অনূদিত গল্প
আমরা শুরু করি ‘ডাক্তার-রোগী খেলা’। নানি হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়ার ভান করেন। আমরা তখন তাকে ধরে বিছানায় রোগীর মতো করে শুইয়ে দিই।
Published : 25 Oct 2024, 02:56 AM
১৯৯৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী টনি মরিসনের লেখা ৮টি গল্পের বই নিয়ে সংকলন ‘অ্যা টনি মরিসন ট্রেজারি’, ২০২৩ সালে এটি প্রকাশ করে মার্কিন প্রকাশনী সংস্থা ‘সাইমন অ্যান্ড শুস্টার’। আজ প্রকাশিত হলো তার অনূদিত পঞ্চম পর্ব।
দুপুর বারোটার সময় মটরশুঁটি, গাজর আর মাছের চপ দিয়ে দুপুরের খাবার। বেলা একটা পনেরো মিনিটে ঘুম। দুইটা পঁচিশ মিনিটে খেলাধুলা। বিকাল চারটার টেলিভিশন দেখা।
সন্ধ্যা পাঁচটায় হট ডগ, ম্যাকারনি আর পনির দিয়ে রাতের খাবার। সাড়ে ছয়টার সময় গোসল। সোয়া সাতটার সময় গ্রানোলা বার দিয়ে হালকা খাবার। রাত সাড়ে সাতটায় ঘুমাতে যাওয়া।
এমনই আঁটসাঁট একটা কাজের সূচি ফ্রিজের গায়ে টাঙিয়ে দিয়ে মা আমাদের তিন ভাই বোনকে নানির জিম্মায় রেখে কাজে গেলেন।
নানির কাছে থাকাটা আমাদের জন্য সবসময়ই অনেক রোমাঞ্চকর। আমরা প্রত্যেকটা মুহূর্ত উপভোগ করি। নানি আমাদের মোটেও বিরক্ত হতে দেন না। নানির বাসাটাকে আমাদের কাছে একটা রূপকথার জগৎ মনে হয়। আর নানি হচ্ছেন সে জগতের ইচ্ছে পরি, যিনি যা খুশি তাই করতে পারেন। আর যা-ই করেন সেটাই হয় অনেক মজার।
নানির সঙ্গে ঘুমানোটা অত্যন্ত আনন্দদায়ক। আমরা টেরই পাই না যে কখন ঘুমিয়ে পড়ি! কারণটা কী? নানি ঘুমপাড়ানি গান গেয়ে, গল্প বলে আমাদের ঘুম পাড়ান। তাই আমরা ঘুমের মধ্যে মজার মজার সব স্বপ্ন দেখি।
নানি হাত পা নেড়ে এমনভাবে গল্পটা করেন, যেন গল্পের চরিত্ররা সব আমাদের সামনে উপস্থিত হয়। তার বাসা ভর্তি হয়ে যায় পরি আর ড্রাগন দিয়ে। সিঁড়ির নিচে আমরা কার যেন খসখস আওয়াজ শুনতে পাই। সোনার মোহর ভর্তি হাড়ি কলসি ঘরের কোণে চকচক করে।
তারপর হাসতে হাসতে একটা ইঁদুর এসে হাজির হয়। আর বাসার চিমনি দিয়ে পুদিনা পাতার রঙের ধোঁয়া বের হতে শুরু করে। এগুলো দেখে শুনে মনে হয় আমরা যেন আসলেই কোন রূপকথার রাজ্যে ঢুকে পড়েছি।
গল্প শেষ হতেই শুরু হয় খেলা। আমরা সবাই মিলে বাড়ির আঙিনায় একসঙ্গে হই। নানি অতি যত্নে চাল ডাল আনার পুরোনো বস্তাগুলো জমিয়ে রাখেন আমাদের জন্য। তারপর নানি আমাদের প্রত্যেককে একটা করে সেই পুরোনো বস্তা ধরিয়ে দেন।
আমরা সবাই এক একটা বস্তার মধ্যে ঢুকে পড়ি। তারপর বস্তার কানা ধরে ব্যাঙের মতো লাফ দিয়ে দিয়ে সামনের দিকে এগোতে শুরু করি। এটাকে আমরা বলি ‘গাড়ি গাড়ি খেলা’। নানির বাসায় খাবার খেতে আমাদের মোটেও খারাপ লাগে না। কারণ কী? নানি আমাদের জন্য সবসময়ই নতুন নতুন খাবার তৈরি করেন।
তারপর আমরা শুরু করি ‘ডাক্তার-রোগী খেলা’। নানি হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়ার ভান করেন। আমরা তখন তাকে ধরে বিছানায় রোগীর মতো করে শুইয়ে দিই। তার কপালে হাত দিয়ে জ্বর মাপি। তারপর তার মাথায় পানি ঢালি। তার পায়ের পাতায়, নাকের ডগায় ব্যান্ড-এইড লাগিয়ে দিই।
আমরা তখন তাকে বিশ্রাম নিতে বলি। আর খেলনা স্টেথোস্কোপ দিয়ে তার নাড়ি পরীক্ষা করি। তারপর আমরা তাকে ভিটামিন বড়ি খেতে দিই। তাকে অভয় দিই আর বলি, আমরা তোমাকে সুস্থ করে তুলবোই। তারপর আমরা তাকে রোগীর বিছানা থেকে তুলি। আমাদের হাত ধরে এক পা এক পা করে হাঁটতে বলি। এভাবেই নানি আবার সুস্থ হয়ে উঠেন।
