বর্ষা ও রবীন্দ্রনাথ

বর্ষা নিয়ে তার অনেক ছড়া-কবিতা মনের অজান্তে কোনোরকম গলার কষ্ট ছাড়াই বলা যায়, আবার গান হিসেবেও গাওয়া যায়।

আবু আফজাল সালেহআবু আফজাল সালেহ
Published : 3 August 2022, 02:10 PM
Updated : 3 August 2022, 02:10 PM

‘মনে পড়ে সুয়োরানী দুয়োরানীর কথা/ মনে পড়ে অভিমানী কঙ্কাবতীর ব্যথা/… তারি সঙ্গে মনে পড়ে মেঘলা দিনের গান/ বিষ্টি পড়ে টাপুর-টুপুর, নদেয় এলো বান।’

মুখে মুখে প্রচলিত এ ছড়াটি কার লেখা আর বলা লাগে না, ঠিকই ধরেছো! কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা। ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর-টুপুর’ শিশুতোষ এ ছড়াটি আজ খুব জনপ্রিয়।

বৃষ্টি কবি মনকে খুবই দোলা দিত। আষাঢ় আর শ্রাবণ নিয়েই কবি শতাধিক গান-কবিতা রচনা করেছেন। ‘রবি ঠাকুর’, ‘বিশ্বকবি’ নামেও পরিচিত তিনি। তিনি ১৮৬১ সালের ৭ মে, বাংলা ২৫ বৈশাখ ১২৬৮ বঙ্গাব্দ কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। মারা যান ১৯৪১ সালের ৭ অগাস্ট, বাংলা ২২ শ্রাবণ ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ।

কবিরা বৃষ্টি ভালোবাসেন। রবীন্দ্রনাথও বৃষ্টিকে ভালোবেসে সৃষ্টি করেছেন সুর আর ছন্দ। কবি প্রকৃতিকে কাছে পেতে চাইতেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যের প্রবাদপুরুষ। তিনি অনেক মিষ্টি মিষ্টি ছড়া, কিশোর কবিতা ও গল্প লিখেছেন। ভ্রমণকাহিনি ও আত্মজীবনীও লিখেছেন। লিখেছেন শৈশবের কাহিনি। বর্ষা নিয়ে তার আছে অনেক ছড়া-কবিতা-গান। তবে সবই লিখেছেন সহজ-সরল ভঙ্গিতে যেন তোমাদের মন সহজেই গ্রহণ করতে পারে। কিছু কিছু কবিতা-ছড়া বা বিষয় আজীবন মনে থাকবে।

তেমনই একটি ছড়া, মনের অজান্তেই কোনোরকম গলার কষ্ট ছাড়াই বলা যায়। আবার গান হিসেবেও গাওয়া যায়, ‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে বাদল গেছে টুটি/ আজ আমাদের ছুটি ও ভাই আজ আমাদের ছুটি।’

‘মেঘমল্লারে সারা দিনমান,/ বাজে ঝরনার গান...’। ঠিক তাই। কবির ছোঁয়া সর্বত্র বিস্তৃত। তবে বর্ষা কবির প্রিয় একটি বিষয়। তার ছোঁয়ায় বর্ষা পেয়েছে বহুমাত্রিক রূপ। কবিতার ছন্দে এঁকেছেন সুন্দর সব দৃশ্য। এসব দৃশ্য তোমরা বর্ষাকালে দেখতে পারবে। ‘মেঘদূত’ কবিতায় কবি ফুটিয়ে তুলেছেন মাতাল বর্ষার রূপ, ‘আজি অন্ধকার দিবা বৃষ্টি ঝরঝর/ দুরন্ত পবন অতি, আক্রমণে তার/ অরণ্য উদ্যতবাহু করে হাহাকার/ বিদ্যুৎ দিতেছে উঁকি ছিঁড়ি মেঘ ভার/ খরতর বক্রহাসি শূন্যে বরষিয়া।’

