ভ্রমণপ্রিয় কয়েকজন দুরন্ত কিশোর সুন্দরবনে ঘুরতে গিয়ে পথ হারিয়ে ফেলে। হারিয়ে ফেলা সে পথ খুঁজতে খুঁজতে গহিন বনে নিজেরাও একসময় হারিয়ে যায়।
Published : 15 Mar 2025, 06:13 PM
দিনের ভাগ করা সময় তখনও দুপুর গড়িয়ে বিকেলের গায়ে হেলে পড়েনি। খণ্ড খণ্ড মেঘ আকাশের দক্ষিণ থেকে উত্তরে উড়ে উড়ে যাচ্ছে। চারদিকে কোথাও আজ তেমন কোনো চঞ্চলতা নেই। বাতাস আর মেঘের দাপটে সূর্য নিজের প্রখরতা হারিয়েছে সকাল থেকেই।
এমন আলস্যমোড়া দিনের চারদিকে আজ ঈদের আনন্দ-আমেজ লুটোপুটি খাচ্ছে। নিত্যকর্মে ব্যস্ত মানুষও বাড়তি আয়ের স্ফূর্তিতে নিজ নিজ কাজে আনন্দ খুঁজে নেওয়ার চেষ্টায় আছে। এমন সময় বাস থেকে নেমে এক রিকশায় চেপে বসেছে শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে পা দেওয়া চার রোমাঞ্চপ্রিয় কিশোর।
বয়সের ধাপ পরিবর্তন, ছাপ ফেলেছে তাদের মনে ও শরীরে। ঘরোয়া খেলনা থেকে আগ্রহ সরে যেতে শুরু করেছিল আরও আগেই, চারপাশের দৃশ্যমান বিভিন্ন ঘটনা ও বিষয়বস্তু এখন তাদের ঘরের বাইরে ডাকে প্রতিদিন। বইয়ে পড়া পৃথিবী তাদের হেঁটে-ঘেঁটে দেখতে ইচ্ছে করে। নিত্য-নতুন আবিষ্কার ও অনুসন্ধানের নেশা তাদের ঘোরগ্রস্ত করে রাখে।
সুন্দরবন সম্পর্কে ইতোমধ্যে বিভিন্ন বইয়ে তারা অনেক কিছু পড়েছে। পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনের কাঁদা জলে মাথা উঁচু করে থাকে রহস্যময় শ্বাসমূল। দেখতে লম্বা লম্বা নারিকেল গাছের পাতার মতো হলেও অদ্ভুত নামের গোলপাতা আর জাতীয় পশু রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসভূমি সুন্দরবন। বইয়ের পাতা থেকে উঠে এসে সুন্দরবন এখন তার অপার সৌন্দর্য ও রহস্য নিয়ে, এই চঞ্চল কিশোরদলকে হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকে।
ঢাকা থেকে দুই বছর পর গ্রামের বাড়িতে ঈদ করতে আসা আদনানই প্রথম চাঁদ রাতের আড্ডায় প্রস্তাবটা তোলে। সাথে সাথে খুলনা শহর থেকে আসা জিসান সম্মতি দিয়ে পাশে থাকা ইমরানকে বলে- ‘তোর মামার বাড়ি তো সুন্দরবনের কাছাকাছি! তুই চিনিস না?’। ‘আরে চিনি না মানে! আমি তো শিশির মামার সাথে গতবছরও গিয়েছিলাম। বনরক্ষীরা দেখে ফেলায় ভেতরে ঢুকতে পারিনি’ – বলে বুক ফুলিয়ে নিজের সামর্থ্য ও ক্ষমতার জানান দেয় ইমরান।
আড্ডায় উপস্থিত মিঠুও যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করে। প্রায় সবকিছুতেই ঘাপলা পাকানো মিঠুকে প্রথমে ইমরান না নিতে চাইলেও আদনান আর জিসানের সুপারিশে তাকেও দলভুক্ত করা হয়। তখনই পরিকল্পনা হয়, ঈদের সালামি পেলে সবার হাতেই কিছু টাকা-পয়সা আসবে এবং সেসব নিয়েই তারা ঈদের দিন দুপুরের আগে আগে রওয়ানা দেবে। সৌন্দর্য ও রোমাঞ্চপ্রিয় কিশোরদলের যেই কথা সেই কাজ।
