বোটে মাছের গন্ধে বিড়ালের ঘুম ভেঙে গেল। আড়মোড়া ভেঙে মাছের কাছে গিয়ে আনন্দে ডেকে উঠল ‘মিয়াও’।
Published : 25 Jun 2023, 03:31 PM
ঝন্টু চোখ বন্ধ করে ফেলল। বাঘের দাঁতের পরিবর্তে তার মনে হলো সাঁড়াশির মতো কিছু একটা চারপাশ দিয়ে আঁকড়ে ধরেছে তাকে। তুলে ফেলছে শূন্যে। হ্যাঁচকা টানে উড়ুশূন্যি করে উপরে টেনে তুলে শক্ত কাঠের উপর আছড়ে ফেলল।
চোখ খুলতেই চোখের উপর এক মুখ কাঁচাপাকা উস্কোখুস্কো দাড়ি গোঁফ ভেসে উঠলো। ঝন্টু যতটা না বাঘ দেখে বিস্মিত হয়েছিলো তার চেয়ে বেশি অবাক হলো চোখের সামনের মানুষটাকে দেখে। মফেজ ডাক্তার আঙ্কেল! আপনি এখানে?
মফেজ ডাক্তার ভাঙা ভাঙা গলায় ফ্যাসফ্যাস করে বললেন, তুই কে রে? এই দ্বীপে কেন এসেছিস? আমাকেও চিনে ফেলেছিস দেখছি। তুই কোনো স্পাই নাকি? সরকার লাগিয়েছে! কিন্তু এতটুকু পুঁচকে স্পাই? অবশ্য এই পুঁচকেরা খুব ভয়ংকর হয়।
ঝন্টু কাঠের পাটাতনের উপর উঠে দাঁড়াতে গিয়ে একটু টাল খেল। সে একটা কাঠের ঘরের মধ্যে আছে। ঘরের ছোট্ট জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে তার মনে হলো সে শূন্যের উপর আছে। সেও বিধস্ত গলায় বলল, ডাক্তার আঙ্কেল, আমাকে চিনতে পারছেন না? আমি গলায় কাঁটা...মানে আমার বাবা আমার গলায় ইলিশ মাছের কাঁটা ফুটে...আপনার কাছে কাঁটা বের করতে...আপনি বিড়ালের পায়ে...’
ক্যাটজিলা?
মানে?
আরে তুইই তো প্রথমে আমাকে ক্যাটজিলার কথা বলেছিলি! আমি সেই বিড়ালটা নিয়ে জেনেটিক্স পরিবর্তন করে গডজিলার মতো ক্যাটজিলা সৃষ্টি করতে শুরু করলাম। আর সেই ক্যাটজিলার ভয়ে আমি এখন গাছে বাস করি।
এই ঘর কি গাছের উপরে?
হ্যাঁ। ক্যাটজিলার ভয়ে। সুরক্ষিত ঘর। ও ব্যাটা গাছ বেয়েও উঠতে পারে। কিন্তু আমি গাছের গায়ে এমন কেমিক্যাল দিয়ে রেখেছি উঠতে পারছে না। না হলে ও এতদিনে আমাকে ধরে খেয়ে ফেলত। এই বিড়াল আর সেই নিরীহ প্রাণী নেই। হিংস্র প্রাণী হয়ে গেছে। জঙ্গলের অন্য সমস্ত প্রাণীকে খেয়ে ফেলেছে। শুধু আমাকে খেয়ে ফেলতে বাকি।
তার মানে আমি আপনার ক্যাটজিলার সামনে পড়েছিলাম?
হ্যাঁ। ওটাই ক্যাটজিলা। শরীর দশাসই হিংস্র হলেও ডাকে বিড়ালের মতো ‘মিয়াও মিয়াও’ করে। তবে ওর মস্তিষ্কে আমি হরমোন পুশ করেছি বলে ও দিন দিন আরো উন্নতি করছে। এখন আর ও আমার কব্জায় নেই। আমার কলাকৌশলও শিখে ফেলেছে। অত্যন্ত ধূর্ত হয়েছে ব্যাটা। ওকে কোনভাবেই এখন আর ধরা সম্ভব নয়।
তাহলে তো সর্বনাশ।
সর্বনাশ তো বটেই। এক্কেবারে সাড়ে সর্বনাশ। আমি এই দ্বীপ থেকে বেরিয়ে যেতে পারছি না। আটকা পড়ে গেছি।
না না আমি সে কথা বলছি না। আমার বন্ধুরাও এই জঙ্গলে আছে। ক্যাটজিলা তো ওদের খেয়ে সাবাড় করে ফেলবে।
বলিস কি? কোথায় ওরা? কয়জন?
