বিধবা ও তোতাপাখি, দ্বিতীয় কিস্তি

ব্রিটিশ সাহিত্যিক ভার্জিনিয়া উলফ (১৮৮২ - ১৯৪১) শিশু-কিশোরদের জন্য ‘দ্য উইডো অ্যান্ড দ্য প্যারট’ শিরোনামে এ গল্পটি লেখেন ১৯২২-২৩ সালে। প্রায় ৬৬ বছর অজ্ঞাত অবস্থায় থাকার পর এ পাণ্ডুলিপিটি আবিষ্কার করেন উলফের ভাইয়ের ছেলে লেখক কোয়েটিন বেল। ১৯৮৮ সালে এটি বই আকারে প্রকাশিত হয়।

ফাহিমা কানিজ লাভাফাহিমা কানিজ লাভা
Published : 31 Oct 2022, 02:57 AM
Updated : 31 Oct 2022, 02:57 AM

মিসেস গেজ হতাশায় যেন প্রায় পাগল হয়ে গেলেন। তিনি রেভারেন্ড স্যামুয়েল ট্যালবয়ের কাছ থেকে দুই পাউন্ড ধার করে এখানে এসেছিলেন। আর এখন তাকে একেবারে খালি হাতে বাড়ি ফিরতে হচ্ছে।

হয়তো তাকে ভাড়া পরিশোধ করার জন্য তোতা জেমসকেই বিক্রি করতে হবে। বাইরে খুব বৃষ্টি হচ্ছিল, কিন্তু তারপরও মিস্টার স্ট্যাগ তাকে থাকার জন্য বললেন না। মিসেস গেজ  যা করেছেন, তার জন্য ভীষণ দুঃখ হলেও এ জ্বালা মেটাতে তার নিজেকেই নিজের পাশে থাকতে হবে। তাই প্রবল বৃষ্টি সত্ত্বেও তিনি তৃণভূমি পার হয়ে রডমেলের দিকে ফিরে যেতে শুরু করেন।

পাঠকদের আগেই বলেছিলাম যে মিসেস গেজের ডান পা খোঁড়া ছিল। সর্বোচ্চ চেষ্টা করলেও তার হাঁটার গতি ছিল খুবই ধীর। তার ওপর এখন তার হতাশা এবং বৃষ্টির কারণে নদী তীরের কাদা তার হাঁটার গতিকে আরও ধীর করে তুলেছিল। তিনি যতই নদীর দিকে পথ পাড়ি দিচ্ছিলেন, দিনটা ততই অন্ধকার থেকে আরও অন্ধকার হয়ে আসছিল।

আপনি হয়তো হাঁটতে হাঁটতে তার বিড়বিড় করে বলা এসব কথাও শুনতে পাবেন। তিনি তার ধূর্ত ভাই জোসেফের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছিলেন, যে তাকে এই সমস্ত সমস্যায় ফেলেছিল। মিসেস গেজ বলছিলেন, ‘আমাকে বিপদে ফেলতেই সে এমন করেছে। আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখনও সে নিষ্ঠুর ছোট ছেলে ছিল। সে বেচারা নিরীহ পোকামাকড়গুলোকে বিরক্ত করতে পছন্দ করতো। আমি তাকে আমার চোখের সামনে একটা কাচি দিয়ে একটি শুঁয়োপোকার পশম কাটতে দেখেছি। সে তখনও এমন কৃপণ ছিল। সে তার পকেটের টাকা একটা গাছে লুকিয়ে রাখত। যদি কেউ তাকে চায়ের জন্য এক টুকরো ঠান্ডা কেক দিত, তবে সে চিনিটি তার রাতের খাবারের জন্য রেখে দিত। কোনো সন্দেহ নেই যে সে এই মুহূর্তে নরকের আগুনেই জ্বলছে। কিন্তু তাতে আমার লাভ কী?’

ঠিক সেই মুহূর্তে একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটে গেল। একটি বিশাল আলোর রেখা আকাশের দিকে দেখা গেল, একটা বড় টর্চের আলোর মতো। সেই আলো ঘাসের প্রতিটি ডগাকে আলোকিত করে তুলল।