রিকশা ভাড়া নেওয়া অনুসারে তাদের গন্তব্য সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর এলাকা। রিকশাচালক কিশোরদলটিকে নিয়ে প্রায় হাওয়ায় ভেসে চলে। দ্রুত ঘূর্ণনে রিকশার প্যাডেলে কালো পিচঢালা পথ ক্রমশ পিছনে চলে যেতে থাকে।
প্রথমবারের মতো বড়দের অনুশাসনের বেড়াজাল ছেড়ে নিজেদের মতো করে পৃথিবী দেখার উত্তেজনায়, কিশোরদলের চার সদস্যের বুকের রক্ত ছলকে ছলকে ওঠে। পেছনদিকে ছুটতে থাকা রাস্তার দুপাশের গাছপালা তাদের কুর্ণিশ জানিয়ে যায়। ডালে ডালে বসে থাকা পাখিরা চার কিশোরের কলকাকলিতে তাল মিলিয়ে নতুন সুরে গান গেয়ে ডানা ঝাঁপটায়। কোনো কোনো পাখি এক ডাল থেকে আরেক ডালে ওড়ে যায়। বিপরীতমুখী বাতাস, নতুন ছোট্ট অভিযাত্রীদের মাথায় আদর বুলিয়ে চুল এলোমেলো করে দেয়।
কিছুক্ষণ পরই রিকশা এসে ধানসাগর থামে। ভেজা বাতাসের অন্যরকম একটা বুনোঘ্রাণ এসে নাকে লাগে। ভাড়া মিটিয়ে ইমরানের নেতৃত্বে কাঁচা রাস্তা ধরে চার কিশোর এগিয়ে যায়। বাসা থেকে না বলে আসা এই ছোট্ট পর্যটকদলের সাথে তেমন কিছুই নেই। বাসস্ট্যান্ড থেকে কেনা কিছু শুকনো খাবার, ফাস্ট এইড ব্যান্ড, অ্যান্টিসেপ্টিক ক্রিম আর ছোট কয়েক বোতল পানি। ছাত্রের ব্যাগ হিসেবে খাতা-পেন্সিল ও অন্যান্য কিছু দরকারি জিনিসসহ একটি ব্যাগ মিঠুর কাঁধে। ব্যাগটা মিঠুর কাঁধে থাকবে এটি যেন অবধারিতই ছিল। তাই ব্যাগ বিষয়ে বাকিরা মাথা ঘামানোর কোনো প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি।
এই এলাকায় জনবসতি কম হওয়ায় রাস্তায় মানুষজনের আজ তেমন কোনো আনাগোনা চোখে পড়ছে না। সারল্যমাখা লাবণ্যময় দুরন্ত এই কিশোরদলের গন্তব্য বিষয়ে জিজ্ঞেস করারও কেউ নেই। সুন্দরবন ও তার বৈচিত্র্যময় গাছগাছালি ও প্রাণিকুল বিষয়ক পুঁথিগত বিভিন্ন গল্পগাথা বলতে বলতে তারা হেঁটে যায়। মাঝে মাঝে আদনান ও জিসান মোবাইলে নিজেদের এবং পথের ধারের প্রাণ-প্রকৃতির ছবি তোলে। ঈদের দিনের ছবি তোলার বায়না ধরে আদনান নিয়ে এসেছে তার মায়ের মোবাইল আর জিসান নিয়ে এসেছে তার বড়ো আপুর মোবাইল। কিন্তু ছবি তোলায় বেশি সময় নষ্ট করতে দেখলেই ইমরান সবাইকে তাড়া দেয়।
এভাবে কিছুদূর এগিয়ে আসতেই ইমরানের নির্দেশে সবাই সতর্ক হয়ে পড়ে। সামনেই একটু দূরে বনরক্ষীদের অফিসঘরটা দেখা যায়। গতবারের অভিজ্ঞতা থেকে সে সবাইকে মনে করিয়ে দেয়- ‘বনরক্ষীরা দেখে ফেললে আমরা কিন্তু আর বনের ভেতর ঢুকতে পারবো না। কেউ এখন আর কোনো কথা বলবি না। একদম চুপচাপ থাকবি। মোবাইলে ছবি তোলাও বন্ধ রাখ। বনে ঢুকতে পারলে অনেক সুন্দর সুন্দর ছবি তুলতে পারবি।’
অভিজ্ঞতার বিচারে এগিয়ে থাকায় ইমরানের কথা সবাই বিনাবাক্যে মেনে নেয় এবং সতর্কতা নিয়ে দ্রুত পায়ে এগিয়ে যেতে থাকে। তারা যতটুকু এগিয়ে যেতে থাকে, বনরক্ষীদের অফিসঘরটাও ততটুকু কাছে আসতে থাকে। বনরক্ষীদের অফিসঘরটা যতটা কাছে আসতে থাকে, সতর্ক কিশোরদলের সদস্যদের বুকের দুরু দুরু কম্পনও ততটাই বাড়তে থাকে। কিন্তু উদ্যমী অভিযাত্রিকদল তাতে দমে না গিয়ে এতেও এক ধরনের রোমাঞ্চ অনুভব করে।