জঙ্গলের ভেতরে ঢুকেছে তিনজন। আর দ্বীপের চরে বোটের কাছে একজন আছে।
সেকি! আগে বলিসনি কেন? আমার গবেষণাগার থেকে শক্তিশালী টেলিফটোস্কোপ দিয়ে দেখতে হবে। গোটা দ্বীপে আমি বিভিন্ন স্থানে ক্যামেরা বসিয়ে এখান থেকে ক্যাপ্টেন নিমোর মতো ক্যাটজিলার উপর নজর রাখি। ওর উপর নজর রাখতে গিয়েই তো তোকে দেখলাম। শিগগিরই এদিকে আয়।
মানুষ শরীরে দুর্বল, কিন্তু মস্তিষ্কে উন্নত অন্য প্রাণীর চেয়ে। ক্যাটজিলার ক্ষেত্রে সেটাই ভুল হলো। ওর মস্তিষ্ক হয়ে গেল মানুষের মতো উন্নত।
গাছের উপর আরেকটা কাঠের রুম আছে। ছোটখাট গবেষণাগার। সেখান থেকে আপাতত সব নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। ঝন্টুর একটা খটকা লাগল। আপনি এত ছোট গবেষণাগার থেকে ক্যাটজিলা সৃষ্টি করেছেন?
মফেজ ডাক্তার টেলিফটোস্কোপে চোখ রেখে নব ঘুরাতে ঘুরাতে বলল, নারে। আমার গবেষণাগার অনেক বিশাল। এই জঙ্গলের একেবারে সেন্ট্রাল পয়েন্টে আছে। সেটা ওই শয়তান ক্যাটজিলা দখল করে নিয়েছে। বিড়ালকে ক্যাটজিলা করার পরিকল্পনা মাথায় আসতেই খুঁজে খুঁজে এই নির্জন দ্বীপ আবিষ্কার করলাম। তারপর ভাড়াটে লোক দিয়ে ট্রলারে করে গবেষণাগারের যন্ত্রপাতি নিয়ে ওদের বিদায় করলাম। শুরু করলাম বিড়াল নিয়ে গবেষণা।
মফেজ ডাক্তার বলতে থাকলেন, নানা রকম বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষার পর ওর শরীরে নানা ধরণের ইনজেকশন পুশ করলাম। প্রথমেই মস্তিষ্কে কেমিক্যাল দিয়ে ব্রেন বাড়িয়ে দিলাম। সেটাই করলাম ভুল। শরীর বড় প্রাণীদের সামলানো যায়, কিন্তু শরীরের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মতো বুদ্ধিমত্তার প্রাণীদের সামলানো মুশকিল। মানুষ শরীরে দুর্বল, কিন্তু মস্তিষ্কে উন্নত অন্য প্রাণীর চেয়ে। ক্যাটজিলার ক্ষেত্রে সেটাই ভুল হলো। ওর মস্তিষ্ক হয়ে গেল মানুষের মতো উন্নত। শরীর বাঘের মতো ডাবল শক্তিশালী। হিংস্র। কই, তোমার বন্ধুদের তো কোথাও দেখছি না? ক্যাটজিলা ওদের খেয়ে ফেলল নাকি?
না। একসঙ্গে তিনজন মানুষ খাওয়ার ক্ষমতা ওর নেই।
এমন কি হতে পারে জঙ্গলের ভেতর আমাকে খুঁজতে খুঁজতে ওরা আপনার সেই গবেষণাগারের বাড়িটা পেয়ে তার ভেতরে ঢুকে পড়েছে?
মফেজ ডাক্তার চকচকে চোখে বললেন, সে সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আর সেটা হলে তো সাড়ে সর্বনাশের উপর সর্বনাশ।
কেন? বাড়ির ভেতরেও কি আক্রমণ করবে নাকি?
ওটাই তো ক্যাটজিলার আস্তানা। ক্যাটজিলা ভালো করেই জানে ওটাই আমার গবেষণাগার। ওখানেই আমার সবকিছু। আমাকে এই দ্বীপ থেকে বের হতে গেলে, বাইরের দুনিয়ায় যোগাযোগ করতে গেলে ওখানে যেতেই হবে। সেজন্যই ও ওখানে আমার জন্য ওত পেতে বসে থাকে।
কেন? আপনাকে খেয়ে ফেলবে বলে?
না। সেটা ও করবে না। সেটুকু বুদ্ধি ওর আছে। ও জানে আমাকে খেয়ে ফেললে ও যেটা চাইছে সেটা কোনদিনই সম্ভব হবে না।
ও আপনার কাছে কী চাইছে?