কবিরা বৃষ্টি ভালোবাসেন। রবীন্দ্রনাথও বৃষ্টিকে ভালোবেসে সৃষ্টি করেছেন সুর আর ছন্দ। কবি প্রকৃতিকে কাছে পেতে চাইতেন। পাখির কিচিরমিচির করে গান গাওয়া, নদীর কলকল ছলছল ছুটে চলার ধ্বনি কবির মনকে দোলা দিয়েছে। এসব কথা তার বিভিন্ন লেখায় তুলে ধরেছেন। কত সুন্দরভাবে আষাঢ় মাসের মেঘ দেখে কবি তার ‘আষাঢ়’ কবিতায় বলেছেন, ‘নীল নবঘনে আষাঢ়গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে/ ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।’ অথবা ‘বর্ষার দিনে’ কবিতায়, ‘এমন দিনে তারে বলা যায়/ এমন ঘনঘোর বরিষায়/ এমন মেঘস্বরে বাদল ঝরঝরে/ তপনহীন ঘন তমসায়।’

বর্ষা প্রাণী ও গাছ-গাছালিদের নতুন করে প্রাণশক্তি দেয়। রবি ঠাকুরের কবিতা থেকে কিছু পঙক্তি, ‘এই পুরাতন হৃদয় আমার আজি/ পুলকে দুলিয়া উঠিছে আবার বাজি/ নূতন মেঘের ঘনিমার পানে চেয়ে/ রহিয়া রহিয়া বিপুল মাঠের ‘পরে/ নব তৃণদলে বাদলের ছায়া পড়ে।’

আকাশে মেঘ জমে, আসি আসি করে বৃষ্টি হঠাৎ ঝমঝম শব্দে চলে আসে। অনেক সময় বিড়ম্বনারও কারণ ঘটে থাকে। কৃষিপ্রধান এ দেশে কৃষকের কষ্টের কারণ হয়ে যায় এই অনাহূত বৃষ্টি। তোমরা ‘সোনার তরী’ কবিতার কথা প্রায় সবাই জেনে থাকবে। এ কবিতায় কবি এঁকেছেন বর্ষার চিত্র, ‘গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা/ কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা/ রাশি রাশি ভারা ভারা ধান কাটা হল সারা/ ভরা নদী ক্ষুরধারা খর-পরশা/ কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা।’

বর্ষার সময় এই বৃষ্টি তো এই মেঘ। হাসতে থাকে আকাশ। হাসির ফাঁকে হঠাৎ কালো মেঘ। সাময়িক বিরতি দিয়ে দিয়ে বৃষ্টি পড়ে।

কবির ‘বর্ষাযাপন’ কবিতায়ও এরকম একটা চিত্র বা দৃশ্য আঁকা হয়েছে। কেউ-কেউ হয়তো এ কবিতা পড়ে থাকবে। যাদের পড়ার সুযোগ হয়নি তাদের জন্য কয়েক লাইন তুলেই দিচ্ছি, ‘দিগন্তের চারিপাশে আষাঢ় নামিয়া আসে/ বর্ষা আসে হইয়া ঘোরালো/ সমস্ত আকাশজোড়া গরজে ইন্দ্রের ঘোড়া/ চিকমিকে বিদ্যুতের আলো।’

‘আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে’, ‘আষাঢ় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো’, ‘আষাঢ়’ প্রভৃতি কবিতায় বর্ষার রূপ তুল ধরেছেন কবি। নতুন মেঘ, কালো আকাশ, বহমান বাতাস এসব কবিতার উপাদান, ‘আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে/ আসে বৃষ্টির সুবাস বাতাস বেয়ে/ এই পুরাতন হৃদয় আমার আজি/ পুলকে দুলিয়া উঠিছে আবার বাজি/ নূতন মেঘের ঘনিমার পানে চেয়ে/ আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে।’

