ভ্রমণগদ্য
১৬০৬ সালের মার্চ মাসে উইলেম জানসজুনের নেতৃত্বে ৬০ টন ওজনের ‘ডাইফেন’ জাহাজটি বর্তমান পূর্ব ইন্দোনেশিয়ার বান্দা থেকে রওনা হয়েছিল।
Published : 30 May 2024, 03:33 PM
‘অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় সামুদ্রিক জাদুঘর’ ভ্রমণে গিয়ে জানতে পারলাম, সেখানকার জাহাজগুলো সত্যিকারের জাহাজ বা সেগুলোর হুবহু রেপ্লিকা। সেগুলো সমুদ্রভ্রমণেও বের হয়। ‘জেমস ক্রেইগ’ এবং ‘ডাইফেন’ জাহাজ দুটি নিয়মিত ভ্রমণপিপাসুদের নিয়ে সমুদ্রে বেরিয়ে পড়ে।
যে কেউই এই ভ্রমণে যেতে পারেন, তবে তার বয়স ন্যূনতম বারো বছর হতে হবে। অনলাইনে আগে থেকেই টিকেট করে নিতে হবে। আর আগে থেকে বমি প্রতিরোধকারী বড়ি খেয়ে নেওয়া ভালো। কারণ সমুদ্রের ঢেউয়ে অনেকেই বমি করে দেন। এটা জেনেই আমি আর আমার চৌদ্দ বছর বয়সী কন্যা উৎসাহী হয়ে গেলাম।
অবশ্য একটু মন খারাপ হচ্ছিল, কারণ আমার নয় বছর বয়সী ছেলে আমাদের সঙ্গে যেতে পারবে না। অনলাইনে আমরা ডাইফেনের টিকেট করে তাকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললাম। শুরুতে একটু মন খারাপ করলেও পরে সে মেনে নিল।
অফিসে আমার বসের সঙ্গে এটা নিয়ে আলাপ করতেই সে আমাকে সেই সপ্তাহের ফেরির একটা ভিডিও দেখিয়ে বলল, তুমি এই ঢেউ দেখে ভয় পাবে না তো! আমি বললাম, মোটেও না। আমার জন্ম বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রশস্ত নদী পদ্মার তীরে। এই ঢেউ দেখে দেখে আমি বড় হয়েছি। সত্যি কথা বলতে কি, আমি চাইছি ওইদিন আবহাওয়া একটু বিপজ্জনক থাকুক, যেন আমার মেয়েটা একটা দারুণ অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে আসতে পারে।
তারপর নির্দিষ্ট দিনে আমি আর মেয়ে হাজির হয়ে গেলাম সিডনির ডারলিং হারবারে অবস্থিত সামুদ্রিক জাদুঘরে। সেখানে শুরুতেই পলা নামের এক নাবিক আমাদের স্বাগত জানিয়ে জাহাজের নানা খুঁটিনাটি বিষয় জানালো। তার কাছ থেকেই জানলাম, ১৬০৬ সালের মার্চ মাসে উইলেম জানসজুনের নেতৃত্বে ৬০ টন ওজনের ‘ডাইফেন’ জাহাজটি বর্তমান পূর্ব ইন্দোনেশিয়ার বান্দা থেকে রওনা হয়েছিল।
নিজেদের অজান্তেই ইউরোপীয়রা অস্ট্রেলিয়ার উত্তরে পৌঁছেছিল। এই সমুদ্রযাত্রাটি কেবল অস্ট্রেলিয়ার মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে ইউরোপীয়দের প্রথম যোগাযোগই নয়, বরং এতে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে আদিবাসী ও ইউরোপীয়দের মধ্যে প্রথম সাক্ষাৎও ছিল। এটি জেমস কুকের যাত্রার ১৬৪ বছর আগের ঘটনা। পরে পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার মেরিটাইম মিউজিয়ামের সঙ্গে যৌথভাবে এই জাহাজটির রেপ্লিকা তৈরি করে ‘রেপ্লিকা ফাউন্ডেশন’।
