অনূদিত গল্প
মরিসন লিখেছেন, “তুমি যদি পড়ার জন্য একটা বই খুঁজতে থাকো যেটা এখনো লেখা হয়নি, তাহলে সেটা তুমি নিজেই লিখে ফেল।”
Published : 09 Oct 2024, 03:39 PM
সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী টনি মরিসনের লেখা ৮টি গল্পের বই নিয়ে সংকলন ‘অ্যা টনি মরিসন ট্রেজারি’, ২০২৩ সালে এটি প্রকাশ করে মার্কিন প্রকাশনী সংস্থা ‘সাইমন অ্যান্ড শুস্টার’।
মরিসন তার ছেলে স্লেড মরিসনের সঙ্গে মিলে লেখা শিশুদের এ বইগুলো হয়ে উঠেছে জাদুকরী, কাব্যময়, মজার এবং কল্পনার সূতিকাগার। সেইসব গল্পের মধ্যে থেকে বাছাই করা আটটি গল্পের সংস্করণ এ বই।
বইয়ের ফ্ল্যাপে টনি মরিসন লিখেছেন, “তুমি যদি পড়ার জন্য একটা বই খুঁজতে থাকো যেটা এখনো লেখা হয়নি, তাহলে সেটা তুমি নিজেই লিখে ফেল।”
বইটির ভূমিকায় মার্কিন অভিনেত্রী ও উপস্থাপক অপরাহ উইনফ্রে লিখেছেন, “টনি মরিসনের লেখা আমাদের সমাজ এবং হৃদয় ছুঁয়ে যায় সহজেই। এই বইয়ে তেমনি আটটি গল্প রয়েছে। ছেলের সঙ্গে মিলে এই লেখাগুলো বিস্ময়-জাগানিয়া, রোমাঞ্চকর এবং খুব সত্যি।
“টনি মরিসন প্রত্যেকটা গল্পের প্রচ্ছদ এবং অলংকরণের জন্য আলাদা আলাদা শিল্পী বেছে নিয়েছেন, কারণ গল্পগুলোও একে অপরের থেকে আলাদা। এই গল্পগুলো পড়ে সব বয়সী পাঠকই বিশ্বের অন্যতম সেরা একজন লেখককে আবিষ্কার করবেন। মরিসন তার লেখা দিয়ে সারাজীবন আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকবেন। আশা করি বইটার গল্পগুলো পাঠকমাত্রই উপভোগ করবে।”
নিজেকে কীভাবে চিনতে পারব
সাভানার বনে এক সিংহ বাস করতো। হঠাৎ একদিন সে মাথা উঁচু করে গর্জন করে উঠলো-
শুনো শুনো শুনো সবাই
আর কোন যদি কিন্তু নেই,
আমি হলাম এই এলাকার রাজা
আমার ইচ্ছেই পালন করে প্রজা,
আমিই তৈরি করি সব নিয়ম ও নীতি
আমার থাবা থেকে বাঁচার নেই গতি,
আমিই সবচেয়ে শক্তিশালী দিনে কিংবা রাতে
আমি চাবকাই সবাইকে যে পড়ে আমার পথে,
বাঘ, বানর, হায়েনা, হাতি
হুকুমের গোলাম খায় লাথি,
শুনো শুনো শুনো সবাই
আর কোন যদি কিন্তু নেই,
আমিই সবার চেয়ে খারাপ এই বনে
আমার ইচ্ছেই সব, বলো জনে জনে।
তারপর সে তার কেশর দুলিয়ে উঁচু ঘাসের মধ্যে দিয়ে দৌড়ে গেল। এক পাথর থেকে অন্য পাথরে লাফিয়ে পড়লো। শক্তিশালী থাবা দিয়ে গাছের গায়ে আচঁড় কাটলো। কাঁটাওয়ালা ঝোপঝাড়ের মধ্যে লাফিয়ে পড়লো। তারপর হঠাৎ পড়ে গিয়ে গোঙাতে শুরু করলো।
সিংহের একটা থাবা ব্যথায় এতোটাই আচ্ছন্ন হয়ে গেল সে কথা বলতেই পারছিল না। অনেক কষ্ট করে সে শিশুদের মতো নিচু গলায় বলল,
শুনো শুনো শুনো সবাই
আর কোন যদি কিন্তু নেই,
আমি জমিনের উপর দিয়ে যাচ্ছিলাম দৌড়ে
খুব শক্তিশালী আর বড় মনে হচ্ছিল নিজেকে,
এখন মুখ থেকে বেরুচ্ছে না টু শব্দটিও
আটকে আছে কাঁটাটা এই পায়ে যদিও,
বাঘ, বানর, হাতি অথবা হায়েনা
আমাকে একটু সাহায্য করো না!
