অনূদিত কবিতা
গ্লুকের লেখা একই সঙ্গে বিমূর্ত ও সরল। মনের উপর গাঢ় প্রভাব সৃষ্টি করে আত্মাকে নিবিড়ভাবে অনুসন্ধানে উসকে দেয়।
Published : 13 Sep 2024, 10:01 PM
২০২০ সালে সাহিত্যে নোবেল অর্জনের পর পৃথিবীব্যাপী লুইজ গ্লুকের নতুন পরিচিতির জায়গা তৈরি হয়। কিন্তু কবি হিসেবে তিনি আত্মপ্রকাশ করেছিলেন ষাটের দশকের শেষভাগেই, প্রথম কবিতার বই ‘ফার্স্টবর্ন’ (১৯৬৮) প্রকাশের মধ্য দিয়ে। ঘুরেফিরে তার কবিতায় যেসব বিষয়বস্তু বারবার এসেছে তা হচ্ছে ব্যক্তিগত বেদনাবোধ, ক্ষতি, একাকিত্ব এবং আত্মোপলব্ধি।
তবে যে বিষয়টি তার কবিতাকে স্বতন্ত্র-স্বর দিয়েছে তা হলো গভীর সংবেদনশীলতা। তার কবিতা পড়লে বোঝা যায়, এগুলোর বেশিরভাগই ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে উৎসারিত। পাশাপাশি সেখানে বহুমাত্রিক অনুভূতি ও জীবনের নানা দিক উপস্থিত। প্রাচীন গ্রিক মিথোলজি, পারিবারিক সম্পর্ক ও প্রকৃতি- এই তিনটি বিষয় তার লেখালেখিকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছে।
গ্লুকের কবিতার এক অনবদ্য টোনালিটি রয়েছে, এটি ব্যক্তির অস্তিত্বকে সর্বজনীন করে তোলে। নব্বই দশকের গোড়ার দিকে দুই বছরের ব্যবধানে প্রকাশিত হয় তার ফ্ল্যাগশিপ- ‘দ্য ওয়াইল্ড আইরিস’ (১৯৯২) এবং ‘আরারাট’ (১৯৯০)। সমালোচকদের মতে, এ দুটি বই-ই তাকে আধুনিক কবিতার অন্যতম শীর্ষস্থানীয় কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
ব্যক্তিগত ও সর্বজনীন, এই দুই অনুভূতির একটা ভারসাম্য তার কবিতায় পাওয়া যায়। এই বিশেষ ভঙ্গিটি তাকে তার সময়ের (বিশ শতকের) অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কবি হিসেবে স্বীকৃতি এনে দেয়। গবেষকরা মনে করেন, গ্লুকের কবিতার গভীর আধ্যাত্মিকতা পাঠককে এক ধরনের ইমোশনাল জার্নির ভেতর দিয়ে নিয়ে যায়। জীবনের নানা দুঃখ-বেদনার সঙ্গে মোকাবেলা করে যেখানে সন্ধান করা হয় আশার।
গ্লুকের লেখা একই সঙ্গে বিমূর্ত ও সরল। মনের উপর গাঢ় প্রভাব সৃষ্টি করে আত্মাকে নিবিড়ভাবে অনুসন্ধানে উসকে দেয়। একইসঙ্গে তার শব্দের নিস্তব্ধতার শক্তি স্পর্শ করে হৃদয়ের সবচেয়ে গভীরতম অনুভূতিকে।
আমেরিকান এই কবির জন্ম নিউ ইয়র্কে, ১৯৪৩-এর ২২ এপ্রিল। মৃত্যুবরণ করেন ২০২৩-এর ১৩ অক্টোবর। পেশাগত জীবনে অধ্যাপনা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানে তার তিনটি কবিতা অনূদিত হলো-
ছোটদের একটি গল্প
লোকজ জীবনে পরিশ্রান্ত
এক সম্রাট-সম্রাজ্ঞী ফিরে আসছিল শহরে।
আর তাদের গাড়ির পেছনে থাকা
প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরা ছোটো ছোট রাজকুমারীরা
গেয়ে যাচ্ছিল অস্তিত্বের গান,
আমি এখানে আর সেখানে তুমি
ওই যে ছেলেটি— সে খুব খুশি
আর ওই যে মেয়েটি— তার খুব মন খারাপ।
গাড়ির ভেতরে থাকা প্রত্যেকেই পৃথক পৃথিবী,
কেউ কাউকে ছুঁতে পারছে না।
ভবিষ্যতের কথা কে বলতে পারে?