তাদের সে রোমাঞ্চকে আরও বাড়িয়ে দিতেই যেন বনরক্ষীদের অফিসঘরের কাছে কেউ একজন নড়েচড়ে ওঠে। চোখে পড়তেই চারজন মিলে রাস্তার পাশের মোটা একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। একজন আরেকজনের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলে, গায়ে গায়ে চেপে থাকে। নিস্তব্ধ চারপাশে তখন আর কোনো শব্দ নেই। তাই প্রত্যেকে প্রত্যেকের নিশ্বাসের শব্দের সাথে বুকের ভেতরের ধক ধক শব্দটাও ঢোলের বাদ্যের মতো শুনতে পায়।
সময় চলে যেতে থাকে, নিবিষ্টচিত্তে চারজন সামনের দিকে তাকিয়ে থাকে। বনরক্ষীদের ঘরের কাছে দেখতে পাওয়া নড়াচড়াটা একই রকম থাকে, ঠিক কোনো অবয়ব নিয়ে ধরা দেয় না। এমন সময় কারো হাঁচির শব্দে প্রায় পুরো সুন্দরবন এলাকা যেন কেঁপে ওঠে। শব্দটা পেছন দিক থেকে আসায় এবং জিসানের ঘাড়ে কিছু থুথু ছিটকে পড়ায়, জিসানের সাথে সাথে সামনে থাকা আদনান আর ইমরানও চট করে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকায়।
অপরাধী মুখে করে মিঠুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সবাই। পরক্ষণেই নিজের মুখে ডান হাতের তর্জনী রেখে সবাইকে চুপ থাকার ইশারা করে ইমরান। সামনের দিকে বকের মতো ঘাড় লম্বা করে বনরক্ষীদের ঘরের দিকে ধ্যানী হয় সে। আরও কিছুক্ষণ পর, নড়াচড়া করা অবয়বটা বাতাসে আরও একবার কেঁপে ওঠে কাপড়ের আকৃতি নিয়ে ধরা দিলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে চার কিশোর।
কিন্তু ইমরান চারদিকে আরও একবার সতর্ক চোখ বুলিয়ে নেয়। গতবার মামার সাথে এসে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যেতে হয়েছে। এবার আর সে ব্যর্থ হতে চায় না। তাহলে শহুরে দুই বন্ধুর কাছে তার মান থাকবে না। আশপাশে কাউকে দেখতে না পেয়ে ইমরান এবার পেছনে থাকা সবাইকে নিয়ে গাছের আড়াল থেকে বের হয়ে আসে। সাবধানি পায়ে আবারও সামনে এগোতে থাকে। গতি বাড়িয়ে দ্রুত বনরক্ষীদের অফিসঘরটা পার হয়ে যায়।
সামনেই খালের ওপর ছোট কাঠের পুলটা দেখা যায়। ইমরান সঙ্গীদের দিকে ফিরে ফিসফিস করে জানিয়ে দেয়- ‘ওই পুলটা পার হলেই আমরা সুন্দরবনে ঢোকার পথ পাবো। সবাই আরও তাড়াতাড়ি পা চালা।’ ইমরানের এই বার্তা পেয়ে উত্তেজনার ঢেউ বুকের পাড়ে আছড়ে পড়ে বাকিদের। হাঁটার গতি বাড়িয়ে কিশোরদল প্রায় দৌড়াতে শুরু করে। তাড়াতাড়ি পুলটা পার হয়ে সুন্দরবনে ঢোকার তাড়না সবাইকে তাড়িয়ে নিয়ে যায়। মোহাবিষ্ট হয়ে ছুটতে ছুটতে এগিয়ে চলা কিশোরদলের আর রাস্তার পাশে থাকা ‘প্রবেশ নিষেধ, বিপজ্জনক এলাকা’ লেখা সাইনবোর্ডটা চোখে পড়ে না। অবশ্য চোখে পড়লেও এই দুরন্ত কিশোরেরা তা আমলে নিতো কিনা বলা মুশকিল।
চলবে...