ভ্রমণগদ্য
সুইজারল্যান্ডের জুরিখ শহরে ৫০০ বছরের পুরোনো বিদ্যাপীঠ ‘ইউনিভার্সিটি অব জুরিখ’। এটি দেখার আগ পর্যন্ত আমি জানতাম না, এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান টুরিস্ট আকর্ষণের অন্তর্ভুক্ত।
Published : 28 May 2024, 03:32 PM
পৃথিবীর প্রাচীন বিদ্যাপীঠের কথা বললে আসবে মরক্কোর আল-কারাওইন, মিশরের আল-আজহার, ইরাকের আল-নিজামিয়া ও ইউরোপের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় ইতালির বোলোনিয়ার নাম। এগুলো একইসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় ও পর্যটনকেন্দ্র। এই তালিকায় কেউ কেউ অক্সফোর্ড, ক্যামব্রিজ কিংবা হার্ভার্ডকেও যুক্ত করবেন হয়তো।
পৃথিবীর যে কোন অঞ্চলে সমাধিক্ষেত্র আর পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয় আমার ভ্রমণ তালিকায় রাখার চেষ্টা করি। বিশ্বভ্রমণ তালিকার ফর্দ এত লম্বা থাকে যে সব সময় বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন তালিকায় রাখা সম্ভব হয় না, ইচ্ছে থাকলেও। ইউরোপের দেশগুলোতে দুশো-তিনশ বছরের পুরোনো কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি অল্প সময় পার করেছি। সেইসব অভিজ্ঞতা থেকে আজ বলবো সুইজারল্যান্ডের ‘ইউনিভার্সিটি অব জুরিখ’ ঘুরে দেখবার গল্প।
সুইজারল্যান্ডের জুরিখ শহরে ৫০০ বছরের পুরোনো বিদ্যাপীঠ ‘ইউনিভার্সিটি অব জুরিখ’। এটি দেখার আগ পর্যন্ত আমি জানতাম না, এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান টুরিস্ট আকর্ষণের অন্তর্ভুক্ত। যারা ইতোমধ্যে সুইজারল্যান্ড ভ্রমণ করেছেন, কারো কাছে কখনও শুনিনি জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয় ভিজিটের কথা। পরে হোটেলে এসে ‘সিটি ট্যুর গাইডের’ পাতা উল্টানোর সময় দেখলাম সেটা। সে যাই হোক, এখন মূল কথায় আসি।
ইউরোপ ভ্রমণে বের হয়েছি আমি আর আমার গৃহবন্ধু। মাত্র দুদিন হলো জুরিখ শহরে এসেছি। বেশ ঘোরাঘুরি হয়েছে। সেদিন সকালে নাস্তা করার পর হোটেলে বসে গুগল সার্চ করলাম, দেখলাম হোটেল থেকে ১২ মিনিটের পথ। রওনা হলাম।
রাস্তার ওপাশ থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম মেলা সিঁড়ি পার হয়ে তবেই পুরো ইউনিভার্সিটির দেখা পাওয়া যাবে। এমনিতেই আমরা শারীরিকভাবে ক্লান্ত ছিলাম- রোম, ভেনিস আর জুরিখ ঘুরে। সেসব জায়গায় অনেক হাঁটতে হয়েছে। কী আর করা, ভালো কিছুর দেখা পেতে হলে একটু কষ্ট করতে হয়। শক্তি ও সাহস সঞ্চয় করে এগোতে থাকলাম।
পাথরের সিঁড়ি, তার উপর পড়ে থাকা সোনালি রঙের ম্যাপলের পাতা ওপরে উঠার ক্ষেত্রে উৎসাহ যোগাচ্ছিল। ইউনিভার্সিটির অবস্থান দেখে আমার মনে হচ্ছিল, কোন পুরোনো শহরের ক্যাসেলের মতো, এত উঁচুতে।
তিন ধাপ পাথরের সিঁড়ি ভেঙে গিয়ে পৌঁছলাম মূল ভবনের কাছে। আমাদের দেশের ১৪/১৫ তলা সিঁড়ি ভাঙার মতো মনে হলো আমার কাছে। মূল ভবনের কাছে যাবার আগেই বুঝতে পারলাম, কেন এটি টুরিস্ট আকর্ষণের মধ্যে পড়েছে। পুরো জুরিখ শহরের ৩৬০ ডিগ্রি প্যানারমিক ভিউ দেখা যায় জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের বিশাল খোলা জায়গা থেকে।
