কানাডিয়ান মানবাধিকার জাদুঘর, ইতিহাসের জীবন্ত গল্পে

কানাডার ম্যানিটোবা প্রভিন্সের রাজধানী উইনিপেগ। উইনিপেগ শহরের প্রাণকেন্দ্রে প্রায় ৬ একরের বিশাল জায়গাজুড়ে অবস্থান এ জাদুঘরের।

রাশেদুর রহমান রাশিবরাশেদুর রহমান রাশিবউইনিপেগ, কানাডা থেকে
Published : 8 Nov 2022, 07:24 PM
Updated : 8 Nov 2022, 07:24 PM

কানাডার ম্যানিটোবা প্রভিন্সের রাজধানী উইনিপেগ। এখানে এমন এক জায়গার সন্ধান পেয়েছি যেখানে কানাডিয়ানরা বিশাল এক জাদুঘর বানিয়ে রেখেছে। ‘কানাডিয়ান মিউজিয়াম ফর হিউম্যান রাইটস’ নামে এটি পৃথিবীর অন্যতম নান্দনিক স্থাপনা।

এইতো কিছুদিন আগে ঘুরে আসার সুযোগ হয়েছে পুরাতাত্ত্বিক এ নিদর্শন-কেন্দ্র থেকে। গত কয়েক শতাব্দীর বিশ্ব ইতিহাসের নানা ঘাত-প্রতিঘাতের গল্প উঠে এসেছে এর প্রতিটি দেয়ালে। ইতিহাসের হাজারও জীবন্ত গল্প লেখা আছে এর প্রতিটি পরতে, তাইতো তার আবেদনই অন্যরকম।

একটি দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য জানার অন্যতম মাধ্যম হলো জাদুঘর ভ্রমণ। তবে ‘কানাডিয়ান মিউজিয়াম ফর হিউম্যান রাইটস’ কেবল নিজের দেশের মানবাধিকারের ইতিহাস নয় বরং বিশ্ব ইতিহাসে মানবাধিকারের প্রায় সবগুলো অধ্যায়কে একসঙ্গে দেখানোর চেষ্টা করেছে।

উইনিপেগ শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থান এ জাদুঘরের। টরেন্টো বা মন্ট্রিয়লের তুলনায় ছোট্ট শহর উইনিপেগের প্রাণকেন্দ্রে এ সুবিশাল জাদুঘর কিছুটা বাতিঘরের মতোই। তাইতো করোনাভাইরাস মহামারীর নিয়ম-কানুন কিছুটা শিথিল হতেই আমাদের ঘুরতে আসা। ২০১৪ সালে স্থাপিত এ জাদুঘরের উদ্যোক্তা ছিলেন কানাডার বিখ্যাত আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ ইজ্জি এস্পার। ‘রেড রিভার’ নদীর তীরে আইকনিক এ স্থাপনার স্থপতি অ্যান্টনি প্রেডক।

জাদুঘরের মূল ফটকের কাছাকাছি যেতেই চোখে পড়ল মহাত্মা গান্ধীর এক ব্রোঞ্জের মূর্তি। জাদুঘরে দশটি মূল গ্যালারি রয়েছে। গেট পেরিয়ে প্রথমেই যে গ্যালারিতে আমরা পৌঁছলাম, সেই গ্যালারির মূল প্রতিপাদ্য- ‘মানবাধিকার কী?’ বিভিন্ন সময় মানবাধিকার নিয়ে যত সংগ্রাম, যত সংঘাত, তার এক অপূর্ব চিত্রায়ন আছে এতে। পরের গ্যালারির মূল বিষয়- ‘কানাডিয়ান আদিবাসীদের অধিকার ও তাদের সংগ্রাম’। গত বছর ২৭ মে কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার পরিত্যক্ত ‘কামলুপস ইন্ডিয়ান রেসিডেন্সিয়াল স্কুল’-এ ২১৫ শিশুর গণকবর খুঁজে পাওয়ার বিষয় থেকে শুরু করে তাদের উপর বিভিন্ন অত্যাচার আর সংগ্রামের বিষয় উঠে এসেছে নানা ছবি, লেখা আর ছোট ছোট ভিডিওর মাধ্যমে।

এ গ্যালারির আরেক পাশে ‘কানাডিয়ান জার্নি’ নামে কানাডার ইতিহাসে মানবাধিকার নিয়ে বিভিন্ন মোড় ঘোরানো ঘটনার আলোকপাত রয়েছে- ইনুয়েট আদিবাসীদের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কানাডিয়ানদের ওপর অত্যাচার, চাইনিজদের কানাডায় আসতে নিরুৎসাহিত করতে মাথাপিছু অতিরিক্ত ট্যাক্স এবং আন্ডারগ্রাউন্ড রেলরোড তৈরির সময় দাসদের ওপর অত্যাচারের ইতিহাস ইত্যাদি।

