অনূদিত গল্প
Published : 29 Apr 2025, 12:28 AM
জাপানের অন্যতম খ্যাতিমান ঔপন্যাসিক ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা (১৮৯৯- ১৯৭২)। তিনি ওসাকায় জন্ম নেন। ১৯৬৮ সালে তিনি প্রথম জাপানি লেখক হিসেবে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। কাওয়াবাতা স্কুলজীবনেই প্রথম গল্প প্রকাশ করেন এবং ১৯২৪ সালে টোকিও ইম্পেরিয়াল ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতক পাশ করেন।
কাওয়াবাতা বেশকিছু উপন্যাস লিখেছেন, যার মধ্যে ‘স্নো কান্ট্রি’ (১৯৫৬) তার খ্যাতি অমর করে তোলে। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে ‘থাউজ্যান্ড ক্রেইনস’ (১৯৫৯), ‘দ্য সাউন্ড অফ দ্য মাউন্টেন’ (১৯৭০), ‘দ্য মাস্টার অব গো’ (১৯৭২) এবং ‘বিউটি অ্যান্ড স্যাডনেস’ (১৯৭৫)। তিনি দীর্ঘদিন জাপানের পিইএন ক্লাবের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং ১৯৫৯ সালে জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টে গ্যোটে মেডেল পুরস্কার পান। ১৯৭২ সালে মারা যান এ কীর্তিমান সাহিত্যিক।
টালির ছাদঘেরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাচীর ধরে হেঁটে যেতে যেতে আমি একপাশে ঘুরে এগিয়ে গেলাম উপরের স্কুলের দিকে। স্কুলের খেলার মাঠ ঘেরা সাদা বোর্ডের বেড়ার পেছনে, কালো চেরিগাছের নিচে ঘন ঝোপঝাড়ের ভেতর থেকে একটি পোকা নিজ সুরে ডেকে যাচ্ছিল। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো খুব ধীর পায়ে তার দিকে হাঁটতে লাগলাম, যেন সেই শব্দটিকে ছেড়ে যেতেই মন চাইছিল না। তাই ডানদিকে মোড় নিলাম, যাতে খেলার মাঠটি পেছনে না পড়ে।
তারপর যখন বামদিকে ঘুরলাম, বেড়ার জায়গায় দেখা দিলো আরেকটি ঢালু জায়গা, যেখানে কমলাগাছ রোপণ করা ছিল। ঠিক কোণায় এসে আমি বিস্ময়ে চমকে উঠলাম। সামনে যা দেখছিলাম তা দেখে চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠল, আর আমি ছোট ছোট কদমে দ্রুত সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম।
ঢালের নিচে দুলছিল রঙ-বেরঙের নয়নাভিরাম একগুচ্ছ ফানুস, যেমনটা দেখা যায় কোনো দূর গ্রামের উৎসবে। সামনে না গিয়েই বুঝে ফেললাম, ওরা একদল বাচ্চা ছেলেমেয়ে, যারা ঝোপের ভেতর পোকা ধরার খেলায় মত্ত। আনুমানিক গোটা বিশেক ফানুস ছিল সেখানে। শুধু যে লাল, গোলাপি, নীল, সবুজ, বেগুনি আর হলুদ ফানুস ছিল তা নয়, একটি ফানুস একসঙ্গে পাঁচটি রঙে জ্বলছিল।
এমনকি কিছু কিছু মোড়ের দোকান থেকে কেনা লাল রঙের ফানুসও ছিল। তবে বেশির ভাগ ফানুসই ছিল বাচ্চাদের হাতে তৈরি চৌকো ফানুস, ভালোবাসা আর মমতা মিশিয়ে বানানো। দোলায়িত ফানুস, আর এই নির্জন ঢালে শিশুদের এই যূথবদ্ধ হওয়া— এটা নিশ্চয়ই কোন রূপকথার দৃশ্য ছিল বৈকি?
