‘কী বলিস তুই! আমরা তাহলে এতক্ষণ হেঁটে হেঁটে ঘুরে ঘুরে আগের জায়গাতেই ফিরে এসেছি!’
Published : 28 Mar 2025, 02:18 AM
তবু তারা এগিয়ে যায়। কিন্তু কোনো পদচিহ্ন ছাড়া আঁকাবাঁকা যে পথ ধরে তারা হেঁটে যাচ্ছে, সে পথ কোথায় গিয়ে মিশেছে তা বোঝার কোনো উপায় নেই। তারা আদৌ কোনো পথে হাঁটছে কিনা এবং এই পথ তাদেরকে বনের বাইরে নিয়ে যেতে পারবে কিনা, তা-ও তারা বুঝে উঠতে পারে না।
তবু তারা হাঁটতে থাকে। ইমরানের কথায় জিসান তার মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালিয়ে নিয়েছে। সে আলোয় কাছাকাছি থেকে চার বন্ধু দ্রুত পা চালিয়ে হাঁটতে থাকে। এমন করে অনেকক্ষণ হাঁটার পর একটা গাছের গোড়ায় এলোমেলো ঝোপের কাছে এসে ইমরান চমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। তার দেখাদেখি বাকিরাও দাঁড়িয়ে পড়লে ইমরান স্বগতোক্তির মতো করে বলে, ‘সর্বনাশ হয়েছে রে। আমাদের লালি-আন্ধায় ধরেছে। তাড়াতাড়ি সবাই বসে পড়।’
কেউ কিছু না বুঝেই ইমরানের কথামতো বসে পড়ে। ইমরান জোরে জোরে কালেমা শরীফ পড়ে চারদিকে ফুঁ দিয়ে বুকে থুথু ছিটায়। বাকিদের গায়েও থুথু ছিটাতে গেলে জিসান একটু বিরক্ত হয়ে বলে, ‘কী করছিস এসব? আজগুবি কাজ-কারবার। এসব করে কী হবে!’
‘আরে তোরা দেখতে পাচ্ছিস না, এখানেই আমরা মিঠুকে পেয়েছিলাম। দেখ... দেখ... রওয়ানা দেওয়ার আগে আমরা এখানে কলার খোসা, রুটির প্যাকেট ফেলে গিয়েছিলাম। আমাদের ফেলে দেওয়া খালি পানির বোতলটাও এখানেই পড়ে আছে।’ ‘কী বলিস তুই! আমরা তাহলে এতক্ষণ হেঁটে হেঁটে ঘুরে ঘুরে আগের জায়গাতেই ফিরে এসেছি!’, প্রবল বিস্ময়ে আদনান শেষ কথাটা জানতে চায়।
ইমরান মাথা নেড়ে হ্যাঁ-সূচক সম্মতি দিলে সে একদম চুপসে যায়। চুপসে যায় অন্যরাও। এতক্ষণের উদ্দাম আনন্দঘন পথচলা মুহূর্তেই মুখ থুবড়ে পড়ে। সারাক্ষণ হেঁটে হেঁটে ঘুরে ফিরে এক জায়গায় আসার বিষয়টা গল্পে পড়েছে অথবা কেউ কেউ বাপ-দাদার মুখে শুনেছে এতদিন। গল্পে পড়ে ও শোনে পুলকিত হলেও এখন একই বিষয় যখন নিজেদের সাথে ঘটতে দেখে, তখন অবাক-বিস্ময় তাদের চোখ দুটোকে বড় বড় করে তোলে। ভয় তাদের ছোট হৃৎপিণ্ডটাকে যেন গলার কাছাকাছি নিয়ে আসে। আর হৃৎপিণ্ডটা গলার কাছাকাছি আসতেই, গলা শুকিয়ে যায়। বরফ-শীতল একটা প্রবাহ শিরদাঁড়া বেয়ে নিচের দিকে গড়িয়ে নামতে থাকে বলে অনুভব করে কেউ কেউ।
