড়ে আছে। আমি নিচু হয়ে সেটা দেখার চেষ্টা করলাম।
এটা কোন গাছের শাখা কিংবা লতা ছিল না। সেটা আসলে একটা সবুজ রঙের সাপ ছিল। আমি মনে হয় পার্কিং করতে গিয়ে সাপটাক চাপা দিয়েছিলাম। আমি গাড়ি থেকে আমার ফ্ল্যাশ লাইটটা নিয়ে ভালোভাবে দেখলাম। হঠাৎ সাপটা তার চোখ দুটো মেলে ধরলো আর যেন লেজটাও একটু নাড়লো। আমি ভয়ে চিৎকার করে উঠলাম।
তারপর আর সাপটা নড়ল না। আমি ভালোভাবে দেখার জন্য একটু ঝুঁকলাম। ঠিক তখন সাপটা কথা বলে উঠলো, তুমি আমাকে এখানেই ফেলে যাবে কুকুরের মতো মারা যাওয়ার জন্য? আমি বললাম, এটা আসলে ভুল হয়ে গেছে, আমি মোটেও তোমাকে চাপা দিতে চাইনি। সেটা ঠিক আছে, কিন্তু তুমি তো দেখতেই পাচ্ছো, তুমি চাপা দিয়েছো। আমি কি তোমার কোন ক্ষতি করেছিলাম? আমি আমার মতো রাস্তা পার হচ্ছিলাম, আর তুমি এসে আমাকে চাপা দিলে এবং প্রায় মেরেই ফেলেছিলে। এখন দেখা যাচ্ছে যেহেতু আমাকে পুরোপুরি মেরে ফেলতে পারোনি, তাই এখানে ফেলে যাচ্ছো পড়ে পড়ে মরার জন্য।
আমি বললাম, দেখি আমি তোমাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি। তুমি যদি নড়াচড়া না করো, তাহলে আমি আমার গাড়িটা একটু সরাতে পারি। সাপটা বলল, এইবার তোমার কথা ঠিক আছে।
তারপর আমি একটু দ্বিধায় পড়ে গেলাম। আমার দাঁড়িয়ে থাকা দেখে সাপটা বলল, কী ব্যাপার! আমি বললাম, আসলে তুমি তো একটা সাপ আর বিষধরও বটে। আমার কথা শুনে সাপটা খেঁকিয়ে উঠলো, তো তুমি আমাকে এখন বিষদাঁতের জন্য দোষারোপ করছো! বিষদাঁত ছাড়া আমি কীভাবে নিজের আত্মরক্ষা করতাম বলো। যে কেউ তখন আমার ক্ষতি করে ফেলতো!
আমার হাতও নেই যে আমি কারো সঙ্গে মারামারি করতে পারবো। আমার পা-ও নেই তো তোমার মতো লাফিয়ে লাফিয়ে পালাতে পারবো। আমি কোন গর্জনও করতে পারি না যেটা শুনে কেউ পালিয়ে যাবে। তুমি যদি আরও ভালোভাবে খেয়াল করো তাহলে দেখবে আমার পাখাও নেই যে আমি উড়ে যেতে পারবো। এখন নিশ্চয়ই তুমি বুঝতে পারছো বিষদাঁতগুলো আমার জন্য কতটা জরুরি।
আমি বললাম, সবই তো বুঝলাম কিন্তু আমি কীভাবে বুঝবো যে তুমি আমাকে কামড় দেবে না। সাপটা বলল, তুমি আমার জীবন বাঁচাচ্ছো, আমি তোমাকে কেন কামড় দিতে যাবো! তুমি তো আর আমার কোন শত্রু নও, বরং তুমি আমার জীবন রক্ষাকারী। আমি বললাম, তবুও, তুমি যদি তোমার মত বদলাও, যেমন আমি ক্ষণে ক্ষণে বদলাই।
সাপটি বলল, তুমি শুধু শুধু কথা বাড়াচ্ছো যাতে তুমি আমাকে এই অবস্থায় ফেলে যেতে পারো। আমি বললাম, আসলে আমি নিজেকে কোন বিপদে ফেলতে চাই না। সাপটি বলল, কী বললে তুমি? তুমি তোমার বিপদ নিয়ে চিন্তিত। আরে বাপু বিপদে যদি কেউ পড়ে থাকে সেটা হচ্ছি আমি। একবার ভালো করে তাকিয়ে দেখো। আমি আধমরা হয়ে এখানে পড়ে আছি।
