নোবেল বিজয়ীর সাক্ষাৎকার
এবছর নোবেল বিজয়ী হান কাং-এর এ সাক্ষাৎকারটি ২০১৭ সালে প্রকাশ করে ‘দ্য গার্ডিয়ান’।
Published : 13 Oct 2024, 05:43 PM
এবছর সাহিত্যে নোবেল পেলেন ঔপন্যাসিক হান কাং। দক্ষিণ কোরিয়ার এ লেখক ২০১৬ সালে তার উপন্যাস ‘দ্য ভেজিটেরিয়ান’-এর জন্য আন্তর্জাতিক সাহিত্য অঙ্গনে প্রশংসা পান। এই উপন্যাস একজন নারীর মাংস খাওয়া বন্ধ করার সিদ্ধান্ত এবং সেই সিদ্ধান্তের কারণে তার পরিবার ও সমাজের সঙ্গে সম্পর্কের সংকটকে কেন্দ্র করে লেখা হয়েছে।
হান কাং-এর লেখায় সাধারণত ব্যক্তিগত ও সামাজিক সংকট, মানবতার অন্ধকার দিক এবং অস্তিত্বের জটিলতা উঠে আসে। তার লেখার ধরন সরল, কিন্তু মনস্তাত্ত্বিকভাবে গভীর। তিনি ২০১৬ সালে ম্যানবুকার আন্তর্জাতিক পুরস্কার জিতেন, যা তার সাহিত্য প্রতিভার বৈশ্বিক স্বীকৃতি।
২০১৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় হান কাং-এর একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। সাক্ষাৎকার নেন লেখক ও সাংবাদিক হান্না বেকারম্যান। এ সাক্ষাৎকারে ঔপন্যাসিক হান কাং তার বোনের মৃত্যু কীভাবে তার লেখার শক্তি জুগিয়েছিল এবং কীভাবে মাইগ্রেনের মতো দীর্ঘমেয়াদি স্নায়ুবিক রোগ তার লেখায় সাহায্য করেছিল, সে দিকটি তুলে ধরেছেন।
আপনার নতুন বইয়ের গল্পটি মূলত আপনার বড় বোনকে নিয়ে, যে জন্মের দুই ঘণ্টা পরই মারা যায়। গল্পটি লিখতে আপনি কেমন অনুভব করেছিলেন?
আসলে আমার বোনকে নিয়ে লিখতে কোনো পরিকল্পনা করিনি। আমার বাবা-মা তাকে ভুলতে পারেননি এক মুহূর্তের জন্যও। তার স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছেন। আমি যখন ‘হিউম্যান অ্যাক্টস’ বইটি লিখছিলাম, সেখানে একটা সংলাপ লিখেছিলাম এরকম, ‘মরে যেয়ো না, মরে যেয়ো না প্লিজ।’ তারপর আমি ভীষণ অবাক হয়ে যাই। কারণ হঠাৎ জানতে পারি, আমার বোনের জন্মের পর এই কথাগুলোই বারবার বলতেন আমার মা।
সেই বোনের মৃত্যুর জায়গায় আপনি কীভাবে বেড়ে উঠেছেন? এটি কি আপনার বেড়ে উঠাকে কোনোরকম প্রভাবিত করেছিল?
বাবা-মায়ের কাছে সেই মৃত্যুটা অবশ্যই বেদনাদায়ক ছিল। সেই একজনের প্রতি দুঃখটাই আমাদের করেছিল সবচেয়ে মূল্যবান। আমরা ছিলাম তাদের কাছে চোখের মণি। বাবা-মা আমাকে আর আমার ভাইকে বলতেন, ‘তোমরা আমাদের কাছে কতটা আদরের তা জানো না। তোমাদের পেতে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হয়েছে।’ আমাদের ছিল কখনো আনন্দ, কখনো বেদনা। এই দুইয়ের মিশ্রণই তো মানুষের জীবনের অনুভূতি।
আপনি ওই বইয়ে লিখেছেন যে, আপনার মায়ের প্রথম দুটি শিশু মারা না গেলে, আপনাকে আর আপনার ভাইকে হয়তো গর্ভে ধারণ করা হতো না। বিষয়টি কেমন লাগে ভাবতে?