তারপর কী? আমরা সবাই দলবেঁধে মেঝেতে বসে পড়ি। মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আমরা কার্ডবোর্ডের তৈরি দুটো বিড়ালের ছবির ধাঁধাটা মেলানোর চেষ্টা করতে থাকি। আমাদের মধ্যে কেউ একজন বিড়ালের পা খুঁজে পাই। আবার কেউ একজন পাই বিড়ালের গোঁফটা। কেউ একজন খুঁজে পাই বেড়ালের খেলনাটা।
কিন্তু সেটা আবার রঙের সঙ্গে মিলে না। তখন আমরা বুঝি যে তাড়াহুড়ো করলে ধাঁধাটা মিলবে না। আমরা একটা একটা করে টুকরো খুঁজে নিয়ে সেটা মেলানোর চেষ্টা করতে থাকি।
তারপর নানি আমাদের তাড়া দেন। চলো চলো, চলো সবাই। তোমাদের মায়ের ফেরার সময় হয়ে গেলো। আমরা সবাই মিলে এখন আমার সেই বিখ্যাত মাখনের মিষ্টিটা বানাবো, যার নাম ‘পেনি বাটার ফাজ’। এই রান্নাটা আমি শিখেছিলাম আমার মায়ের কাছ থেকে। আবার আমি তোমার মাকে শিখিয়ে দিয়েছি। তারপর তোমরা তোমাদের মায়ের কাছ থেকে শিখে নেবে। এভাবেই চলতে থাকবে।
আমরা উত্তেজনায় কাঁপতে থাকি। আমরা কি মা আসার আগেই মিষ্টিটা বানিয়ে শেষ করতে পারবো?
আমরা সারা বাড়ি মাথায় তুলে রান্নায় ব্যস্ত হয়ে পড়ি। সবাই মিলে হাত লাগিয়ে মা আসার আগেই মিষ্টিটা বানিয়ে ফেলি। নানি খুশি হয়ে আমাদের সবাইকে একসঙ্গে জড়িয়ে ধরেন। আর আমরা সবাই এক এক করে নানিকে চুমু দিতে থাকি।
নানির মিষ্টিটার নাম ‘পেনি বাটার ফাজ’। উনি আমাদের শিখিয়ে দিয়েছেন কীভাবে সেটা রান্না করতে হয়। আমরাও তোমাদের শিখিয়ে দিচ্ছি যাতে করে তোমারও সেটা রান্না করতে পারো। শুরুতেই কী কী উপাদান লাগবে তার একটা তালিকা দিই।
আমাদের লাগবে এক টেবিল চামচ মাখন, এক কাপ দুধ আর দুটো চকোলেটের টুকরো। দুই কাপ চিনি, এক চা চামচের চার ভাগের এক ভাগ ভ্যানিলা আর চিনাবাদামের মাখন। ব্যস। এছাড়াও লাগবে আট ইঞ্চি বর্গাকার একটা কেক বানানোর কড়াই। একটা সসপ্যান, কাঠের চামচ, একটা কাচের গ্লাসভর্তি পানি, একটা বড় কড়াই ভর্তি ঠান্ডা পানি আর একটা ধারালো চাকু।
তবে মনে রাখতে হবে এটা তৈরি করতে অবশ্যই একজন বড় মানুষের সাহায্য লাগবে। শুরুতেই কেক বানানোর কড়াইটার ভেতরের দিকটাই মাখন মাখিয়ে পাশে রেখে দিতে হবে। তারপর একটা কড়াইতে দুধ আর চকোলেটের টুকরো দুটো নিয়ে অল্প আঁচে হালকা নেড়ে গলিয়ে মিশিয়ে নিতে হবে।
তারপর চিনি মিশিয়ে আরো একটু নাড়তে হবে। মিনিট পাঁচেক অল্প তাপে নেড়ে মিশ্রণটা থেকে একটা ফোঁটা নিয়ে গ্লাসের ঠান্ডা পানির মধ্যে ফেলে সেটা পরীক্ষা করে নিতে হবে। যতক্ষণটা গ্লাসের পানিতে সেটা ব্যাঙাচির মতো দানা না তৈরি করতে ততক্ষণ কড়াইতে নাড়তে থাকতে হবে।
তারপর কড়াইটাকে চুলা থেকে নামিয়ে ভ্যানিলা মিশিয়ে নাড়তে হবে। কড়াইটাকে বড় কড়াইয়ের পানিতে রেখে ঠান্ডা করে নিতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে যেন কোনোমতেই কড়াইতে পানি না ঢুকে পড়ে। তারপর বড় মানুষটা কড়াইয়ের গায়ে হাত দিয়ে দেখবেন সেটা পুরোপুরি ঠান্ডা হয়েছে কিনা!
তারপর চিনাবাদামের মাখনটা কড়াইতে ঢেলে আবারও ভালোভাবে মিশিয়ে নিতে হবে যাতে আর সেটা আলাদাভাবে চেনা না যায়। মিশ্রণটাকে কেক বানানোর কড়াইতে ঢেলে ঠান্ডা করে নিতে হবে। ঠান্ডা হওয়ার ছুরি দিয়ে সেগুলোকে কেটে নিতে হবে। এভাবেই তৈরি হয়ে যাবে মজাদার ‘পেনি বাটার ফাজ’।