ওটা ছিলো হুলো বেড়াল। ও চাইছে একটা মেনি বিড়াল। একটা মায়া বেড়াল।
তাই ধরে দিলে যদি ঝামেলা চুকে যায়, দিন না!
তুই বুঝছিস না। এখানকার সাইজের বিড়াল তো ওর পোষাবে না। ও চাইছে গবেষণা করে মেনি বিড়ালকে ওর মতো সাইজের করে দিতে। তা দিলেই ও আমাকে এই দ্বীপ থেকে চলে যেতে দেবে। কিন্তু আমি একই ভুল দুবার করব না। ওদের একজোড়া তৈরি করে দিলে ওরা বাচ্চা জন্ম দেবে। সেই বাচ্চা জেনেটিক্যালি ওদের বুদ্ধিমত্তা, ওদের শরীর নিয়ে বড় হবে। ওরা শুরু করবে মানুষ হত্যা। কারণ ওরা প্রতিদ্বন্দ্বী রাখবে না। দ্বীপ ছেড়ে আসতে শুরু করবে লোকালয়ে। পৃথিবী থেকে মানুষ নিশ্চিহ্ন করে দেবে। পৃথিবী ভরে ফেলবে ক্যাটজিলায়। মানুষের পৃথিবী হবে ক্যাটজিলার পৃথিবী।
এখন কী করবেন? আগে আমার বন্ধুদেরতো বাঁচাতে হবে।
হ্যাঁ। সেটাই এখন প্রথম কাজ। আর তা করতে গেলে এখানে গাছের উপরে কাঠের ঘরে বসে থাকলে হবে না। কাজে নামতে হবে। তুই কি যাবি আমার সঙ্গে?
অবশ্যই। আমার বন্ধু আর আমি যাবো না! আমাকে কী করতে হবে বলেন?
ঠিক আছে। আমি যা যা বলব ঠিক তাই তাই করবি। এই পেট্রোলের টিনটা হাতে নে। সারাগায়ে এই কেমিক্যালটা মেখেনে। ক্যাটজিলা এর গন্ধ সহ্য করতে পারে না। তোর বন্ধুদের উদ্ধার করতে পারলে ওকে কাবু করে ফেলতে পারবো। গবেষণাগারে ওকে কাবু করার মতো অনেক অস্ত্র আছে। স্লিপগান আছে। ওকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে পারবো।
কিছুদূর এগুতেই ঝন্টুর চোখে পড়ল চারদিকে জংলা ঝাঁপিয়ে ওঠার মাঝখানে একটা বাড়ি। মফেজ ডাক্তার তার চশমার উপর লাগানো দুরবিনের মতো জিনিসটা নেড়ে বললেন, তোর কথাই ঠিক...
কীভাবে?
আছে। আমি একা বলে সুবিধে করতে পারছিলাম না। ও বুদ্ধিমত্তা ও শক্তিতে আমাকে হারিয়ে ফেলছিল। কিন্তু এখন আমরা পাঁচজন। যত বুদ্ধিমানই ও হোক না কেন, পাঁচজনের মোকাবেলা একা করতে পারবে না। তোরা ওকে ব্যস্ত রাখবি, এই ফাঁকে ওকে গবেষণাগারে ঢুকিয়ে কোনমতে সাইজ করতে পারলে... নে আর কথা না বাড়িয়ে কাজে...
মফেজ ডাক্তার গাছ থেকে দড়ির সিঁড়ি নামিয়ে দিলেন। জঙ্গলে নেমে মফেজ ডাক্তার পরিচিতের ভঙ্গিতে এগুতে লাগলেন, যেন সবই তার নখদপর্ণে।
কিছুদূর এগুতেই ঝন্টুর চোখে পড়ল চারদিকে জংলা ঝাঁপিয়ে ওঠার মাঝখানে একটা বাড়ি। মফেজ ডাক্তার তার চশমার উপর লাগানো দুরবিনের মতো জিনিসটা নেড়ে বললেন, ‘তোর কথাই ঠিক। তোর বন্ধুরা ওই বাড়িতেই আছে। তবে আটকা পড়েছে। শয়তানটা ওদের ভেতরে আটকে রেখে দরজার সামনে শুয়ে আছে। তোকে ওর সামনে থেকে আমি তুলে নিয়েছি দেখেছে। বুঝেছে এদের আটকে রাখলে আমি অবশ্যই এখানে আসবো। শয়তানটা এখন আমার জন্য অপেক্ষা করছে। মানুষের মতো অনেক বুদ্ধি ওর।
এখন তাহলে কী করবেন?