১৯৯৯ সালের ২৪ জানুয়ারি ফ্রেম্যান্টলে এটি চালু হয়েছিল। এই জাহাজটি আসল জাহাজের হুবহু প্রতিকৃত অবলম্বন করে তৈরি করা হয়েছে। এই জাহাজে ভ্রমণ করে আপনি চারশ বছরেরও বেশি আগের সময়ে নাবিকদের ছয় মাসের সমুদ্রযাত্রার গতি প্রকৃতি সম্পর্কে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারবেন।
নোঙর করা জাহাজে উঠে পড়লাম। সবমিলিয়ে আমরা ১২ জনের একটা দল। হিসাব করে দেখলাম, আমাদের চেয়ে জাহাজের নাবিকের সংখ্যাই বেশি। জাহাজে শুরুতেই মারিয়া নামের একজন নাবিক আমাদের স্বাগত জানিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সময়ে কীভাবে লাইফ জ্যাকেট পরতে হবে, সঙ্গে আর কী কী করণীয় সেই বিষয়ে ধারণা দিয়ে দিলেন। তারপর জাহাজের ক্যাপ্টেন ব্র্যান্ডিন আমাদের স্বাগত জানিয়ে একটা বক্তব্য দিলেন। সেখানে তিনি যাত্রাপথের এবং কীভাবে যাত্রা করবেন সেই বিষয়ে ধারণা দিলেন।
শুরুতেই ইঞ্জিনের সাহায্যে ডাইফেনকে এমন একটা জায়গা নেওয়া হবে যেখানে বাতাস আছে, তারপর বাতাসে পাল তুলে যাত্রা করা হবে। সেদিন সারাদিন ধরেই ইলশেগুঁড়ি ঝরে চলেছিল। তাই সবাই সঙ্গে করে রেইনকোট নিয়ে এসেছিল। আমরা সবাই রেইনকোট পরে নিয়েছিলাম। জাহাজ চলতে শুরু করলো।
ক্যাপ্টেন জাহাজের ছইয়ের উপর দাঁড়িয়ে ইঞ্জিন নিয়ন্ত্রণ করছিলেন। আর সময়ে সময়ে হাল ধরে থাকা নাবিককে দিক নির্দেশনা দিচ্ছিলেন। তখন আমরা খেয়াল করলাম ছইয়ের নিচে একজন মানুষ ক্যাপ্টেনের কথার প্রতিশব্দ করে জানাচ্ছেন, নির্দেশ পালন করা হয়েছে। আমরা তখন নিচে নেমে এসে হাল ধরা নাবিকের সঙ্গে পরিচিত হলাম। টেরি নামের মাঝ বয়স পার করা একজন হাসিখুশি মানুষ। আমাদের দেখেই বলল, তোমরা কি হাল ধরতে চাও? আমরা সানন্দে রাজি হয়ে গেলাম। পালা করে আমি আর মেয়ে হাল ধরলাম। তার পেছনে একটা কামরা দেখে জিজ্ঞেস করলাম, এটা কি? টেরি বলল, এটা ক্যাপ্টেনের কামরা, তোমরা চাইলে ভেতরে যেতে পারো।
আমরা ভেতরে ঢুকে দেখলাম একেবারে সেই আদিকালের মতো করে কামরাটা সাজানো। তারপর আমরা আবার ছইয়ের উপর চলে এলাম, কারণ এখান থেকে চারদিকটা ভালোমতো দেখা যাচ্ছে। কথায় কথায় ক্যাপ্টেনকে জানালাম, আমরা বাংলাদেশের মানুষ। আমি ছোটবেলায় পালতোলা নৌকা দেখেছি বলেই গুগল করে আমাদের পালতোলা নৌকার ছবি দেখিয়ে দিলাম। সেটা দেখে ক্যাপ্টেন অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে বললো, সি ইজ গর্জিয়াস।
বললাম, তোমাকে আরো একটা জিনিস দেখাবো। যখন স্রোতের বিপরীত দিকে যেতে হতো তখন আমরা গুণ টেনে নৌকা এগিয়ে নিতাম। আবারো গুগল করে গুণটানা নৌকার ছবি দেখিয়ে দিলাম। বললাম এই দড়িগুলোর এক প্রান্ত নৌকার মাথায় আটকানো আর অন্য প্রান্ত এই মানুষগুলোর ঘাড়ে ধরা লাঠির সঙ্গে আটকানো। দেখে সে খুবই অবাক হলো এবং বলল, আমি অবশ্যই বাংলাদেশের নৌকা নিয়ে খোঁজখবর নেব।