বর্ষার সময় এই বৃষ্টি তো এই মেঘ। হাসতে থাকে আকাশ। হাসির ফাঁকে হঠাৎ কালো মেঘ। সাময়িক বিরতি দিয়ে দিয়ে বৃষ্টি পড়ে। ‘আষাঢ় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো’ কবিতায় আমরা পড়ি এভাবে, ‘আষাঢ়সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল/ একলা বসে ঘরের কোণে/ কী ভাবি যে আপন-মনে/ সজল হাওয়া যূথীর বনে/ কী কথা যায় কয়ে/ বাঁধনহারা বৃষ্টিধারা/ ঝরছে রয়ে রয়ে।’

বর্ষার দিনে কোনও কাজ করতে ভালো লাগে না। শুধু ভাবনা আর কল্পনা উঁকি দেয় মনে। সবকিছু কেমন যেন স্থবির হয়ে পড়ে। ‘অপেক্ষা’ কবিতায় এমন সুর শুনি, ‘মেঘেতে দিন জড়ায়ে থাকে মিলায়ে থাক মাঠে/ পড়িয়া থাকে তরুর শিরে/ কাঁপিতে থাকে নদীর নীড়ে/ দাঁড়ায়ে থাকে দীর্ঘ ছায়া মেলিয়া ঘাটে বাটে।’

বৃষ্টির সুর সুমধুর। প্রেমিক মনে দেয় দোলা। তবে এক থাকা মানুষের বৃষ্টির সুর বেদনা জাগায়। কিছুতেই মন ধরে রাখা যায় না! সব কিছুই বিরক্তি লাগে, ‘আমার পরানে আজি যে বাণী উঠিছে বাজি/ অবিরাম বর্ষণধারে/ কারণ শুধায়ো না, অর্থ নাহি তার/ সুরের সঙ্কেত জাগে পুঞ্জিত বেদনার।’

প্রিয়জনকে ছেড়ে থাকা অনেক কষ্টের। বৃষ্টির সুর অনুপস্থিত প্রিজনকে যেন আরও দূরে সরিয়ে দেয়। তারই আবহ দেখি এ কবিতায়, ‘আজি বরিষন মুখরিত শ্রাবণ রাতি/ স্মৃতি বেদনার মালা একেলা গাঁথি/ আজি কোন ভুলে ভুলি আঁধার ঘরেতে রাখি দুয়ার খুলি/ মনে হয় বুঝি আসিছে সে মোর দুখরজনীর সাথী।’

‘এসো নীপবনে ছায়াবীথিতলে এসো কর স্নান নবধারাজলে’, এ গানটি বর্ষার নবধারাকে আহ্ববান করেছেন কবি রবীন্দ্রনাথ। এসব গান বাদলমুখর দিনে-রাতে মাতাল করে। একপ্রকার মাদকতা সৃষ্টি করে। শ্রাবণ আর রবীন্দ্রনাথ একসুরে গাঁথা। বর্ষার ফোঁটা পড়লেই গেয়ে উঠি, ‘পাগলা হাওয়ার বাদল-দিনে/ পাগল আমার মন জেগে ওঠে।’

তাছাড়া ‘আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদরদিনে, জানি নে জানি নে কিছুতে কেন যে মন লাগে না…’ রবীন্দ্রনাথের জনপ্রিয় এ গানটি মন উচাটন করে তোলে, বিরহী করে তোলে। প্রিয়জনের সান্নিধ্য পেতে মরিয়া হয়ে ওঠে। ‘মন মোর মেঘের সঙ্গী/ উড়ে চলে দিগদিগন্তের পানে/ নিঃসীম শূন্যে শ্রাবণ বর্ষণ সঙ্গীতে/ রিমঝিম রিমঝিম...’, এমন গান শুনতে শুনতে আমরা নিজেকে হারিয়ে ফেলি প্রকৃতিতে, বর্ষায়, মেঘের মধ্যে। সানন্দে গেয়ে যাই, ‘মম চিত্তে নিতি নৃত্যে কে যে নাচে/ তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ/ তারি সঙ্গে কী মৃদঙ্গে সদা বাজে/ তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ।’