আগামীকাল কী ঘটবে, কেউ তা কিচ্ছু জানে না।
এমনকি জানে না ওই গ্রহরাও,
তারপরও এসবের মধ্যেই
বেঁচে থাকতে হবে রাজকুমারীদের।
দিনগুলো কী ভয়ংকর বিষাদে ভরে উঠছে!
গাড়ির বাইরে গরু আর তাকে ধারণ করা মাঠ
দুই-ই সরে যাচ্ছে দূরে।
তাদের দেখাচ্ছে শান্ত
কিন্তু শান্ত তো সত্য নয়।
কেবল হতাশাই সত্য,
মা-বাবা এটাই শুধু জানে।
আশারা সব হারিয়ে গিয়েছে
যদি খুঁজে পেতে চাই আবার তাদের,
তাহলে আমাদেরকে ফিরে যেতে হবে সেখানে,
যেখানে তারা হারিয়ে গিয়েছিল।
ডুবতে থাকা বাচ্চারা
তুমি দেখছো, ওদের মধ্যে কোনো বিচারবোধ নেই।
ফলে ওরা ডুবে যাবে এটাই তো স্বাভাবিক।
প্রথমে বরফ ওদেরকে গিলে ফেলবে
আর তারপর, পুরোটা শীতকাল জুড়ে
ওদের উলের মাফলারগুলো ভেসে থাকবে পেছনে
যে অবধি ডুবতে ডুবতে ওরা নিথর হয়ে যায়।
তারপর, পুকুর তার অন্ধকার বাহু দিয়ে আলিঙ্গন করবে ওদের।
কিন্তু ওদের কাছে মৃত্যুর আসা উচিত ভিন্নভাবে
যেন শুরুর সময়টার কাছাকাছি
যেন ওরা সবসময়ই ছিল অন্ধ আর ওজনহীন।
তাই যা কিছু বাকি, তা স্বপ্নের মতো—
প্রদীপ, টেবিল ঢেকে রাখা শুভ্র কাপড়,
ওদের শরীর।
তবুও ওরা শুনতে পায় ওদের নাম
যে নাম ধরে ওদের আগে থেকেই ডাকা হতো
যেন তা পুকুরের ওপর আছড়ে পড়া কোনো টোপ,
কীসের জন্য অপেক্ষা করছ
বাড়ি ফিরে এসো, ফিরে এসো ঘরে,
হারিয়ে গেছ জলে, নীল এবং চিরস্থায়ী।
মা ও সন্তান
স্বপ্নদ্রষ্টা আমরা সবাই;
কিন্তু জানি না— আমরা কারা।
কিছু যন্ত্র আমাদেরকে তৈরি করেছে;
এই পৃথিবীর যন্ত্র— আবদ্ধ এক পরিবার।
তারপর পৃথিবীতে ফিরে এসে
নরম চাবুকের আঘাতে হয়েছি মসৃণ।
আমরা স্বপ্ন দেখি, কিন্তু তা মনে রাখি না।
পরিবারের যন্ত্র: গাঢ় পশম, মাতৃ-শরীরের অরণ্য।
মায়ের যন্ত্র: যার অভ্যন্তরে সাদা এক শহর।
এবং তার আগে: মাটি ও পানি।
পাথরের ভাঁজে ভাঁজে শ্যাওলা,
টুকরো পাতার দল আর ঘাস।
আর তার আগে, জমকালো অন্ধকারে কোষ।
তারও আগে, এই পর্দাঘেরা পৃথিবী
এ কারণেই জন্মেছিলে তুমি
আমাকে নিশ্চুপ করে দিতে।
আমার বাবা এবং মায়ের কোষ,
এবার তোমার পালা,
মৌলিক হতে আর মাস্টারপিস হতে।
আমি উন্নত হয়েছি; কিন্তু কখনোই মনে রাখিনি।
এবার তোমার পালা চালিত হওয়ার,
তুমি সেইজন— যে দাবি তুলতেই পারে জানতে;
কেনো আমাকেই ভুগতে হয়?
কেনই বা এতোটা অবোধ আমি?
মহান অন্ধকারের কোষ।
কিছু মেশিন আমাদেরকে বানিয়েছে;
এ নিয়ে এবার তোমার মুখ খোলার পালা,
ফিরে গিয়ে জিজ্ঞেস করার উপযুক্ত সময়
কেনো আমি? কীসের জন্য?