অনন্তকাল ধরে যেন তারা হেঁটে চলে আর তাদের বাড়ি ফেরার পথ আরও দূরে, বহু দূরে সরে যেতে থাকে।
Published : 24 Mar 2025, 11:11 PM
মৌমাছির কাণ্ডে মিঠুর কোনো দোষও নেই। দোষ হলে হয়েছে জিসানের অসতর্কতার। সে যদি একটু দেখে বা খেয়াল করে দৌড়াতো, তাহলে কাঁধের ব্যাগ লেগে মৌচাকও ভাঙত না। আর মৌমাছিও সবাইকে এমন কামড়ে কামড়ে তাড়িয়ে বেড়াত না। এসব ভেবে ও বিবেচনা করে সবার বিরক্তিভাব কেটে গেছে। মিঠুর জন্য এখন সবার চিন্তাই হচ্ছে বেশি। ‘কোনো বিপদ-আপদ হলো কিনা! মৌমাছি ওকে অনেক বেশি কামড়ে দিলো কিনা!’ –এমন আরও নানা রকম দুশ্চিন্তা এসে তিন বন্ধুর মনের কোণে ভিড় করে।
তিনজনই অজানা আশঙ্কা ও অস্থিরতা নিয়ে মিঠুর নাম ধরে আরও জোরে চিৎকার করে ডেকে ডেকে তাকে খুঁজে ফিরে। তাদের সেসব চিৎকার গহনবনের অনেক দূর পর্যন্ত গিয়ে, প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসে। কিন্তু মিঠুর কোনো খোঁজ মেলে না। কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না এবং মিঠুও আর ফেরে না।
মৌমাছির কামড়ের ব্যথা কমে এলেও একেবারে প্রশমিত হয়ে যায়নি এখনো। কামড়ের জায়গাগুলোতে হাত বা কিছু লাগলেই চট করে ব্যথাটা নিজের অস্তিত্ব জানান দেয়। ব্যথার শরীর হাঁটাহাঁটিতে ক্লান্ত হয়ে আসে। তিনজন একত্রিত হয়ে বড়ো একটা গাছের নিচে বসে পড়ে। চেহারার চিন্তার ছাপ ধীরে ধীরে ভয়ে রূপান্তরিত হতে শুরু করেছে। কারও মুখে কোনো কথা নেই। নিঃশব্দ তিনজন যেন কী কথা বলবে তা-ও খুঁজে পায় না।
তাদের সে নিঃশব্দ-নীরবতা বনের সব ধরনের শব্দকে শুনতে সাহায্য করে। চারদিক থেকে ভেসে আসে হরেক রকম পোকামাকড় ও প্রাণীর সান্ধ্যকালীন ডাকাডাকি। ঘরে ফেরা পাখির কিচিরমিচির তাদেরকে প্রাণ-প্রকৃতির শব্দ ভাণ্ডারে স্নান করাতে থাকে। কিন্তু কান ভরে তিন বন্ধু সেসব শব্দ শুনতে পেলেও দুশ্চিন্তা আর ভয়ে প্রাণভরে তারা কেউ তা অনুভব করতে পারে না।
মিঠুকে খুঁজে পাওয়ার চিন্তায় মগ্ন তিনজনের মধ্যে আদনানের কানে কেমন একটা পরিচিত শব্দ ক্ষীণভাবে প্রবেশ করে। আদনান শব্দটাকে কোনো চেনা পশু-পাখির ডাকের সাথে মেলাতে পারে না। শব্দটা পরিচিত, কিন্তু কীসের শব্দ, সে তা মনে করতে পারে না। কিছুটা ভয় ও কিছুটা কৌতূহল নিয়ে আদনান কয়েক হাত দূরের একটা বড় গাছের গোড়ায় থাকা ঝোপের দিকে তাকায়। শব্দটা সেখান থেকেই আসছে বলে তার মনে হয়।
কিন্তু সেখানে বাতাসের স্বাভাবিক দুলুনি ছাড়া বিশেষ কোনো নড়াচড়া দেখা যায় না। গেছোব্যাঙের ডাক হতে পারে বলে ভাবে সে। কিছুক্ষণ বিরতির পর আবার শব্দটা শুরু হলে ঝোপটাকে ইশারা করে আদনান এবার নিচু স্বরে জিসান আর ইমরানকে জিজ্ঞেস করে- ‘ওই ঝোপ থেকে কেমন একটা শব্দ আসছে, তোরা কেউ শুনতে পাচ্ছিস?’
