বনের ভেতর বনরক্ষী ও মৌয়ালদের গমনাগমনের সূক্ষ্ম চিহ্ন লেগে থাকা পথহীন পথে হাস্য কোলাহলে চার কিশোর অভিযাত্রী এগিয়ে যেতে থাকে।
Published : 18 Mar 2025, 11:00 AM
চারজনের মধ্যে মিঠু অন্যদের চেয়ে এক ক্লাস নিচে, অর্থাৎ ক্লাস সেভেনে পড়লেও বয়সের হিসাবে সবাই প্রায় সমবয়সি। কেউ ‘এই পিচ্চি’ বলে সম্বোধন করলে এখন তাদের আত্মসম্মানে লাগে। তিনজনেরই শরীর-স্বাস্থ্য ভালো। সবার মধ্যে মিঠুর স্বাস্থ্য একটু বেশিই ভালো বলা যায়। স্কুলের হ্যাংলা-পাতলা ছেলেমেয়েরা তাকে প্রায়ই মিঠু না ডেকে ‘মোটু’ বলে ডাকে। কারও কারও সাথে এসব নিয়ে মাঝে মাঝে মিঠুর ঝগড়াও হয়ে যায়।
ইমরান আর মিঠু একই স্কুলে পড়ে। একসময় দুজন এক ক্লাসেই পড়তো। গতবারের আগেরবার মিঠু সিক্সের বার্ষিক পরীক্ষায় খারাপ রেজাল্ট করে এক ক্লাস নিচে নেমে গেছে। একই বাড়ির বলে দুজনের বেড়ে ওঠা, খেলাধুলা ও স্কুলে আসা-যাওয়াও একসাথে। তবে মিঠুর জীবনে ইমরান এক অপরিহার্য বন্ধু হলেও ইমরানের ভালো বন্ধুত্ব তার চাচাতো ভাই জিসান এবং পাশের বাড়ির আদনানের সাথে। এই দুজনের সঙ্গলাভের আশায় সবসময় সে মুখিয়ে থাকে।
পরিবারের বড়দের মোবাইলে প্রায়ই কথা হয়। কিন্তু একসাথে ঘুরে বেড়ানো, আড্ডা দেওয়া আর গল্প করার তৃষ্ণায়, জিসান ও আদনান কবে গ্রামে বেড়াতে আসবে, ইমরান সারাবছর সেই অপেক্ষায় থাকে। গত দুবছর করোনাভাইরাস মহামারীতে ওরা কেউ গ্রামে আসতে না পারায়, ইমরানের তৃষ্ণার্ত মনের অপেক্ষা দীর্ঘায়িত হয়ে কাতরতা বাড়িয়ে দিয়েছিল কয়েকগুণ। এই ঈদে দুজনকে একসাথে পেয়ে ইমরানের খুশির মাত্রা তাই আকাশ ছুঁয়েছে।
এই দীর্ঘ অদেখা সময়ে শারীরিক পরিবর্তনও হয়েছে তাদের। জিসান লম্বায় মাথার দিক থেকে সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে অনেকটা। শরীরও পুষ্ট হয়েছে। বাকিদের চেয়ে এখন ওকে দুই-তিন বছরের বড় দেখায়। আদনানের পরিবর্তনটা তেমনভাবে চোখে না লাগলেও নাকের উপর একটা চশমা পরে ওর গোলগাল চেহারায় একটা মাস্টার মশাই মাস্টার মশাই ভাব এসেছে।
বাড়িতে আসার পর থেকেই ইমরান তার জমে থাকা বিভিন্ন বাহাদুরির গল্প বলে ও কর্মকাণ্ড দেখিয়ে জিসান আর আদনানকে মুগ্ধ করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। মিঠু উপস্থিত থাকলে সহযোগী হিসেবে ইমরানের সেসব গল্প ও কর্মকাণ্ডে সম্মতিসূচক সাক্ষ্য দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু স্বভাবজাত সারল্যতায় মাঝেমধ্যেই গোল বাঁধিয়ে ফেলে।