বললাম, আমি জানি, আমি জানি, খুবই দুঃখিত। সাপটা বলল, তুমি আমাকে সাহায্য করার মতো যথেষ্ট দুঃখিত নও। আমি বললাম, ঠিক আছে, তুমি যদি প্রতিজ্ঞা করো যে আমাকে কামড় দেবে না, তাহলে আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি। সাপটি বলল, ঠিক আছে আমি রাজি। আমি বললাম, মনে রেখো তুমি কিন্তু প্রতিজ্ঞা করলে! সাপটি বলল, আমি এই মুহূর্তে প্রতিজ্ঞা করছি যে আমি কখনও তোমাকে কামড় দেবার কথা চিন্তাও করবো না। আমি বললাম, ঠিক আছে আমি তোমাকে বিশ্বাস করলাম। তারপর আমি গাড়িতে উঠে ইঞ্জিন চালু করলাম। অত্যন্ত ধীরগতিতে সেটাকে একটু সামনের দিকে নিলাম। মনে মনে বললাম, আশা করি সাপটা মুক্তি পেয়েছে।
সাপটা গাড়ির চাকার নিচ থেকে বেরিয়ে বলল, যাক বাবা বাঁচা গেল। সে একটু গড়িয়ে নিয়ে দেখে নিল তার শরীরটা অক্ষত আছে কিনা। তারপর সে গাড়ির দরজার কাছে এসে বলল, চমৎকার বন্ধু চমৎকার। আমি বললাম, ঠিক আছে, আমি তাহলে এখন আসি। সাপটা বলল, যাবে মানে, কোথায় যাবে? আমি বললাম, কেন বাসায় যাবো!
তখন সাপটা বলল, আমি জানতাম তুমি একটা ভাঁড়। আমি তোমাকে প্রতিজ্ঞা করেছি আমি ভালো হয়ে থাকবো, আর তুমি আমাকে ফেলে চলে যাচ্ছো! আমি বললাম, আমিতো করেছি যেটা প্রতিজ্ঞা করেছিলাম। সে আমার গাড়ির জানালার কাছে এসে একটা নিশ্বাস ফেলল, আমি তোমার গাড়ির টায়ারের নিচে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকলাম। আর তুমি আমাকে তোমার বাসায় নিয়ে একটু সেবা শুশ্রূষা করবে না?
আমি অবাক হয়ে বললাম, তোমাকে বাসায় নিয়ে যাবো! সাপটা বলল, হ্যাঁ, নাকি তুমি যাদেরকে চাপা দাও তাদেরকে এভাবেই রাস্তায় ফেলে পালিয়ে যাও! আমি বললাম, কিন্তু? সে বলল, কিন্তু কি! আমি তো প্রতিজ্ঞা করেছি যে আমি কখনই তোমাকে কামড়ানোর কথা ভাববো না। আমি কি এতোটাই বোকা, যে আমাকে বাঁচালো তার গায়েই বিষ ঢেলে দেব! আমি অনেক ভেবেচিন্তে তাকে তুলে নিয়ে গাড়ির সিটে শুইয়ে দিলাম। বাসায় পৌঁছে তাকে এক বাটি দুধ খেতে দিলাম। সে পুরোটুকু খেয়ে শেষ করল।
পরদিন আমি তার ক্ষত স্থানটা ব্যান্ডেজ করে দিলাম। সে খুব খুশি হল। সেদিন রাতে খাওয়া দাওয়ার পর সে জিজ্ঞেস করলো, সে আরেকটা রাত থাকতে পারে কিনা? আমি বললাম, ঠিক আছে, থাকো। আমি মনে মনে ভাবলাম, সে তো প্রতিজ্ঞা করেছে যে আমাকে কামড়াবে না। এটা ভাবতে ভাবতেই আমি কাছের গ্রামের বাজারের দিকে গেলাম। ফিরে এসে ঘরের দরজা খুলে দেখি সাপটা আমার বিছানায় শুয়ে আছে।