কোনো এক রাতে এই ঢালে পাড়ার একটি ছেলে একটি পোকার গান শুনেছিল। পরের রাতে সে একটি লাল ফানুস কিনে আবার এসেছিল সেই পোকাটি খুঁজতে। তার পরের রাতে আরেকটা বাচ্চা এলো। নতুন ছেলেটির ফানুস কেনার সামর্থ্য ছিল না। সে একটি ছোট কার্টনের সামনে ও পেছনের অংশ কেটে তার ওপর কাগজ লাগিয়ে নিচে একটি মোমবাতি রাখল, আর ওপর দিকে একটি সুতো বেঁধে তৈরি করল নিজের ফানুস।
এভাবে শিশুর সংখ্যা পাঁচে পৌঁছাল, পরে সাতজনে দাঁড়াল। তারা শিখে ফেলল কীভাবে কাটা কার্টনের জানালায় লাগানো কাগজে রঙ করতে হয়, আর তাতে ছবি আঁকতে হয়। তারপর এই বিজ্ঞ শিশুশিল্পীরা কার্টনে গোল, তিনকোনা, আর হীরে পাতা আকৃতির ছিদ্র কেটে, প্রতিটি ছোট জানালাকে আলাদা রঙে রাঙিয়ে, লাল আর সবুজ রঙের বৃত্ত আর হীরের আকৃতিতে তৈরি করল অনন্য এক শিল্পশৈলী।
লাল ফানুস হাতে ছেলেটি তার ফানুসটি ছুঁড়ে ফেলে দিল—কারণ সেটা দেখতে দোকানে কেনা যায় এমন পানসে বস্তুর মতো মনে হলো। আর যে ছেলেটি নিজেই ফানুস বানিয়েছিল, সেও তারটা ফেলে দিল—কারণ তার নকশাটা ছিল খুব সাদামাটা। আগের রাতের হাতে থাকা আলোর সেই নকশা পরদিন সকালে এসে আর তৃপ্তি দিচ্ছিল না। প্রতিদিন কার্ডবোর্ড, কাগজ, তুলি, কাচি, পকেট ছুরি আর আঠা দিয়ে বাচ্চারা তাদের মনের ভাবনা আর হৃদয়ের ছোঁয়ায় বানিয়ে চলেছিল নতুন নতুন ফানুস।
“আমার ফানুসটা দেখো! সব চেয়ে অনন্য সুন্দর হবে !”—এই প্রত্যাশা নিয়েই তারা প্রতিটি রাতে বেরিয়ে পড়ত পোকা ধরার অভিযানে। এই ছিল সেই বিশজন শিশু আর তাদের নয়নাভিরাম ফানুস, যারা এখন আমার চোখের সামনে।
চোখ ছানাবড়া করে আমি তাদের পাশে দাঁড়িয়ে রইলাম। শুধু চৌকো ফানুসগুলোতেই ছিল পুরনো দিনের নকশা আর ফুলের ছাপ তা না, বরং যারা সেগুলো বানিয়েছিল সেইসব ফানুসে কাটাকাটা বর্ণমালার হরফে লেখা ছিল তাদের নাম। আঁকাজোকা লাল ফানুসের থেকে একেবারেই আলাদা ছিল অন্য ফানুসগুলো, মোটা কাটাছেঁড়া কার্ডবোর্ড দিয়ে তৈরি। জানালার কাগজে আঁকা ছিল নকশা, মোমবাতির আলো ঠিক যেন সেই ছবি আর রঙ থেকেই নির্গত হচ্ছে বলে মনে হতো।
ফানুসগুলো ঝোপঝাড়ের ছায়াগুলোকে ফুটিয়ে তুলছিল যেন অন্ধকারের আলো দিয়ে। শিশুরা গভীর মনোযোগে ঝুঁকে পড়ছিল ঢালে, যেখানেই তারা কোনো পোকার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিল।
“ঘাসফড়িং চাই কারো?”