এ গ্যালারিতে এসেই প্রথম জানতে পারলাম ‘কোমাগাতা মারু’ নামের সেই জাহাজের ইতিহাস। ১৯১৪ সালে ৩৭৬ জন ব্রিটিশ-ভারতীয় যাদের অধিকাংশ শিখ সম্প্রদায়ের কানাডার ভ্যাঙ্কুভার বন্দরে এসে পৌঁছে। কিন্তু কানাডিয়ান সরকার বাধ্য করে সেই জাহাজকে ফেরত পাঠাতে এ কারণে যে সেখানে তৎকালীন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নেতারা থাকতে পারে। কলকাতায় ফিরে এলে ব্রিটিশ পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালায় জাহাজে এবং গুলিতে ২২ জন নিহত হন। আজ কানাডার অন্যতম বড় দল নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রধান একজন শিখ সম্প্রদায়ের ভারতীয় বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান।

ছুটির দিন বলে জাদুঘরে অনেক দর্শনার্থীর আগমন হয়েছে। শিক্ষার্থীদের জন্য বছরের কিছুদিন ফ্রি দেখার ব্যবস্থা থাকে, আর এমনিতে টিকিটের দাম কম রাখা হয়। প্রায় ৬ একরের বিশাল জায়গাজুড়ে এ জাদুঘরের অবস্থান। এক গ্যালারি থেকে আরেক গ্যালারিতে যাওয়ার প্রতিটি রাস্তা হুইলচেয়ার-ফ্রেন্ডলি করে বানানো। আমরা পরের যে গ্যালারিতে এলাম সেখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের হলোকাস্টের নির্মম ইতিহাসের বর্ণনা রয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নির্মমতা আর হত্যাযজ্ঞের যে ইতিহাস রচিত হয়েছে তা আগের সব ঘটনাকে হার মানায়। নাৎসি বাহিনী কর্তৃক প্রায় ৬০ লাখ ইহুদি মানুষের গণহত্যার মাধ্যমে রচিত হয় মানবাধিকার ইতিহাসের অন্যতম কলঙ্কের অধ্যায়। গ্যালারির দেয়ালে সে সময়ের ছবি বারবার মনে করিয়ে দেয় ক্ষমতা আর ধর্মের নামে যুগ যুগ ধরে চলে আসা মানবাধিকার লঙ্ঘনের ইতিহাস, যা আজও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে নানাভাবে চলমান।

এছাড়া এ গ্যালারিতে স্থান পেয়েছে আর্মেনিয়ার গণহত্যা, রুয়ান্ডার গণহত্যা ও বসনিয়ার গণহত্যার ইতিহাস। আমি বারবার খুঁজে ফিরছিলাম আমাদের ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আছে কিনা কোথাও। আরও অনেক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ইতিহাসই হয়ত বাদ পড়েছে। তখনই ভাবনায় এলো, আমাদের নতুন প্রজন্ম নিজের দেশে থেকেও কি মুক্তিযুদ্ধের ত্যাগের ইতিহাস, আমাদের গৌরবের ইতিহাস জানতে পারছে! মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ভ্রাম্যমাণ কার্যক্রম একসময় ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল, সবসময় চালু থাকুক এমন কার্যক্রম এটাই প্রত্যাশা।

পরের গ্যালরিতে ঢুকতেই চোখে পড়ল নেলসন ম্যান্ডেলার বিশাল এক আলো জ্বালানো ফ্রেম। মানবাধিকারের মশাল নিয়ে এগিয়ে যাওয়া বেশ কয়েকজন ব্যক্তিকে সম্মানসূচক নাগরিকত্ব দিয়েছে কানাডিয়ান সরকার। এখন পর্যন্ত ৬ ব্যক্তিকে এ সম্মানসূচক নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। ১৯৮৫ সালে সুইডেনের রাউল ওয়ালেনবার্গ, ২০০১ সালে নেলসন ম্যান্ডেলা, ২০০৬ সালে দালাই লামা, ২০০৭ সালে অং সান সু চি, ২০১০ সালে করিম আগা খান ও ২০১৪ সালে মালালা ইউসুফজাই। এদের মাঝে অং সান সু চির সম্মানসূচক নাগরিকত্ব রোহিঙ্গা গণহত্যার দায়ে ২০১৮ সালে কানাডিয়ান পার্লামেন্ট সদস্যদের ভোটে বাতিল হয়ে যায়। এজন্য বাকি পাঁচজনের ফ্রেমে আলো জ্বালানো থাকলেও সু চির ফ্রেমে আলো নেভানো ছিল এবং রোহিঙ্গা গণহত্যার দায়ে তার সম্মানসূচক নাগরিকত্ব বাদ দেওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট লেখা রয়েছে।

জাদুঘরের আরেকটি দারুণ বিষয় হলো ‘টাওয়ার অফ হোপ’, সেখান থেকে পুরো উইনিপেগ শহরটা দেখা যায়। আরও আছে একটা ক্যাফে আর গবেষকদের জন্য আলাদা একটা কর্নার। ঘুরতে ঘুরতে এক জায়গায় দেখলাম দর্শনার্থীদের মন্তব্য লিখতে ভিন্ন ভিন্ন রঙের কাগজ দেওয়া আছে। কানাডা আর পৃথিবীর ইতিহাসের বিভিন্ন মানবাধিকার ইস্যু নিয়ে দেখা আর জানার দারুণ কিছু সময় কাটলো।

কিডজ ম্যাগাজিনে বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!