একটা উপায় অবশ্য আছে। ওদের ঘ্রাণশক্তি তীব্র হলেও একই ঘ্রাণশক্তিতে বিভ্রান্ত হয় ওরা। মাছের গন্ধ পায় বিড়াল, কিন্তু ধরণ বুঝতে পারে না। তোর আর আমার গায়ে একই কেমিক্যাল মাখা। কাজেই তুই যে আমি নই সেটা ও বুঝতে পারবে না। এই বিভ্রান্তির সুযোগ নিয়ে তুই ওর সামনে দরজার দিকে যাবি। আমি পেছন দিক থেকে ঢুকে তোর বন্ধুদের বের করে দেবো। তুই ক্যাটজিলাকে যে করে হোক দরজার কাছে ধরে রাখবি।
আপনি যে বললেন ও বুদ্ধিমান। যদি ও আমাকে চিনতে পেরে আক্রমণ করে?
সেটুকু রিস্ক তো নিতেই হবে। আর ঘাবড়াচ্ছিস কেন! তোর উপর আমার নজর থাকবে। সেরকম বেগতিক দেখলে কোন একটা ব্যবস্থা করবই। ও এখনও আমাকে মানে।
মফেজ ডাক্তার চুপিসারে জঙ্গলের অন্যদিকে চলে যেতেই ঝন্টুর ভয় করতে লাগল। কিন্তু বন্ধুদের বাঁচানোর কথা চিন্তা করে সে এগিয়ে গেল ক্যাটজিলার দিকে। ক্যাটজিলা উঠে দাঁড়িয়ে টানটান হয়ে দাঁড়াল। তারপর নাকে গন্ধ শুকে একটু সহজ হলো। ঝন্টু সাহস করে আরেকটু এগিয়ে গেলো। একেবারে বারান্দায় উঠে দাঁড়াল।
হঠাৎ করে ঘরের ভেতরের দিক থেকে দরজা খুলে গেলো। মুখে বিস্তৃত হাসি নিয়ে দরজায় দাঁড়ালেন মফেজ ডাক্তার। তার হাতে স্লিপগান। মুখে বিজয়ের হাসি। বিড়বিড় করে বললেন, এবারে বাছাধন বিড়ালের বাচ্চা। দেখি তোমার দৌড় কতদূর!
ক্যাটজিলা ঘরের ভেতরে তাকিয়ে বিভ্রান্ত হলো। রাগি চোখে একবার ঝন্টুর দিকে একবার মফেজ ডাক্তারের দিকে তাকাল। তারপর কি বুঝে ঝাঁপ দিল ঝন্টুর উপর। মফেজ ডাক্তার ট্রিগারে চাপ দিলেন। ঘাস গজিয়ে উঠা বারান্দার উপর কাটা কলাগাছের মতোই পড়ে গেলো বিশালদেহী প্রাণীটি।
হৈ হৈ করে ভুটো, কিসলু, পলাশ এসে আতঙ্কিত পড়ে যাওয়া ঝন্টুকে টেনে তুলল। ভুটো টেনে তুলতে তুলতে বলল, ঝন্টে, তোর গা দিয়ে এমন বোঁটকা গন্ধ বের হচ্ছে কেন রে! পেটের নাড়িভুড়ি বের হবার জোগাড়।
মফেজ ডাক্তার অসাড় পড়ে থাকা ক্যাটজিলার দিকে তাকিয়ে বললেন, বন্ধুকে টানাটানি করিস পরে। আগে এটাতে হাত লাগা। ল্যাবরেটরিতে এনে দে। দেখিস এটার কী অবস্থা করি!
ঘণ্টা দুই পর বাইরে আড্ডা দিতে থাকা চার মূর্তিকে ভেতরে ডাকলেন মফেজ ডাক্তার। ভেতরে গবেষণাগারের ট্রেতে চোখ পড়তে সবাই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলো। গাটাগোট্রা টাইপের একটা কালো বেড়াল শুয়ে আছে ট্রের এক কোণে। ঝন্টু বিড়ালটাকে চিনতে পারল। এর পা ধরে ক্ষমা চেয়েই রক্ষা পেয়েছিল সেদিন।
বিড়ালটা কোলে নিয়ে মফেজ ডাক্তার ওদের সঙ্গে তীর পর্যন্ত এলেন। অনুরোধ করলেন কারোর কাছে এই গবেষণার কথা না প্রকাশ করতে। ঝন্টু মফেজ ডাক্তারের কাছে বিড়ালটা তাকে দেওয়ার অনুরোধ জানাতেই তিনি আপদ বিদায় করতে রাজি হলেন।
জামাল বসে বসে কিছু মাছ ধরে বোটে রেখেছিল। বোটে মাছের গন্ধে বিড়ালের ঘুম ভেঙে গেল। আড়মোড়া ভেঙে মাছের কাছে গিয়ে আনন্দে ডেকে উঠল ‘মিয়াও’।