সত্যিই এসব ভেবে খুব কমই সান্ত্বনা পাওয়া যাচ্ছিল। এমন সময় বেখেয়ালে তিনি একটি বড় গরুকে ধাক্কা দিয়ে বসেন এবং এর ফলে এক পাক ঘুরে তিনি কাদার উপর পড়ে যান। তিনি অনেক কষ্টে নিজেকে টেনে তুলতে পারলেন এবং কোনোরকমে আবার হাঁটতে শুরু করলেন। তার মনে হচ্ছিল যেন তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাঁটছেন। এখন অন্ধকার হয়ে এসেছে এবং তিনি তার নাকের সামনে নিজের হাত ধরলেও আর দেখতে পারছিলেন না। হঠাৎ তার মনে পড়ল নদীর অগভীর সরু খাতটি সম্পর্কে কৃষক স্টেসির বলা কথাগুলো। তিনি বললেন, ‘হে খোদা, তাহলে কি আমি আমার পথ খুঁজে পাব? যদি জোয়ার আসে, আর আমি গভীর জলে পা রাখি, তাহলে তো নিমিষেই সমুদ্রের দিকে ভেসে যাব! এখানে ডুবে যাওয়া অনেক দম্পতি; ঘোড়া, গাড়ি, গবাদি পশুর পাল এবং খড়ের স্তুপ- কতকিছুর না ভেসে গেছে।’

আসলেই অন্ধকার আর কাদার মধ্যে একটা জগাখিচুড়ি অবস্থা হলো মিসেস গেজের। তিনি নদীটাকে খুব কমই দেখতে পাচ্ছিলেন, সুতরাং তিনি সেই সরু খাতে পৌঁছেছেন কিনা তা তিনি নিজেও বুঝতে পারছেন না। কোথাও কোনো আলো দেখা যাচ্ছিল না। কারণ, আপনি হয়তো জানেন, আশেহাম হাউস যেখানে এখন মিস্টার লিওনার্ড উলফ থাকেন, এটার কাছাকাছি নদীর ওই ধারে কোনো কুঁড়েঘর বা বাড়ি নেই। মনে হচ্ছিল সকালের জন্য বসে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। কিন্তু মিসেস গেজের যা বয়স এবং সেইসাথে আছে রিউমেটিকসের ব্যথা, হয়তো তিনি ঠান্ডায় মারাই যেতে পারেন।

অন্যদিকে, যদি তিনি নদী পার হওয়ার চেষ্টা করেন, তাহলে তার ডুবে যাওয়াও প্রায় নিশ্চিত। তার অবস্থা এতটাই শোচনীয় ছিল যে তিনি হয়তো সানন্দে মাঠের একটি গরুর সাথে তার জায়গা পরিবর্তন করতেন। সাসেক্সের পুরো প্রদেশেই বোধহয় আর কোনো এমন হতভাগা বুড়িকে খুঁজে পাওয়া যাবে না, যে কিনা নদীর তীরে দাঁড়িয়ে ভেবে পাচ্ছিল না বসতে হবে নাকি সাঁতার কাটতে হবে, নাকি ভেজা ঘাসে তাকে গড়িয়ে যেতে হবে!

ঠিক সেই মুহূর্তে একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটে গেল। একটি বিশাল আলোর রেখা আকাশের দিকে দেখা গেল, একটা বড় টর্চের আলোর মতো। সেই আলো ঘাসের প্রতিটি ডগাকে আলোকিত করে তুলল এবং মিসেস গেজ বিশ গজ দূরে নদীর সেই সরু খাতটা দেখতে পেলেন। ওই সময় নদীতে ভাটা চলছিল এবং পারাপারের জন্য এখনই ঠিক সময় বলে মনে হলো যদি না তার আগেই আলোটা নিভে যায়। ‘এটা অবশ্যই একটি ধূমকেতু বা এমন কিছু বিস্ময়কর দানবীয় জিনিস হবে!’ মিসেস গেজ আপন মনেই বললেন। তিনি তার সামনে আলোয় ঝলমল করতে থাকা রডমেল গ্রামটাকে দেখতে পাচ্ছিলেন।

‘আমাদের করুণা করো, আমাদের রক্ষা করো খোদা।’ চিৎকার করে বললেন মিসেস গেজ। ‘একটা বাড়িতে আগুন লেগেছে, সেজন্য খোদাকে ধন্যবাদ।’ মিসেস গেজ ভেবেছিলেন যে আগুনে একটা বাড়ি পুড়তে অন্তত কয়েক মিনিট সময় তো লাগবেই এবং এই সময়ের মধ্যে তিনি গ্রামে যাওয়ার পথ ঠিকঠাক খুঁজে নেবেন। মিসেস গেজ রোমান রাস্তা ধরে চলতে চলতে বলছিলেন, ‘এটা একটা খারাপ বাতাস, যা কারও ভালো করে না।’ নিশ্চিতভাবে তিনি পথের প্রতিটি ইঞ্চি দেখতে পারছিলেন এবং যখন তিনি গ্রামের রাস্তায় প্রায় এসে পড়লেন, তখন এটা তার মনে প্রথমবারের মতো ধাক্কা দিল, ‘সম্ভবত এটা আমার নিজেরই বাড়ি যা আমার চোখের সামনেই জ্বলছে!’