পাশ দিয়েই হেলেদুলে হেঁটে যাচ্ছিল এক বাঘ। সে বললো,
দ্রুত যেতে হবে ছুটে এখন বাড়ি আমাকে
বাচ্চারা একা পড়ে, দেখবো কি তোমাকে!
আমি করেছিলাম তাদের অঙ্গীকার
নিয়ে যাবো মালাই কোণের আকার।
একটু পর পাশ দিয়ে হায়েনা যেতে যেতে সিংহের গোঙানি শুনে দাঁড়ালো আর বললো,
তোমাকে করতে পারবো না সাহায্য
কারণ আমি টেলিফোনে আছি ব্যস্ত।
সিংহের কান্না শুনে হাতি আসলো আর বলল,
আমাকে দিয়ে হবে না তোমার উপকার
একশো একটা কাজ পড়ে আছে আমার।
গাছ থেকে বানর সব দেখেশুনে বললো,
ও রাজা! গোঙানি শুনেছি তোমার
কিন্তু হাতে সময় নেই যে আমার,
মা অসুস্থ আর স্ত্রী দিয়েছে কল
যাওয়ার পথে তুলতে হবে ফল।
সিংহ অনেকভাবে চেষ্টা করলো কাঁটাটা বের করতে, কিন্তু পারলো না। কখনো দাঁত দিয়ে কামড়ে, আবার কখনও অন্য থাবাটা দিয়ে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। সে যতই চেষ্টা করলো কাঁটাটা ততই আরও গভীরে ঢুকে গেল।
সে যখন সব আশা ছেড়ে দিয়েছে, তখন পাশের ঝোপের মধ্যে একটা ইঁদুরের কণ্ঠ শুনতে পেল। তার গলার স্বর ব্যথায় প্রায় বসে গিয়েছিল। তবুও সে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে বলল, আমি জানি কেউ আমাকে সাহায্য করতে আসবে না। এটা শুনে ইঁদুরটা ভাবলো, এটা নিশ্চয়ই তাকে উদ্দেশ্য করে বলা হচ্ছে না। তাই সে সিংহের মুকুটের মধ্যে বসে ইতস্তত করতে লাগলো।
তখন সিংহ বলল, না না, আমি তোমার হ্যাঁ ঠিক তোমার কথাই বলছি। বিপদ থেকে উদ্ধার করার জন্য তুমি একদম ঠিক আছো।
এটা শুনে ইঁদুর বলল, তার আগে তোমাকে প্রতিজ্ঞা করতে হবে যে তুমি আমাকে খেয়ে ফেলবে না। সিংহ হায় হায় করে উঠে বলল, তুমি যদি আমাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করো, তাহলে আমরা সারাজীবনের জন্য বন্ধু হয়ে থাকবো।
তারপর ইঁদুর ধীরে ধীরে সিংহের কাছে গেল। কাঁটাটার সঙ্গে তার লেজ বেঁধে কিছুক্ষণ টানাটানি করলো। তারপর হাত দিয়ে কাঁটাটা ধরে কিছুক্ষণ টানাটানি করলো। সবশেষে সে তার দাঁত দিয়ে টানতেই কাঁটা বেরিয়ে এলো।
সিংহ কৃতজ্ঞতায় নত হয়ে ইঁদুরের সঙ্গে হাত মিলালো। তারপর তারা যে যার বাসার দিকে রওনা দিল।
পরদিন ইঁদুর একটা অদ্ভুত অনুভূতি নিয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠলো। তার হৃৎপিণ্ড ঢোলের মতো কাঁপতে শুরু করলো। মনে হলো রাতারাতি তার দাঁতগুলো ব্লেডের মতো ধারালো হয়ে গেছে। সে যখন তার বাসা থেকে বের হয়ে চিৎকার করলো, সেটাকে তার কাছে সিংহের গর্জন বলে মনে হলো।