কারও কারও বুকের ভেতর ঢাকের বাদ্য শুরু হয়। পাখির কিচিরমিচির না থাকলে একজন আরেকজনের এই ধিক্ ধিক্ ঢাকের বাজনা শুনতে পেত বলে অনুমান করা যায়। কী একটা বলতে গিয়ে মিঠুর গলা দিয়ে কোনো কথা বের হয় না। ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে গলা ভেজায়। বাকিরাও সবাই একে একে পানির বোতলটা চেয়ে নেয়। বুকের শুকনো জমিতে পানি দেয়। কী করবে না করবে, কেউ কিছু ভেবে পায় না। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে থম ধরে চুপচাপ বসে থাকে। এভাবে সময়ের হিসাবে কতক্ষণ কেটে যায়, বলা যায় না।
সবার এমন হতাশ হয়ে ভেঙে পড়া দেখে ইমরান সপ্রতিভ ভঙ্গিতে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। নেতার মতো সক্রিয় হয়ে ওঠে। বুকের ধুকপুকানিকে কণ্ঠস্বরের দৃঢ়তায় আড়াল করতে গলা খাঁকারি দিয়ে সঙ্গীদের অভয় দেওয়ার চেষ্টা করে বলতে থাকে, ‘শোন সবাই, আমরা বিপদের মধ্যে পড়েছি, এটা সত্য। কিন্তু এতে এতবেশি ভয় পাওয়ারও কিচ্ছু নেই। আমি দোয়া-দরুদ পড়েছি। পাঁচ কালেমা পড়েছি। কয়েকটা সূরাও পড়েছি। দাদার মুখে শুনেছি দোয়া-দরুদ পড়ে বুকে ফুঁ দিলে বিপদ হালকা হয়ে আসে। নিজের মধ্যে সাহস আসে এবং মাথা ঠান্ডা রেখে চিন্তা করা যায়।’
এইটুকু বলে ইমরান একটু বিরতি নেয়। জিসানের জ্বালিয়ে রাখা মোবাইলের আলোয় সবার মুখের দিকে আলাদা আলাদা করে তাকিয়ে সবার প্রতিক্রিয়া বোঝার চেষ্টা করে। সবার নীরবতা তার ভালো লাগে। কথায় কাজ হচ্ছে বলে তার মনে হয়। সবার চেহারা থেকে ফ্যাকাশে ভাবটা একেবারে মুছে না গেলেও অনেকটাই কমে যেতে দেখে সে। তবে মিঠু ছাড়া শহুরে দুই বন্ধু এ বিষয়ে তার সাথে একমত নয় বলেও মনে হয়।
আদনান ও জিসানের বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে থাকার বিষয়টি আন্দাজ করতে পেরে ইমরান আবার বলতে শুরু করে, ‘আর শোন, বিপদে পড়ে হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিলে হবে না। চুপচাপ বসে থেকে শুধু দোয়া-দরুদ পড়লে, আমাদের কেউ কোলে করে বাড়িতে নিয়ে দিয়ে আসবে না। দোয়ার সাথে দাওয়া, মানে নিজেদেরও চেষ্টা করতে হবে। মাথা ঠান্ডা রেখে চিন্তা করতে হবে। এখান থেকে উদ্ধার পাওয়ার উপায় বের করতে হবে। এখন আর আমাদের বাড়িতে না জানিয়ে উপায় নেই। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। বাড়ির লোকজন নিশ্চয়ই দুশ্চিন্তা করছে। ফোন করে তাদের সত্য কথাটা বলতে হবে। জিসান ও আদনান, তোরা দুজন বাড়িতে ফোন করে জানিয়ে দে। আর শরণখোলা বাসস্ট্যান্ডে কাউকে পাঠাতে বল। শিশির মামার মোবাইল নম্বরটা মুখস্থ থাকলে ভালা হতো। মামাকে ফোন করে আসতে বলতে পারতাম।’