এই পৃথিবী খুবই অল্প দিনের জন্য। আমি মনে করি, আমাকে আমার ভাগ্যই পৃথিবীতে এনেছে। আমার মা যখন গর্ভবতী ছিলেন, তখন তিনি খুবই অসুস্থ। অনেক ওষুধ খেতে হচ্ছিল। একসময় এটাও চেয়েছিলেন, আমাকে পৃথিবীতে আনবেন না। কিন্তু ততোদিনে আমি পেটে বেশ বড় হয়ে গেছি। সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, আমাকে জন্ম দেওয়া হবে। পৃথিবীতে আসতে পেরে আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি।
কৈশোর থেকেই আপনি মাইগ্রেনের সমস্যায় ভুগছেন। এটি লেখালেখিতে কোনো বিরূপ প্রভাব ফেলেছে কিনা!
এই সমস্যাটিই আমাকে মনে করিয়ে দেয় যে, আমি একজন মানুষ। আমি ক্ষণস্থায়ী, আমি নশ্বর ও দুর্বল। প্রচণ্ড মাথাব্যথা আমাকে কাজ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। আমার পড়া, লেখালেখি কিংবা সমস্ত কাজের রুটিন তখন বন্ধ হয়ে যায়। তখন ভাবি যে, আমি অমর কোনো প্রাণী নই। আর এটিই আমাকে নম্র-ভদ্র করে তোলে, নিজেকেই মূল্যবান ভাবতে শিখি। আমি শতভাগ সুস্থ থাকলে, কখনোই একজন লেখক হতে পারতাম না।
আপনি ১৪ বছর বয়সেই লেখক হতে চেয়েছিলেন। কেন লেখক হওয়ার ভূত চাপলো মাথায়?
আমি পাঠক হিসেবে যখন কোনো লেখা পড়তাম, তখন দেখতাম লেখায় কোনো উপসংহার নেই। আমার মনে অনেক প্রশ্ন জমা হতো। আর সেসব প্রশ্নের উত্তর আমি পেতাম না। উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমি ভালো কোনো সিদ্ধান্ত পেতাম না। তখন থেকেই ভাবতে লাগলাম, আমি নিজে কেন লিখছি না!
আপনার বাবাও একজন ঔপন্যাসিক। তিনি আপনাকে কীভাবে প্রভাবিত করেছিলেন?
আমাদের বাড়িতে প্রচুর বই ছিল, ছোটবেলা থেকেই বই পড়ার একটা ভালো পরিবেশ পাই। আমি মনে করি এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব।
আপনার প্রিয় শিশুতোষ বই ছিল কোনগুলো?
আমি কোরিয়ান লেখকদের খুব পছন্দ করতাম। বিভিন্ন অনুবাদের বইও অনেক পছন্দের ছিল। যেমন, অ্যাস্ট্রিড লিন্ডগ্রেনের ‘দ্য ব্রাদার্স লায়নহার্ট’।
কোন লেখক আপনাকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে?
কোরিয়ান লেখকদের মধ্যে আমি লিম চুল-উয়ের ছোটগল্প পছন্দ করি খুব। বিদেশি লেখকদের মধ্যে দস্তয়েভস্কিকে ভীষণ ভালোবাসি।
জীবিত বা মৃত কোন লেখকের সঙ্গে আপনি সবচেয়ে বেশি দেখা করতে চান?
সামনাসামনি আমি লেখকদের সঙ্গে দেখা করতে চাই না। তবে ইতোমধ্যে বিভিন্ন লেখকদের সাক্ষাৎ পেয়েছি তাদের বইগুলো পড়ার মাধ্যমে। লেখকরা তাদের সবটা অনুভূতি ফুটিয়ে তোলেন লেখার ভেতরেই। তাদের লেখাটা অনুভব করেই আমি মুগ্ধ, যেটা লেখকদের সঙ্গে দেখা করার চেয়েও বড় কিছু মনে হয় আমার কাছে।
আপনার ‘দ্য ভেজিটেরিয়ান’ উপন্যাসটি ইন্টারন্যাশনাল ম্যানবুকার পুরস্কার পেয়েছে। এটি আপনার ক্যারিয়ারে কতটুকু প্রভাব ফেলেছে?
প্রচুর মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি। পাঠকদের সাড়া অভিভূত করেছে আমাকে। তবে আমি ব্যক্তিগত জীবনটাকে উপভোগ করতে চাই। বেশি মানুষের মনোযোগ একজন লেখকের জন্য সবসময় আশীর্বাদ বয়ে আনে না। মানুষের ভালোবাসার প্রতি যত্ন নেওয়া এবং লেখা চালিয়ে যাওয়াটা অসম্ভব হয়ে পড়ে কখনো কখনো।