রাস্তার পাশের গাছের ছায়ার দৈর্ঘ্য দেখে বোঝা যায়, সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়ছে। এতক্ষণ ধীরলয়ে দক্ষিণ থেকে উত্তরে উড়ে বেড়ানো মেঘগুলো একটু একটু করে ঘন হয়ে এসেছে। সন্তর্পণে কিশোরদলটি খালের ওপর বনরক্ষীদের পারাপারের জন্য তৈরি কাঠের সাঁকোটি পার হয়ে যায়। একটু এগিয়ে গিয়ে সুন্দরবনের ভেতরে প্রবেশ করার পর, আনন্দে একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে উল্লাস করতে থাকে।
তবে তাদের সেসব উল্লসিত উদযাপন দেখে ইমরানের খুশিটাই সবচেয়ে বেশি বলে মনে হয়। গতবারের ব্যর্থতা মুছে সে এবার নিজের চেষ্টায় বন্ধুদের নিয়ে সুন্দরবনে ঢুকতে পেরেছে বলে গর্বে তার বুক ভরে যায়। ব্যর্থতার পর জয়ের আনন্দ এভাবেই বুঝি উল্লাসের বাঁধ ভেঙে দেয়। অন্যদেরও খুশির সীমা থাকে না। বিশেষ করে আদনান ও জিসানের চোখে বইয়ের পাতা থেকে সুন্দরবন যখন বাস্তব হয়ে ধরা দেয়, তখন একটা নতুন পৃথিবী উজ্জ্বল আলো নিয়ে তাদের চোখে-মুখে উদ্ভাসিত হয়। ফিরে গিয়ে স্কুলের বন্ধুদের কাছে এই রোমাঞ্চকর অভিযানের গল্প করতে পারার কথা ভেবে পুলকিত হয়।
ছবি তোলার জন্য পকেট থেকে মোবাইলটা ইতোমধ্যেই হাতে উঠে এসেছে। এগিয়ে যেতে যেতে বিভিন্ন গাছের সাথে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় চারজনই আবারও ছবি তুলতে শুরু করে। ছোট-বড় ঘাস আর গাছঘন এই সবুজ অরণ্যে বড়দের কোনো বিধিনিষেধ নেই। ওদিকে যেও না, এটা করো না, ওটা ধরো না- হুকুম জারি নেই। নিজেরা নিজেদের মতো করে দুচোখ ভরে সব দেখতে থাকে, ধরতে থাকে, করতে থাকে। বইয়ে পড়া, ইন্টারনেটে ও সিনেমায় দেখা বিভিন্ন গাছ, পাখি ও জীবজন্তু দেখে দেখে একেকজন একেকটার নাম বলে চিৎকার করতে থাকে।
কোনোটার নাম নিয়ে সন্দেহ দেখা দিলে, একেকজন তার একেকটা নাম বলে। নিশ্চিত হতে না পারলে সেসব নাম নিয়ে চার বন্ধু তর্কে মাতে। মাঝেমাঝে অবশ্য স্বমহিমায় নেতা হয়ে উঠা ইমরান নিজের নেতৃত্ব ফলাতে বাকিদের ওপর দু-একটা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। কিন্তু নিষেধাজ্ঞায় তেমন কোনো জোর থাকে না বলে অথবা না মানলেও কোনো শাস্তির মধ্যে পড়তে হবে না বলে, সেসবের তেমন কোনো তোয়াক্কা কেউ করে না। নিঃশব্দ অরণ্যে হরেক রকম পাখি ও প্রাণিদের কোলাহলে মোহমুগ্ধ চার কিশোর, সবুজের মাঝে নিজেরাও পাখির মতো ডানা মেলে।
বনের ভেতর বনরক্ষী ও মৌয়ালদের গমনাগমনের সূক্ষ্ম চিহ্ন লেগে থাকা পথহীন পথে হাস্য কোলাহলে চার কিশোর অভিযাত্রী এগিয়ে যেতে থাকে। হঠাৎ এক অতি পরিচিত প্রাণীর ডাক শুনতে পেয়ে সামনে থাকা জিসান দাঁড়িয়ে পড়ে। অন্যদের উদ্দেশ করে ‘এই শোন, ওইটা কুকুরের ডাক না! এখানে কুকুরও আছে নাকি!’ বলে কান পাতে।
