এর ভেতরেই ঘটল এক কাণ্ড। এক ছোট্ট শিশু বলল, আমি জানি জাদুকর কোথায় থাকে। হৈ হৈ পড়ে গেল।
Published : 01 May 2024, 11:15 AM
বড় মানুষরা যারা ছোটদের জন্য লেখে, ছোটদের বোঝার মতো ভালোবাসা না থাকলে আসলে লেখাটা লেখা হয়ে ওঠে না। এই কথাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ছোটদের জন্য লেখাই আসলে সবচেয়ে কঠিন।
মাহরীন ফেরদৌসকে দীর্ঘদিন ধরে চিনি। তাই অন্তত যখন ‘কোথায় গেল জাদুকর’ নামে শিশুতোষ গল্পবইটি খুব সুন্দর অলংকরণসহ প্রকাশ পেল, তখন পড়ার আগেই আমি এটা জানতাম যে, মাহরীনের লেখাটা লেখা হয়ে উঠবে। অবশ্য এই কথার বিতর্কের অবকাশ আছে যে, আসলে লেখা কীভাবে লেখা হয়ে ওঠে! আমি কেবল আমার মতামতটাই বলতে চাই।
শৈশব বা কৈশোরের শুরুটা এমন যে ওই সময়ে যে মনন তৈরি হয় বাকি সময়টা ওই শিক্ষা, ওই রুচি এবং মানবিকতা নিয়েই আমাদের জীবনটা চলে যায়। মানবিকতা, মানুষের জন্য মমতা এসব যদি ছোট বয়সে না হয় তবে আর কখন হবে? আর এই জিনিসগুলো শিশুদের ভেতরে ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্য শিক্ষাক্রমের বই নয়, বরং গল্প সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
পড়ার জন্য মানুষ যা পড়ে, একটা শিশুমন যেটা পড়ে, সেটা আসলে তাকে হয়তো একজন সামাজিক জীব হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করে। কিন্তু গল্প তাকে মানুষে পরিণত করে। পৃথিবী তো মূলত গল্পেরই।
মানুষ সুন্দর গল্পগুলো যুগ যুগ নিজের ভেতরে বয়ে বেড়ায়। আমরা সুকুমার রায় পড়তাম, ঠাকুরমার ঝুলি পড়তাম। আর তারচেয়েও বড় একটা ব্যাপার ছিল, আমরা রূপকথার গল্পগুলো দাদা-দাদির মুখে শুনতাম। গল্প শুনে শুনে আমরা বড় হয়েছি। তারপর পড়েছি। যারা গল্প বা সাহিত্যকে মনের ভেতরে সত্যি ধারণ করতে পেরেছেন, তারা মানুষ হিসেবে একটু হলেও অন্যরকম।
মাহরীন সম্ভবত চেয়েছেন সেটাই। যারা বড় হবে তারা যেন একটু হলেও সুন্দর একটা মন নিয়ে বড় হতে পারে, সুন্দর কিছু দেখতে পারে এবং সুন্দর কিছু কাজ করতে পারে। পৃথিবীকে দেখার যে একটা আলাদা চোখের দরকার হয়, সেই চোখটাও মাহরীন বানিয়ে দিতে চেয়েছেন গল্পের আড়ালেই, নীতিকথার কঠিন নীতিতে নয়।
আমাদের হারিয়ে যাওয়া গল্পগুলো নতুন করে নতুন ভাবে, নতুন সমাজ বাস্তবতায় শিশুদের বোঝাতে গিয়ে রূপক হিসেবে জাদুকরের ব্যবহার করেছেন বটে, কিন্তু শেষে আসল জাদু যে মানুষের ভেতরেই থাকে সেটাও বোঝাতে পেরেছেন। কিন্তু কেবল আমাকে বোঝালেই কী হবে? যাদের জন্য লেখা তারা কী বুঝবে?
গল্পের শুরুতে আমরা একজন জাদুকরের কথা জানতে পারি। যে জাদুকর সব করতে পারে, পারে অসম্ভবকে সম্ভব করতে, পারে লুকিয়ে থাকতে। ওদিকে শহর শাসন যে করছে, সেই মানুষটা জাদুকরটাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।
এর ভেতরেই ঘটল এক কাণ্ড। এক ছোট্ট শিশু বলল, আমি জানি জাদুকর কোথায় থাকে। হৈ হৈ পড়ে গেল। এরপর তো আর বলতে পারে না কোথায়। আর কী করা? ওই শাসক এসে শিশুটাকে ধরে নিয়ে গেল এবং তারপর শুরু হলো ম্যাজিক।
সব তো আর বলে দেওয়া যাবে না, আর আমি বুঝলেও হবে না। আমি তাই আমার ভাগ্নি রুফাইয়ার কাছে জানতে চাইলাম বইটি দিয়ে। ওর বয়স সাত বছর। রুফাইয়া বইটি রাখল। কতক্ষণ পর আমার কাছে এলো। বলল, সোলার সিস্টেম দিয়ে তাহলে কারেন্টের সমস্যার সমাধান হবে? আমি বললাম, হতে পারে।
চাইলেই সব ময়লা পরিষ্কার হবে? আমি বললাম, হতেই পারে। মানুষ চাইলে পারে না এমন কিছু তো নেই। গল্পটা তোমার তাহলে ভালো লেগেছে? গল্প না তো। স্বপ্ন। এই কথা বলে রুফাইয়া চলে গেল।
আমি বুঝতে পারলাম বড়দের জন্য লিখতে থাকা মাহরীন ফেরদৌস শিশুদের জন্যও চমৎকার একটা স্টোরি বলে ফেলেছেন। শিশুরাতো আর ভান জানে না। একইসঙ্গে স্বপ্ন ও বাস্তবতার একটা ফারাক যেমন মাহরীন বোঝাতে পেরেছেন, তেমন মানুষের জন্য ভালো করাটার ইচ্ছাটাই যে সবচেয়ে বড় জাদু হতে পারে মানুষের জীবনে, সেটাও বোঝাতে পেরেছেন। মাহরীন ছোটদের জন্য আরও অনেক লিখবেন, এই প্রত্যাশা থাকল।
‘কোথায় গেলো জাদুকর’ বইটি ৪-৮ বছরের পাঠকদের জন্য লেখা। চিত্রায়ণ করেছেন অভি মজুমদার। এবছর বইমেলায় ‘শৈশবপ্রকাশ’ থেকে প্রকাশিত বইটির মূল্য ১৫০ টাকা।