তার আগের দিন উটেনবার্গ পাহাড়ের আড়াই হাজার ফুট উঁচু থেকে জুরিখের যে ভিউ দেখতে পাচ্ছিলাম তার কাছাকাছিই লাগছিল আমার কাছে। অনেক টুরিস্টের সমাগম দেখতে পেলাম সেই খোলা জায়গাটার মধ্যে, সবাই ছবি তোলায় ব্যস্ত। আমরাও কিছু সময় সেখানে থেকে তারপর মূল ইউনিভার্সিটি ভবনের দিকে গেলাম।
যে ভবনটিতে দর্শনার্থীদের প্রবেশের অনুমতি আছে সেখানে বড় বড় ৩/৪ সেমিনার হল চোখে পড়ল। বড় না বলে বিশাল বলা ভালো। ইউনিভার্সিটির পরিচিতি, ইতিহাস সম্বলিত একটি কক্ষ দেখলাম, যেখানে ১২ জন নোবেল বিজয়ীর নাম লেখা আছে- আইনস্টাইনসহ যারা বিজ্ঞান, গণিত, ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় বিভিন্ন সময়ে নোবেল পুরস্কার লাভ করেছেন।
আইনস্টাইন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন ১৯০৯ থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত। বাকি ১১ জন কেউ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, কেউবা শিক্ষক ছিলেন। সিঁড়ি ভাঙার সমস্ত কষ্ট নিমেষেই উবে গেলো।
সেই কক্ষ থেকে বেরিয়ে একটু সামনের দিকে একটা দরজা দেখতে পেলাম, সেই দরজা দিয়ে বাইরের দিকে গেলাম। সেটি হলো অন্য এলাকা থেকে প্রবেশদ্বার। মানে ইউনিভার্সিটি অব জুরিখ শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত এবং শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে ইউনিভার্সিটিতে প্রবেশের উপায় রয়েছে। রাস্তার ওপারে দেখতে পেলাম ইউনিভার্সিটি অব জুরিখের হাসপাতাল, যেখানে ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীরা বিনামূল্যে চিকিৎসা নিতে পারেন।
এ ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাকাল ১৫২৫। বিভিন্ন অনুষদে মাত্র ১৬১ জন ছাত্র এবং ৫৫ জন শিক্ষক নিয়ে এর যাত্রা শুরু। যুক্তরাজ্যের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল ১৯৪৬ সালে ইউনিভার্সিটি অব জুরিখ পরিদর্শন করেছিলেন। তার বক্তৃতার একটি অংশ খুব জনপ্রিয় হয়েছিল সেসময়, ‘লেট ইউরোপ অ্যারাইজ’।
চার্চিলের সেই স্বপ্নদর্শী বাক্য পরবর্তীতে ইউরোপ সফল করে দেখিয়েছে। ইউনিভার্সিটি অব জুরিখের কিছু জানা, কিছু অজানা স্মৃতি নিয়ে ফিরলাম সেই পাথরের সিঁড়ি দিয়ে। ২/৩ ঘণ্টার পরিদর্শনে হয়তো অল্পকিছু কৌতূহল নিবারণ হয়। সেটিকে কোনভাবেই জেনেছি বা দেখেছি বলা যায় না। এই অতৃপ্তিগুলোই হয়তো জীবনকে আরও সুন্দর করে।
আইনস্টাইনের বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে দেখবার স্মৃতি রোমন্থন করতে আমার ভীষণ ভালো লেগেছে। জানি না, আপনাদের কেমন লাগলো। এরপর জুরিখ ভ্রমণে গেলে, ইউনিভার্সিটি অব জুরিখে একটু ঢুঁ দেবেন আমার মতো। ভালো লাগবে এই বিষয়ে আমার একেবারেই সন্দেহ নেই!