কান পেতে শব্দটা শোনার চেষ্টা করে জিসান ও ইমরান। তারপর একবার করে নিজেদের মধ্যে দৃষ্টিবিনিময় করে। প্রথমে ইমরান উত্তর দেয়, ‘হ্যাঁ, শুনতে পাচ্ছি তো! গেছোব্যাঙের ডাক মনে হচ্ছে। আয় তো কাছে গিয়ে দেখি।’ ‘আরে না, আমার কাছে মনে হচ্ছে কোনো বড় সাপ নিশ্বাস ফেলছে। অনেক মুভিতে দেখেছি বড় বড় অজগর ও অ্যানাকোন্ডা এমন করে নিশ্বাস ফেলে’, ইমরানের কথাকে নাকচ করে দিয়ে জিসান নিজের মতামত জানায়।
‘ধুর, কী যে বলিস জিসান! সুন্দরবনে অ্যানাকোন্ডা আসবে কোত্থেকে। হ্যাঁ অজগর আছে ঠিক, কিন্তু অজগর এই সময়ে মানুষের গন্ধ পেয়েও এমন জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলতো না। আর ঝোপটা একটু হলেও নড়াচড়া করতো। আজেবাজে বকিস না শুধু শুধু।’, আদনান এবার জিসানকেও নাকচ করে দিলে তর্ক বেঁধে যায়।
আদনান আর জিসানের তর্কাতর্কি শেষ হওয়ার আগেই ইমরান বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। ঝোপের দিকে হাঁটতে শুরু করে। জিসান আর আদনান পৌঁছানোর আগেই দ্রুত ও পাতলা পদক্ষেপে ইমরান ওই গাছ ও ঝোপের কাছে পৌঁছে যায়। পৌঁছে যা দেখে তাতে সে হতভম্ব না হয়ে পারে না। হতভম্ব ইমরানের আশ্চর্য ও বিস্ফারিত দৃষ্টি অনুসরণ করে আদনান ও জিসান দ্রুত সেখানে পৌঁছে যায়।
তারপর অবাক বিস্ময়ে তিনজন আবিষ্কার করে- তারা এতক্ষণ ধরে চিৎকার করে করে যাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে, যার জন্য চিন্তায় তিন বন্ধু অস্থির, যার বিপদের আশঙ্কায় সবাই ভয়ে জড়সড়, তাদের সেই বন্ধু মিঠু এই ঝোপে চিতপটাং হয়ে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। ‘বন্ধুটা যখন মিঠু, তখন তার দ্বারা সবই সম্ভব’ –এক হিরোর ডায়লগের সাথে মিলিয়ে রাখা কথাটা মনে পড়তেই তাদের অবাক-বিস্ময় ও হতভম্ব ভাব কেটে যায়। তারপর সবকিছু ভুলে, এমনকি মিঠুকে ডাকতে ভুলে গিয়ে তিন বন্ধু একসাথে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে।
সে হাসিতে মিঠু ধড়ফড় করে জেগে ওঠে। কিন্তু নিজের অবস্থান সম্পর্কে ধাতস্থ হতে তার কয়েক মুহূর্ত লেগে যায়। মিঠু জেগে উঠেছে দেখে তারা হাসিতে বিরতি দেওয়ার চেষ্টা করে। তবে পারে না। নাক ডাকার এমন আশ্চর্যজনক সুফলের কথা ভেবে তিনজন মিলে আরও একবার শব্দ করে হেসে ওঠে। ঘুমাতে ঘুমাতে মিঠু নাক না ডাকলে তাকে খুঁজে পেতে যে আরও কত সময় লেগে যেত, সে কথা চিন্তা করে তাদের সেই অট্টহাসি বন্ধ হতে হতে আরও একটু সময় লেগে যায়।