মামার মোবাইল নম্বর মনে না রাখার আফসোস দিয়ে কথা শেষ করে ইমরান বসে পড়ে। অবসন্ন-ক্লান্ত শরীরে এক নাগাড়ে অনেক কথা বলে তার গলা ধরে যায়। মিঠুর কাছে থেকে পানির বোতল নিয়ে আবার গলা ভেজায়। জিসান বসে থেকেই কথা বলা শুরু করে, ‘আমার মনে হয় ইমরান যে কথাগুলো বলেছে, একদম ঠিক কথা বলেছে। আমরা যে বিপদে পড়ছি, সেটা থেকে মুক্তি পেতে হলে এবং এখান থেকে ফিরতে হলে আমাদের প্রতিটা কাজই এখন খুব ভেবেচিন্তে করতে হবে। বাড়িতে খবর দিতে হবে অবশ্যই। আর এই বন থেকে বের হতে পারলেও এত রাতে আমরা কোথায় যাবো! কেমন করে যাবো, সেটাও ভাবতে হবে।’
‘আরে বাড়িতে যে ফোন দিবি, মোবাইলে নেটওয়ার্কের অবস্থা দেখেছিস? সেই কখন থেকেই আমি আব্বুর মোবাইলে ট্রাই করে যাচ্ছি। সিগন্যালই পাচ্ছি না।’ আদনানের কথায় জিসান হাতের মোবাইল দেখতে দেখতে বলে, ‘আদনান ঠিক কথাই বলছে। এখানে আসলেই নেটওয়ার্ক নেই। এক কাজ কর, তোরা কেউ একজন এই গাছে উঠে ট্রাই কর। নেট পেলেও পেতে পারিস।’
ইমরান কথাটা শেষ করার আগেই কারও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ ভেসে আসে। সবাই একযোগে মিঠুর দিকে মুখ ফেরায়। জিসান ও আদনান মমতা নিয়ে মিঠুকে সহানুভূতি জানিয়ে সান্ত্বনা দিতে থাকে এবং বিভিন্ন কথা বলে বোঝাতে থাকে। কিন্তু ইমরান এবার বিরক্ত না হয়ে পারে না। কাজের সময় নষ্ট করে এমন আহ্লাদি কান্নায় তার মেজাজ খারাপ হয়ে যায় এবং সে তা চেপে রাখতে পারে না, ‘বাচ্চা ছেলেদের মতো কী শুরু করলি মিঠু! এখন তোর কান্নার কি হলো! আর এখানে বসে বসে ফ্যাচ ফ্যাচ করে কান্না করলে তোরে কেউ এসে নিয়ে যাবে? আজব ছেলে। সেজন্যই ওরে আনতে চাইনি। নে এইবার সামলা তোরা। আর শোন মিঠু, তোর মোষের মতো পড়ে পড়ে ঘুমানোর জন্যই কিন্তু আজ আমাদের এই দুর্দশা। এখন এই ফ্যাচর ফ্যাচর কান্না বাদ দিয়ে পারলে তোর মোটা মাথা থেকে একটা চিকন বুদ্ধি বের কর।’
‘আহা! ইমরান চুপ কর না। ওর হয়তো বাড়ির জন্য খুব মন খারাপ লাগছে। সবাই তো আর একরকম হয় না, তাই না!’ ইমরানকে কথাটা বলে মিঠুর কাঁধে হাত রেখে জিসান বলে, ‘দেখ মিঠু, আমরা সবাই একসাথে আছি। এত ভয় পাওয়ার কিছু নেই। বিপদে এত ভেঙে পড়লে চলে না। আদনান এদিকে আয়, মোবাইলটা নিয়ে এই গাছে ওঠ। তোর আব্বুর মোবাইলে ফোন দে তাড়াতাড়ি।’
চলবে...