চারজনই পরপর কয়েকবার কুকুরের ডাকটা শুনতে পায়। ‘এইখানে এত এত প্রাণী আছে, কুকুর থাকা আর অস্বাভাবিক কি! থাকতেই পারে।’ জিসানের কথার পিঠে কথাটা বলে আদনান। ‘এখানকার কুকুর কি আমাদের ভোলার চেয়েও বড়?’ -মিঠুর এমন প্রশ্নে বাকি তিনজনই ফিক করে হেসে দেয়। ‘আয় সামনে গিয়ে তোকে দেখাই’-হাসতে হাসতেই মিঠুকে কথাটা বলে ইমরান, আর সত্যি সত্যি সে কুকুরের ডাক লক্ষ্য করে এগিয়ে যেতে থাকে।
বাকিরাও ইমরানের অনুগামী হয়। কিন্তু কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে তারা যা দেখে, তাতে চারজনেরই চোখ গোল গোল হয়ে ওঠে। অবাক বিস্ময়ে ও আনন্দের আতিশয্যে চারজন নিজেদের মধ্যে নিঃশব্দ দৃষ্টিবিনিময় করে। একটা হরিণ তাদের দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে এবং কুকুরের মতো শব্দ করে ডেকে যাচ্ছে। হরিণটা দেখে আদনান চিনতে পারে। ফিসফিস করে উচ্চারণ করে- ‘এটা মায়া হরিণ!’
হরিণটা আদনানের কথা শুনতে পেয়েছে কিনা বুঝা যায় না। কিন্তু সে চার কিশোরের দিকে মুখ ঘুরিয়ে তাকায়। স্নিগ্ধ-চঞ্চল মায়াময় চাহনি। কারও দিকে নির্দিষ্টভাবে না তাকিয়েও এক পলকেই হরিণটি তার নিজের স্বভাবের মতো চঞ্চল চার কিশোরের মন কেড়ে নেয়। নামের সত্যতা প্রমাণ করে কিশোরদের মনে মায়া ধরায়। হঠাৎ গাছ থেকে একটা বানর চিঁ চিঁ শব্দে ডেকে উঠলে, হরিণটি চকিত এদিক-ওদিক তাকিয়ে পেছন ঘুরে এক ছুট লাগায়।
এই বানরটি আসলে অনেকক্ষণ আগে থেকেই মাথার ওপর দিয়ে এক গাছ থেকে আরেক গাছে লাফিয়ে লাফিয়ে অগোচরে এই অভিযাত্রী দলকে অনুসরণ করে আসছিল। সুন্দরবনের আরেক সুন্দর সম্পর্ক হলো হরিণের সাথে বানরের এই চিরমধুর বন্ধুত্ব। গাছের ডালে ডালে চলাচল করা বানর ওপর থেকে কোনো শিকারিকে দেখতে পেলে অথবা মাটিতে হরিণের জন্য কোনো বিপদের আঁচ পেলেই, পরিচিত শব্দ দিয়ে হরিণকে সেটা জানিয়ে দেয় বা সতর্ক করে দেয়।
এখানেও তাই ঘটেছে। বানরের সতর্কবার্তা পেয়ে হরিণটি ছুটে চলে যায়। কিন্তু চঞ্চল কিশোরের দলও বসে থাকে না। তারা হরিণের চলে যাওয়ার পথ ধরে তার পেছন পেছন ধাওয়া করে। হরিণের গতির সাথে পাল্লা দিয়ে দ্রুত গতিতে এগিয়ে যেতে থাকে। তাদের পায়ের নিচে লেপ্টে যেতে থাকে ঘন ঘাস, ছোট ছোট চারাগাছ, লতা-পাতা-গুল্ম ও শামুকসহ আরও কত কী!
মায়া হরিণের মায়ায় পড়ে তাকে আরও একবার দেখার লোভে এগিয়ে যেতে থাকা কিশোরদলের সেদিকে কোনো তোয়াক্কা নেই। দিক-বেদিকের জ্ঞান নেই। পথ হারানোর ভয় নেই। কিন্তু এই ভয় না থাকাটাই এক সময় তাদের মৃত্যুভয়ের দিকে নিয়ে যায়।
চলবে...