জাহাজ চলতে থাকলো। একটা জায়গায় গিয়ে ইঞ্জিন বন্ধ করে দেওয়া হলো। তারপর পালতোলার জোগাড় শুরু করা হলো। যাত্রীদের মধ্যে যারা সাহায্য করতে আগ্রহী তাদের আহ্বান করা হলো। আমি সানন্দে রাজি হয়ে গেলাম। একজন নাবিক সুরে সুরে বলবেন ‘ফোর সিক্স’ আর আমাদের বলতে হবে ‘হিভস’। আর সঙ্গে সঙ্গেই দড়ি ধরে টান দিতে হবে। এভাবেই নামিয়ে রাখা পাল জাহাজের মাস্তুল বেয়ে একসময় উপরে উঠে গেল। সেটাকে সেখানে ভালোমতো বেঁধে দেওয়া হলো।
দুজন নাবিক দুদিক থেকে উঠে পালের বাঁধন খুলে পাল তুলে দিলেন। কিন্তু বাতাস তেমন না থাকায় পাল উড়ছিল না। তখন ক্যাপ্টেন বলল, আজ বাতাস না থাকায় পাল উড়ছে না, তবে এটার একটা ভালো দিকও আছে। সেটা হলো আমরা ঠিক সেই আদিকালের মতো জাহাজে যাত্রার অনিশ্চয়তার বিষয়টা বুঝতে পারছি।
জাহাজ চলতে থাকলো ধীর গতিতে। এরমধ্যে আমাদেরকে খাবার দিয়ে দেওয়া হলো। একেবারে জাহাজের খাবার। সেখানে সবই প্রায় শুকনা খাবার। আমরা যতটুকু পারলাম খেয়ে বাকিটা বাসার জন্য রেখে দিলাম। এবার কামান দাগার প্রস্তুতি চলতে থাকলো। প্রথমে কামানে একটা লাঠি দিয়ে ঠেলে ঠেলে কার্তুজ ঢোকানো হলো। হেনরি নামের একজন হাসিখুশি নাবিক সেখানে আগুন দেওয়ার জন্য দড়ির মাথায় আগুন নিয়ে আসলো।
আগুন দেওয়ার আগে সাবধান করা হলো যে, জোরে শব্দ হবে। তাই দুই হাত দিয়ে কান ঢেকে রাখায় বুদ্ধিমানের কাজ হবে। এটা শুনে আমি দুই কানে টিস্যু গুঁজে দিলাম, কারণ আমি কামান দাগার ছবি তুলবো।
কামান দাগা হয়ে গেলে আমরা ধীরে ধীরে ফিরে আসতে শুরু করলাম। ক্যাপ্টেন সময়ে সময়ে বলছিলেন আমাদের জাহাজের গতিবেগ কত। পাল নামানোর সময় আমরা আবার হাত লাগালাম। পাল নামিয়ে আমরা ধীরে ধীরে জাদুঘরের জেটিতে এসে নোঙর করলাম।
সন্ধ্যা হয়ে এসেছিল। ক্যাপ্টেন ছইয়ের উপর থেকে নেমে এলেন। আমাদের সবাইকে ধন্যবাদ দিলেন, উনাদের জাহাজটা চালানোর সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। বললেন, তোমরা এসেছো বলেই আমরা জাহাজটা নিয়ে বের হতে পেরেছি। আর এই নাবিক হিসেবে আমরা একটা কাজই সবচেয়ে ভালো পারি এবং করতেও পছন্দ করি। আশা করি এই ভ্রমণ তোমাদের ভালো লেগেছে এবং তোমাদের কিছু সুন্দর স্মৃতি তৈরি হয়েছে। আমি নতুন নতুন নৌকা এবং জাহাজ সম্পর্কে জানতে ভালোবাসি। আমি আজ বাংলাদেশের জাহাজ নিয়ে জেনেছি।
তিনি আবারও ধন্যবাদ দিয়ে বললেন, তোমরা চাইলে তোমাদের বন্ধু-বান্ধবদের আমাদের সম্পর্কে বলতে পারো। আর কোন সোশ্যাল মিডিয়াতে ছবি বা ভিডিও দিলে অবশ্যই আমাদের জাহাজটাকে ট্যাগ করতে ভুলো না।
আমার মেয়েটা পুরো সময়টা বেশি কথা বলেনি। শুরুতে কিছুটা বিরক্তই ছিল, বৃষ্টির দিনে এমন একটা ভ্রমণে আসার জন্য। কিন্তু যখন আমরা জাহাজ থেকে নেমে বাড়ির পথ ধরেছি তখন সে বলল, বাবা তোমাকে ধন্যবাদ আমাকে এমন চমৎকার একটা ভ্রমণে সঙ্গে আনার জন্য।