হঠাৎ জানালায় সামান্য টোকা দেওয়ার মতো শব্দ হলো। পর পর তিনবার কেউ টোকা মারল। মিসেস গেজ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিছানা থেকে নেমে জানালার কাছে গেলেন।

তার ধারণা একেবারে ঠিক ছিল। রাতের পোশাক পরা একটি ছোট ছেলে তার কাছে এসে চিৎকার করে বলল, ‘এসো, দেখে যাও। বুড়ো জোসেফ ব্র্যান্ডের বাড়িটা পুড়ে গেছে!’ সমস্ত গ্রামবাসী বাড়ির চারপাশে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তারা মঙ্কস হাউসের রান্নাঘরের কুয়া থেকে বালতি ভরে পানি তুলে এনে আগুনের ওপর ছুড়ে মারছিল। কিন্তু আগুনটা বেশ ভালোভাবেই ধরেছিল এবং মিসেস গেজের আসার সাথে সাথেই ছাদটা পড়ে গেল।

‘কেউ কি তোতাটাকে বাঁচিয়েছে?’ মিসেস গেজ আর্তস্বরে বললেন। পাদ্রী রেভারেন্ড জেমস হকসফোর্ড বললেন, ‘এজন্য খুশি থাকুন ম্যাডাম যে আপনি নিজে বেঁচেবর্তে আছেন। বোবা প্রাণীদের জন্য চিন্তা করবেন না। আমার মনে হয় তোতাপাখিটি তার বসার লাঠিটায় করুণভাবে দম আটকে মরে গেছে।’

কিন্তু মিসেস গেজ বিষয়টা নিজে দেখতে চাইছিলেন। গ্রামের লোকেরা তাকে নানাভাবে আটকাতে চাইছিল। তারা মন্তব্য করছিল যে কেউ পাগল না হলে একটা পাখির জন্য জীবন বিপন্ন করে!

মিসেস ফোর্ড বললেন, ‘বেচারি বুড়ি! তিনি তার সমস্ত সম্পত্তি হারিয়েছেন। শুধু একটা পুরোনো কাঠের বাক্স বাঁচিয়েছেন, যেটায় তার রাতে থাকার জিনিসপত্র রয়েছে। হয়তো তার জায়গায় থাকলে আমরাও পাগল হয়ে যেতাম!’ এই বলে মিসেস ফোর্ড মিসেস গেজের হাত ধরে তাকে তার নিজের কুঁড়েঘরে নিয়ে গেলেন, যেখানে তাকে রাতে ঘুমাতে হবে। এখন আগুন নিভে গেছে, তাই যে যার ঘরে শুতে গেল।

কিন্তু বেচারি মিসেস গেজ কিছুতেই ঘুমাতে পারলেন না। তিনি তার করুণ অবস্থার কথা ভেবে হাত-পা ছুঁড়ছিলেন। হতাশ হয়ে তিনি ভাবছিলেন, কীভাবে তিনি ইয়র্কশায়ারে ফিরে যাবেন এবং রেভারেন্ড স্যামুয়েল ট্যালবয়কে ধারের অর্থ পরিশোধ করবেন। সেইসাথে তিনি অসহায় তোতাপাখিটার ভাগ্যের কথা ভেবে আরও বেশি দুঃখ পাচ্ছিলেন। তিনি অল্প সময়ের মধ্যেই পাখিটাকে পছন্দ করে ফেলেছিলেন। তিনি ভাবলেন, বৃদ্ধ জোসেফ ব্র্যান্ডের কোনো মানুষ বা প্রাণীর প্রতি দয়ামায়া ছিল না; তার মৃত্যুর জন্য এত গভীর শোক যে পাখিটার, তার নিশ্চয়ই একটা কোমল হৃদয় আছে। এটা একটা নিরীহ পাখির জন্য ভয়ংকর মৃত্যু! যদি তিনি সময়মতো এখানে থাকতেন, তবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও তাকে বাঁচাতে পারতেন।

মিসেস গেজ যখন বিছানায় শুয়ে এসব ভাবছিলেন, তখন হঠাৎ জানালায় সামান্য টোকা দেওয়ার মতো শব্দ হলো। পর পর তিনবার কেউ টোকা মারল। মিসেস গেজ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিছানা থেকে নেমে জানালার কাছে গেলেন।

চলবে...

কিডজ ম্যাগাজিনে বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!