অপরদিকে বেচারা মিঠু, মৌমাছির তাড়া খেয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বিশ্রামের জন্য এখানে বসে ঘুমিয়ে পড়ার কথা মনে করে লজ্জিত ও নত মুখে থতোমতো ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বন্ধুদের হাসির উপলক্ষ্য হয়েও সে তাদের সম্মিলিত হাসিতে যোগ দিতে পারে না।
তবে সবার সব হাসি মুছে যেতে খুব বেশি সময় লাগেনি। পৃথিবীর বৃহত্তম এই ম্যানগ্রোভ বনের কাঁদা-জলে বেড়ে উঠা শ্বাসমূলের ফাঁকে ফাঁকে লুকানো অপার্থিব রহস্যের পাশাপাশি তার যে এক ভয়ঙ্কর রূপও লুকিয়ে থাকে, কিশোরদলের তা জানা ছিল না। সুন্দরী, কেওড়া, গরান ও হোগলার বনের পরতে পরতে- আনন্দ ও বেদনা দুটোই যে হাত ধরাধরি করে জড়িয়ে থাকে, তা হয়তো তাদের বইয়ের পাতায় কখনো পড়া হয়নি।
তাই সুন্দরবনের সেই ভয়ঙ্কর রূপের দেখা পাওয়ার পর এবং আনন্দময় রোমাঞ্চকর ভ্রমণ তাদেরকে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়ার পর, তাদের সব হাসি-আনন্দ ফিকে হতে শুরু করে। সময়ের সাথে সাথে তাদের সব খুশি একসাথে মুছে যেতে থাকে।
মিঠুকে খুঁজে পাওয়ার পর যখন তাদের বাড়ি ফেরার কথা মনে পড়ে, ছায়াঘন গহনবনে তখন দিনের শেষ আলোটুকুও শেষ হওয়ার পথে। তাড়া খেয়ে দৌড়ানোর পরিশ্রম, মৌমাছির কামড়ের ব্যথা আর সব শেষে মিঠুকে খোঁজার ক্লান্তি নিয়ে চার বন্ধু বাড়ি ফেরার জন্য হাঁটতে শুরু করে। আগের মতো ছোট ছোট গাছ আর ঘাস মাড়িয়ে, বিভিন্ন জাতের পোকামাকড় ও পিঁপড়া মাড়িয়ে, কাঁটায় জামা ছিঁড়ে, হোঁচট খেয়ে চামড়া ছিলে চার কিশোর হাঁটতে থাকে।
হাঁটতে হাঁটতে তারা নানা ঘটনা নিয়ে কথা বলে। মিঠুর ঘুম নিয়ে মজা করে। বাড়ি ফেরার বাস পাবে কি না, সে চিন্তা করে। বাস না পেলে অন্য কোন গাড়িতে গেলে তাড়াতাড়ি ফেরা যাবে, সেসব নিয়ে তর্ক করে। ভাড়ার জন্য কার কাছে কত টাকা আছে, সেসব হিসাব করতে করতে তারা হাঁটতে থাকে।
তাদের ক্লান্ত শরীর আরও ক্লান্ত হয়ে যায়। তর্ক শেষ হয়ে যায়। টাকার হিসাব মিলে যায়। কিন্তু মৌয়ালদের সেই চিহ্নিত চলার পথ আর খুঁজে পাওয়া যায় না। অনন্তকাল ধরে যেন তারা হেঁটে চলে আর তাদের বাড়ি ফেরার পথ আরও দূরে, বহু দূরে সরে যেতে থাকে।
আদনানের মনে হয়- দানবীয় সব গাছপালা নিয়ে তাদেরকে চারপাশ থেকে ঘিরে আছে মহাকাশ। তাদের পায়ের নিচে শুয়ে আছে ছায়াপথ। এই পথে তারা আলোকবর্ষ ধরে হাঁটতে থাকবে, হাঁটতে থাকবে এবং হাঁটতেই থাকবে। এই পথ কোনোদিনও ফুরাবে না। এসব ভাবনার মাঝে হঠাৎ যেন ঝুপ করে অথবা চুপ করে অন্ধকার নেমে যায়। তাদের দৃষ্টিসীমা সংক্ষিপ্ত হয়ে আসে। কয়েক হাত দূরেও আর দেখা যায় না।
চলবে...