মারা যাওয়া ১ হাজার ৭০৩ জনের ৯৭০ জন নারী। অর্থাৎ নারীর মৃত্যুর হার ৫৬ দশমিক ৮৯ শতাংশ, যেখানে পুরুষ মারা গেছে ৭৩৫ জন বা ৪৩ দশমিক ১১ শতাংশ।
Published : 13 Jan 2024, 07:36 AM
গেল ১৯ অগাস্ট হালকা জ্বর আর বমি ছিল ফারজানা শারমিনের। এ অবস্থা নিয়েই পরদিন অফিস করেন প্রাইম ব্যাংকের এক্সিকিউটিভ অফিসার ফারজানা। এরপর দিন ২১ অগাস্ট পরীক্ষা করে জানতে পারেন তিনি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত।
ওই রাতে হাসপাতালে ভর্তি হলেও পরের চারদিন ডেঙ্গুর সঙ্গে লড়ে হেরে যান এই ব্যাংক কর্মকর্তা।
বিদায়ী বছরে মশাবাহিত এই রোগে মৃত্যুর তালিকায় ফারজানার মতো ৯৭০ জন নারীর নাম উঠেছে।
২০২৩ সালে ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া ১ হাজার ৭০৫ জনের ৫৬ দশমিক ৮৯ শতাংশই নারী। অথচ আক্রান্তদের তালিকায় নারীর হার ছিল ৪০ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ।
কম আক্রান্ত হলেও বেশি মৃত্যুর জন্য নারীর জীবনধারণ প্রক্রিয়াকে দায় দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা, যা নারীকে ডেঙ্গুর বদলে যাওয়া ধরণের ফাঁদে ফেলছে।
তাদের পর্যবেক্ষণ, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকার পাশাপাশি উদাসীনতা নারীর মৃত্যু বাড়িয়ে দিচ্ছে।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান-আইইডিসিআরের উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন বলছেন, নারীরা কাজে ব্যস্ত থাকায় নিজেদের জন্য সময় বের করতে পারেন না। বাসার পাশেই বিনামূল্যে ডেঙ্গু পরীক্ষা ও সেবা পাওয়ার সহজ ব্যবস্থা থাকা উচিত বলে মনে করেন তিনি।
২০২৩ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যু আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। গেল ১২ মাসে ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন। এর মধ্যে পুরুষ ১ লাখ ৯২ হাজার ৬১০ জন, নারী ১ লাখ ২৮ হাজার ৫৬৯ জন।
অর্থাৎ আক্রান্তদের ৫৯ দশমিক ৯৭ শতাংশ পুরুষ, যেখানে নারী আক্রান্ত হয়েছে ৪০ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ।
ডেঙ্গু আক্রান্তের লিঙ্গভিত্তিক এই হার মিলছে না মৃত্যুর হিসাবে। মারা যাওয়া ১ হাজার ৭০৩ জনের ৯৭০ জন নারী। অর্থাৎ নারীর মৃত্যুর হার ৫৬ দশমিক ৮৯ শতাংশ, যেখানে পুরুষ মারা গেছে ৭৩৫ জন বা ৪৩ দশমিক ১১ শতাংশ।
বয়সের হিসাবে ২০২৩ সালে সবচেয়ে বেশি ১৬৫ জনের মৃত্যু হয়েছে ৩৬-৪০ বছরের বয়সসীমায়, যার মধ্যে ১০৭ জনই নারী, পুরুষ ৫৮ জন। এছাড়া ৩১-৩৫ বছর বয়সী ১১৬ জন নারী ডেঙ্গুতে মারা গেছেন, এই বয়সসীমায় ৩৯ জন পুরুষের মৃত্যু হয়েছে।
১৬-২০ বছর বয়সসীমা এবং ৬০ বছরের উপরে পুরুষের মৃত্যু বেশি হলেও, অন্যসব বয়সসীমায় নারীর মৃত্যু হয়েছে বেশি।
মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ বলছেন, বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে নারীরা সবদিক থেকেই নিজের প্রতি যত্ন কম নেয়। সবার খোঁজ নিতে গিয়ে নিজের শরীরের যত্ন নেয় না, এমনকি অসুস্থ হলেও সেদিকে তার নজর থাকে না।
ডেঙ্গুর ধরণ বদলে যাওয়ায় নারীর এই মনোভাব যে মৃত্যু বাড়িয়ে দিয়েছে সে ইঙ্গিত দিলেন এই চিকিৎসক।
“অনেকেই ডেঙ্গু হলে সেটাকে স্বাভাবিক সর্দি-জ্বর মনে করেন। তারা টেস্ট করেন না। নিজের দিকে খেয়াল না করে কালক্ষেপণ করেন। ফলে সিরিয়াস পর্যায়ে চলে যায়।”
এ বি এম আবদুল্লাহর পর্যবেক্ষণ, খাওয়াদাওয়ার ক্ষেত্রেও নারীরা উদাসীন। শহরে নারীরা রোদের সংস্পর্শ কম পাওয়ায় অনেকের শরীরে ‘ভিটামিন ডি’-এর ঘাটতি থাকছে।
“তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও কম থাকে। তাতে সিরিয়াস পর্যায়ে চলে গেলে ধাক্কাটা আর সামলাতে পারে না। চিকিৎসার ব্যাপারে উদাসীন থাকায় তারা সবসময় দেরি করে ডাক্তারের কাছে যায়। কিন্তু পরিস্থিতি জটিল হয়ে গেলে তখন কিছু করার থাকে না। এ কারণে আক্রান্তের দিক থেকে পুরুষের সংখ্যা বেশি হলেও নারীদের মৃত্যু বেশি।”
নারীরা সহজে চিকিৎসকের কাছে যেতে চায় না উল্লেখ করে আইইডিসিআরের উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন বলেন, “ঘরের দায়িত্ব-কাজ শেষ করতে গিয়ে তারা ডাক্তারের কাছে যাওয়ার সময় করে উঠতে পারেন না। জ্বর আসলে তারা ভাবে এমনিতেই ভালো হয়ে যাবে। সে কারণে মনে করে টেস্ট করে কী হবে?