অন্যদের থেকে প্রায় ত্রিশ ফুট দূরে একঝাঁক ঝোপের দিকে তাকিয়ে থাকা একটি ছেলে হঠাৎ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠল।
“হ্যাঁ! আমাকে দাও!”
ছয়-সাতজন শিশু দৌড়ে এলো। যে ছেলেটি ঘাসফড়িংটা পেয়েছে তার পেছনে ভিড় করে তারা ঝোপের দিকে তাকাতে লাগল। ছেলেটি তাদের প্রসারিত হাত সরিয়ে দিয়ে দুই হাত মেলে দাঁড়িয়ে রইল, যেন সে ঝোপটাকে পাহারা দিচ্ছে যেখানে পোকাটি রয়েছে। ডান হাতে ফানুস নাড়তে নাড়তে সে আবার হাক দিল অন্যদের—
“ঘাসফড়িং চাই কারো? ঘাসফড়িং?”
“আমি চাই! আমি চাই!”
আরও চার-পাঁচজন দৌড়ে এলো। মনে হচ্ছিল যেন ঘাসফড়িং-এর চেয়ে দামি আর কোনো পোকা নেই। ছেলেটি তৃতীয়বারের মতো চিৎকার করে উঠল—
“ঘাসফড়িং কেউ কি নেবে না?”
আরও দুই-তিনজন বাচ্চা এগিয়ে এলো।
“হ্যাঁ, আমি চাই।” এটা ছিল এক মেয়ে, যে ঠিক তখন যে ছেলেটি পোকাটি পেয়েছিল তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিল। হালকা ভঙ্গিতে শরীর ঘুরিয়ে ছেলেটি মাথা নিচু করে সম্মানের সঙ্গে সামনে ঝুঁকে পড়ল। সে ডান হাত ঝোপে ঢুকিয়ে, ফানুসটি বাম হাতে নিয়ে বলল— “ঘাসফড়িং।”
“হ্যাঁ, আমি সেটা নিতে চাই।”
ছেলেটি তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়াল। এমনভাবে যেন বলছে “নাও!”, সে মুঠোবদ্ধ হাত মেয়েটির দিকে বাড়িয়ে দিল। মেয়েটি তার বাম কাঁধের ফানুসের দড়ির নিচে কবজি ঢুকিয়ে ছেলেটির মুঠোকে দুই হাতে ঘিরে ধরল। ছেলেটি নিঃশব্দে তার মুঠো খুলে দিল। পোকাটি চলে এলো মেয়েটির বৃদ্ধাঙ্গুলি আর তর্জনির ফাঁকে।
“আ! এটা তো ঘাসফড়িং না। এটা তো একটা ঝিঁঝিঁ পোকা!”
মেয়েটির চোখ ঝলমল করে উঠল ছোট্ট বাদামি পোকাটির দিকে তাকিয়ে।
“ঝিঁঝিঁ! ঝিঁঝিঁ!”
শিশুরা হিংসাভরা সুরে একসঙ্গে বলে উঠল। “ঝিঁঝিঁ… এটা তো ঝিঁঝিঁ।”
চোখে বুদ্ধির দীপ্তি নিয়ে মেয়েটি ছেলেটির দিকে তাকাল, যে তাকে পোকাটি দিয়েছিল। তারপর নিজের কোমরে ঝোলানো ছোট পোকার খাঁচাটি খুলে, সেই ঝিঁঝিঁটিকে ঢুকিয়ে দিল।
“এটা সুরেলা ঝিঁঝিঁ।”
“আ! এটা তো সুরেলা ঝিঁঝিঁ…”
যে ছেলেটি সেটা ধরেছিল সেই আপন মনে বলল। ফানুসটিকে চোখের সামনে তুলে পোকার খাঁচার দিকে তাকাল। তার চোখের সামনে ধরা সেই নয়নাভিরাম বর্ণময় ফানুসের আলোয় সে এক ঝলক তাকাল মেয়েটির মুখের দিকে।
আহা! আমি ভাবলাম। ছেলেটির প্রতি হালকা ঈর্ষা অনুভব করলাম, আবার কিছুটা লজ্জিতও হলাম—এতক্ষণ কেন তার আচরণ বুঝতে পারলাম না! ঠিক তখনই আমি থমকে গেলাম বিস্ময়ে। দেখো! মেয়েটির বুকের ওপর যা ফুটে উঠেছে, তা না দেখেছে ছেলেটি, না সে মেয়েটি, না অন্য শিশুরাও। হালকা সবুজাভ আলোয় মেয়েটির বুকের ওপর স্পষ্ট অক্ষরে লেখা নয় কি—“ফুজিও”?