আমাকে দেখেই সে বলল, কোথায় ছিলে তুমি সারাদিন। আমি বললাম, দোকানে গিয়েছিলাম। সে বলল, আমি ভাবলাম, তুমি বোধহয় আমাকে ফেলে চলে গেছ। আমি বললাম, আমি মোটেও সেটা করবো না, কারণ আমরা দুজন বন্ধু। সে বলল, ঠিক তাই, তুমিই আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু। আমি বললাম, আমরা একে অপরকে বিশ্বাস করি, তাই নয় কি? সে বলল, আমরা সারা জীবনের বন্ধু।
আমি বললাম, আমরা যা বলি তা-ই করি, ঠিক না? সে বলল, অবশ্যই। তারপর আমি রাতের খাবার তৈরি করলাম। এভাবেই দিন কেটে যেতে লাগলো। কিন্তু দিনে দিনে সাপটাকে বিরক্ত এবং অবিশ্রান্ত মনে হচ্ছিল। একদিন রাতে সে বলল, তুমি একটা টিভি কিনো না কেন? আমি বললাম, আমি শান্তিপ্রিয় মানুষ। সে বলল, তোমার এমনকি একটা রেডিও পর্যন্ত নেই। আমি বললাম, হ্যাঁ।
সে বলল, তুমি একাকিত্ব অনুভব করো না? আমি বললাম, না আমি আমার নিজের সঙ্গ উপভোগ করি। সে বলল, তাই নাকি? তারপর সে স্টোভের কাছে একটা মাদুরের উপর শুয়ে পড়লো। আমার ঘুম আসছিল না, তাই বাইরে এসে বসলাম। যখন আমি ঘরের মধ্যে ফিরলাম তখন দেখলাম সাপটা আমার বিছানার কাছাকাছি সরে এসে ঘুমাচ্ছে। তারপর আমিও শুয়ে পড়লাম।
পরদিন সকালে প্রচণ্ড ব্যথায় আমার ঘুম ভেঙে গেলো। আমি বিছানায় উঠে বসলাম। তারপর দেখলাম আমার ডান হাতের কনুইয়ের নিচে দুটো ছিদ্র। দেখলাম সাপটা আমার পাশেই কম্বলের উপর শুয়ে আছে। তার বিষদাঁতগুলো চকচক করছে। আমি চিৎকার করে উঠলাম, মিথ্যুক! তুমি বলেছিলে আমাকে কামড়াবে না। তাহলে তুমি কেন, কেন তোমার প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করলে?
সাপটা তার কাঁটাচামচের মতো জিহ্বা বের করে হিসহিস শব্দ করে বলল, তুমি নিশ্চয়ই জানতে যে আমি একটা সাপ, আর সাপের স্বভাবই হচ্ছে কামড়ানো।
গল্পটা শেষ করে পপি তার নাতি নেটের দিকে তাকিয়ে হাসলো। নাতি বলল, তারপর কী হলো? সাপ তোমাকে কামড় দিল, কিন্তু তুমি মরলে না কীভাবে? পপি বলল, তুমি দেখতেই পাচ্ছো, সাপের কামড় খেয়েও আমি মরিনি। তোমার মনে আছে, সাপ বলেছিল, সে আমাকে কামড়ানোর কথা ভাববেও না। সে কিন্তু বলেনি যে সে আমাকে কামড়াবে না। তাই আমি পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলাম। তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে, আমি একদিন বাজারে গিয়েছিলাম। সেদিনই আমি দোকান থেকে সাপে কাটার ওষুধ নিয়ে এসেছিলাম।
তখন নাতি বলল, এবার বুঝতে পারলাম, তুমি কীভাবে নিজেকে বাঁচিয়েছিলে। পপি বলল, আমি মনোযোগ দিয়ে সাপের কথা শুনেছিলাম, তাই একটা বিকল্প তৈরি করে রেখেছিলাম। তারপর পপি বাতির তেজ বাড়িয়ে দিয়ে টেবিলের উপর তার পা দুটো মেলে বসলো। তখন নেট তার দাদুর স্মরণীয় জুতো জোড়া দেখলো। সেগুলো সবচেয়ে নরম, উজ্জ্বল সবুজ রঙের সাপের চামড়া দিয়ে তৈরি।