“কিন্তু জ্বর সারার পরেই তো বিপদে পড়ে। ডেঙ্গুতে জ্বর ভালো হয়ে যাওয়ার পরেই প্রেসার কমে যায়, মাথা ঘুরে পড়ে যায়, অজ্ঞান হয়ে যায়। শেষ মুহূ্র্তে হাসপাতালে যাওয়ার কারণে অবস্থা জটিল হয়ে পড়ে।”
ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া ফারজানা শারমিনের স্বামী দৈনিক সমকালের যুগ্ম বার্তা সম্পাদক জাহেদুল আলম রুবেল জানান, সন্তান ও সংসার সামলাতে গিয়ে ফারজানা নিজের যত্ন নেননি। অসুস্থ হওয়ার পর অফিসও করেছেন, এমন কিছু যে ঘটতে যাচ্ছে তা তাদের মনে হয়নি।
রক্তে প্লেইটলেট কম থাকায় দ্রুত তাকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। হাসপাতালে নিতে দেরি করা এখনো পীড়া দেয় রুবেলকে।
“প্রেসার পাওয়া যাচ্ছিল না। ব্লাড প্রেসারও কমে গিয়েছিল। তারপর হাসপাতালে ভর্তি করালাম। সাথে সাথে ডাক্তাররা ওকে আইসিইউতে নিল। পরদিনই লাইফ সাপোর্টে নেয়া হল। ডাক্তাররা জানালেন, কোনোভাবেই প্রেসার বাড়ানো যাচ্ছে না।”
স্ত্রীকে হারিয়ে দুই সন্তানকে নিয়ে জীবনযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া রুবেল বলেন, “সবকিছুই ফেইলিওর হচ্ছিল ওর। একদিনের জ্বরে কেউ চলে যেতে পারে, এটা মানতে পারি না।”
ঢাকার রূপনগরের তাহমিনা সিদ্দিকা লিনা ৬ নভেম্বর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। ৬ দিন হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয় তাকে।
শুরুতে ডেঙ্গুর তেমন কোনো লক্ষণ না থাকলেও পরে পরিস্থিতি গুরুতর হয় জানিয়ে লিনা বলেন, “হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার তৃতীয় দিন রাতে নাক দিয়ে রক্ত পড়া শুরু হয় এবং খিঁচুনি হয়ে অজ্ঞান হয়ে যাই। প্রেসার ৪০ এর নিচে নেমে গিয়েছিল।”
সম্প্রতি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়া মিরপুরের লুৎফুন্নাহার ফুরকান জানান, প্রথমে তিনি বুঝতেই পারেননি তার ডেঙ্গু হয়েছে।
“মনে হয়েছিল এটা সিজন্যাল ফ্লু। হঠাৎ একদিন শরীর অনেক খারাপ হয়ে গেল। চিকিৎসক দেখাতে গিয়ে দেখলাম প্রেসার আসছে না। রিপোর্ট পাওয়ার আগেই ডাক্তার ডেঙ্গুর চিকিৎসা শুরু করলেন।”
দ্রুত চিকিৎসা শুরু না করলে অবস্থা আরও খারাপ হত, মনে করেন ফুরকান।
চিকিৎসক এ বি এম আব্দুল্লাহ বলছেন, ধরণ বদলে যাওয়ায় অনেক সময় সহজেই ডেঙ্গু বোঝা যাচ্ছে না। সেজন্য অবহেলা না করে সামান্য সর্দি-কাশি, জ্বর হলেও ডেঙ্গুর টেস্ট করে নিতে হবে।
দ্রুত ডেঙ্গু শনাক্ত করে চিকিৎসা শুরু করলে নারীর মৃত্যু কমানো যেত, মনে করেন তিনি।
এজন্য স্বাস্থ্যসেবা খাতকে ঢেলে সাজিয়ে আরও সহজলভ্য ব্যবস্থা নিশ্চিতের তাগিদ দিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মুশতাক হোসেন।
“বাড়ির কাছে যদি বিনামূল্যে টেস্ট করার ব্যবস্থা থাকত, তাহলে তারা অবশ্যই যেত। তারা মনে করে একটা টেস্ট করে এত টাকা খরচ করব কেন? ওষুধের পেছনেও খরচ হবে। যেহেতু স্বাস্থ্যসেবাটা সহজলভ্য নয়, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ঘরের পাশে নাই, তাই নারী-পুরুষ উভয়েই বঞ্চিত হচ্ছে।”
মুশতাক হোসেন বলেন, “বাসার পাশের হাসপাতালেই বিনামূল্যে ডেঙ্গু পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকা উচিত। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র- মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মাঝখানে একটি সেকেন্ডারি হাসপাতাল থাকতে হবে। যেখানে ক্রিটিক্যাল নয়, এমন ডেঙ্গু রোগীরা চিকিৎসা পাবে।”
সরকারের ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনা নিয়ে ক্ষুব্ধ ফারজানা শারমিনের স্বামী জাহেদুল আলম রুবেল বলেন, “ডেঙ্গুতে এতো মানুষ মারা যাচ্ছে, কিন্তু এর দায় সরকার নিচ্ছে না। সরকার মশা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। মশা মারার প্রকল্প লুটপাটে পরিণত হয়, সফল হয় না। তাহলে ডেঙ্গু কমবে কীভাবে? সরকারের কার্যক্রমকে ঢেলে সাজাতে হবে।”