ছেলেটির ফানুস, যার সবুজ কাগজে কাটা ছিল তার নামের অক্ষরগুলো, ছায়ার মতো ছাপ ফেলেছে মেয়েটির সাদা সুতির কিমোনোর ওপর। মেয়েটির হাতে ঝুলে থাকা ফানুসটি অতটা স্পষ্ট করে কোনো কিছু দেখাতে পারেনি, কিন্তু তবু ছেলেটির কোমরের ওপর লাল কাঁপা কাঁপা আলোয় ফুটে উঠেছে “কিয়োকো” নামটি। এই লাল-সবুজের খেলা— এটা কী কাকতালীয় ছিল বা খেলার ছল—সেটা ফুজিও বা কিয়োকো কেউই তা জানত না।
এমনকি যদি তারা সারা জীবন মনে রাখে, যে ফুজিও তাকে ঝিঁঝিঁ পোকা দিয়েছিল আর কিয়োকো সেটা নিয়েছিল—তবুও কখনো, এমনকি স্বপ্নেও ফুজিও জানতে পারবে না যে তার নাম সবুজ আলোয় কিয়োকোর বুকে লেখা ছিল, আর কিয়োকোও জানতে পারবে না যে তার নাম লাল আলোয় ফুটে উঠেছিল ফুজিওর কোমরে।
ফুজিও! যখন তুমি একদিন যুবক হবে, যখন একটি মেয়ে, যাকে ঘাসফড়িং বলে দেওয়া হয়েছিল একটি সুরেলা ঝিঁঝিঁ তার আনন্দে হাসবে- যখন এক মেয়ে, যাকে ঝিঁঝিঁ বলে দেওয়া হয়েছিল শুধুই এক ঘাসফড়িং তারও ব্যথায় স্নেহের হাসি হাসবে। তুমি যদি অন্যদের থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়েও ঝোপের মধ্যে নিজেই খোঁজ করো, তখন তুমি বুঝবে, এই দুনিয়ায় সত্যিকারের ঝিঁঝিঁ পাওয়া যায় না চাইলেই। সম্ভবত তুমি এমন এক মেয়েকে খুঁজে পাবে, যে দেখতে ঘাসফড়িংয়ের মতো, কিন্তু তোমার চোখে তাকে সুরেলা ঝিঁঝিঁই মনে হবে।
কখনো যদি একদিন তোমার মেঘাচ্ছন্ন আহত হৃদয়ে সত্যিকারের সুরেলা ঝিঁঝিঁও ঘাসফড়িং মনে হয়, আর যদি সেই দিনে আসে যেদিন পুরো পৃথিবীটাই তোমার কাছে মনে হয় ঘাস ফড়িং-এ ভরা -তখন ফুজিও, আমার খুব কষ্ট হবে, যদি তুমি ভুলে যাও সেই রাতের আলোছায়ার খেলা—যে রাতে তোমার অপূর্ব ফানুসের সবুজ আলোকচ্ছটায় তোমার নাম লেখা হয়েছিল একটি মেয়ের বুকে!