তার মনে হলো সে আর ইঁদুর নেই, সে আসলে সিংহ হয়ে গেছে। সে তার পশমগুলো ঘাড়ের পাশে এমন করে রাখলো যেন সেগুলো দেখতে সিংহের কেশরের মতো মনে হয়। সে দাঁত কিড়মিড় করতে করতে ঘাসের বনের দিকে এগিয়ে গেল। গাছের গায়ে আচঁড় কাটলো, এক পাথর থেকে আরেক পাথরে লাফিয়ে পড়লো।
এমনকি সে অন্য পশুদের দেখে গর্জন করতে শুরু করলো আর বলল,
শুনো শুনো শুনো সবাই
আর কোন যদি কিন্তু নেই,
আমাকে এই পৃথিবীর প্রধান মানো
দাঁত ধারালো আর কেশর পেঁচানো,
লেজ চাবুকের মতো আর থাবা ইস্পাতের
পেশি মজবুত তাই স্থান নেই অন্য মতের,
আমি তোমাদের ফেলতে পারি খেয়ে
এ সন্ধ্যার খাবার আজ সামনে পেয়ে।
ইঁদুরের এই হুমকি ধামকি শুনে বনের অন্য পশুরা হাসাহাসি করতে শুরু করলো। সে যতই জোরে গর্জন করে পশুরা ততই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। এটা দেখে সে সিংহের দরজায় গিয়ে কড়া নাড়লো। বলল, আমি যতই চেষ্টা করি বনের পশুরা আমায় মান্য করছে না, বরং হাসাহাসি করছে।
এভাবে ইঁদুর প্রতিদিন সিংহের বাসায় এসে অভিযোগ করতে থাকলো। অবশেষে একদিন তার মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল। সে সিংহকে বলল, ওরা আমাকে মান্য করছে না, কারণ আমার কেশর তোমার মতো লম্বা না, আমার জিভ তোমার মতো গোলাপি আর চওড়া না, আর আমার থাবা থেকে সবসময় দুর্গন্ধ আসে।
তখন সিংহ তার কেশর কেটে তাকে দিয়ে দিল। তার গোলাপি কোটের ফিতা কেটে ইঁদুরের জিভের সঙ্গে জুড়ে দিল। তার থাবার নখগুলো কেটে ইঁদুরের পায়ের সঙ্গে লাগিয়ে দিল।
এভাবে নিজেকে সাজিয়ে ইঁদুর বনের মধ্যে আসলো। কিন্তু এবারও কিছুতেই কিছু হলো না। পশুরা তবুও তাকে দেখে হাসিতে ফেটে পড়লো। সে আবার সিংহের বাসায় ফিরে আসলো। আর সিংহকে বলল, আসলে তোমার মতো আমার একটা সিংহাসন আর বাসা দরকার। তাহলে ওরা আমাকে আর দেখতেও পারবে না, হাসাহাসিও করতে পারবে না।
এটা শুনে সিংহের প্রচণ্ড রাগ হলো, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তার প্রতিজ্ঞার কথাও মনে পড়ে গেলো। সে ইঁদুরের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য বাসা ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো।
তারপর থেকে ইঁদুর সারাদিন সিংহের বাসায় বসে বসে চিৎকার করতে লাগলো। সেটা শুনে সিংহ একটা ছড়া কাটতে থাকলো-
শুনো শুনো শুনো সবাই
আর কোন যদি কিন্তু নেই,
এই জমিনের বুকে করো তাই
মনে করো তোমার যা যা চাই,
আকার আর প্রকারের উপর রাখো বিশ্বাস
তুমি তৈরি করতে পারবে আইন, আশ্বাস,
নরম বা শক্ত হও কিংবা ছোট বড়
হাসির পাত্র হবে যাকিছু তুমি কর,
যদি নিজস্বতাকে করো তুমি ভয়
আজব কারখানায় কে মেতে রয়!