“ডেঙ্গু এখন সারা বছরই থাকবে। এতে কিছু মানুষ ঝুঁকিতে রয়েছেন। বিশেষ করে বয়স্ক মানুষ, যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, গর্ভবতী নারী ও শিশুরা আক্রান্ত হলে তাদের মৃত্যুঝুঁকি বেশি।”
Published : 12 Jan 2024, 10:21 PM
শীতকাল অর্ধেক পার হতে চললেও এইডিস মশা টিকে আছে বেশ; প্রতিদিনই ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে মানুষ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত কয়েক বছর ধরে শীতের সময়ও এইডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানা কারণে ডেঙ্গু রোগ এখন সারা বছরই থাকবে। মশা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে তবেই নিয়ন্ত্রণে থাকবে এ রোগের বিস্তার।
বাংলাদেশে পৌষ ও মাঘ মাস শীতকাল। ইংরেজি মাসের হিসেবে মধ্য নভেম্বর থেকে জানুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত। তবে শীতশীত ভাব আরও একটু আগে শুরু হয়, আর শীতের আমেজ থাকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।
বাংলাদেশে গত কয়েক বছরের তথ্যে দেখা গেছে, জুলাই মাস থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত ডেঙ্গু সংক্রমণ চূড়ায় অবস্থান করে। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী পাওয়া যায় নভেম্বর-ডিসেম্বর এমনকি জানুয়ারি মাস পর্যন্ত।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, শুক্রবার সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৭ জন রোগী। এদিন সারাদেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন ২৭৯ জন।
বছরের প্রথম ১১ দিনে সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৬০৭ জন। এ সময় মৃত্যু হয়েছে চারজনের।
২০২৩ সালের জানুয়ারির প্রথম ১১ দিনে ২১০ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়। ওই সময় ১ জনের মৃত্যু হয়েছিল।
মহাখালীর ডিএনসিসি হাসপাতালে মঙ্গলবার ২০ জন রোগী ভর্তি ছিলেন। এদের মধ্যে গাজীপুরের কোনাবাড়ি এলাকা থেকে আসা রফিকুল ইসলাম ইমনকে ভর্তি করা হয়েছে নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে।
ইমনের স্ত্রী শীলা আহমেদ জানালেন,গত ৬ জানুয়ারি তার স্বামী জ্বরে আক্রান্ত হন। স্থানীয়ভাবে নমুনা পরীক্ষায় ডেঙ্গু ধরা পড়ে। চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ খেলেও অবস্থার উন্নতি হচ্ছিল না। মঙ্গলবার তাকে ডিএনসিসি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
“জ্বর কমেও না বাড়েও না। প্লেইটলেট নাইমা আসছে ২৭ হাজারে। সঙ্গে পাতলা পায়খানা, বমি। অবস্থা খারাপ বইলা নিয়া আসি। আইসিইউতে ভর্তি করাইছে।”
গত বুধবার ওই হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি ছিলেন তিনজন রোগী। তাদের একজন রামপুরার ৫ বছর বয়সী জান্নাত।
তার বাবা মোহাম্মদ টিপু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গত সপ্তাহে ডেঙ্গু ধরা পড়ার পর দুই দিন মগবাজারের আদ-দ্বীন হাসপাতালে ভর্তি ছিল তার মেয়ে। মঙ্গলবার ডিএনসিসি হাসপাতালে আনা হয় তাকে।
“রক্তের হিমোগ্লোবিন কমে গেছিল। প্রেসার উঠতেছিল না। এজন্য ডাক্তার আইসিইউতে ভর্তি করাতে বলছে।”
ঢাকার বেসরকারি সেন্ট্রাল হাসপাতালে ভর্তি নরসিংদীর মাধবদীর মোতালেব হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, ৩১ ডিসেম্বর নমুনা পরীক্ষা করলে ডেঙ্গু ধরা পড়ে। প্লেইটলেট কমে যাওয়া, শরীর বেশি খারাপ হওয়ায় হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দেন চিকিৎসক।
“শরীর খুব দুর্বল, খাইতে পারছিলাম না, বমি হইতেছিল। ডাক্তার হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দিল. তাই এইখানে আইসা ভর্তি হইছি। এখন অবস্থা একটু ভালো।”
নভেম্বরে ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর চিত্র
বছর | ২০১৮ | ২০১৯ | ২০২০ | ২০২১ | ২০২২ | ২০২৩ |
ভর্তি রোগী | ১১৯২ | ৪০১১ | ৫৪৬ | ৫৬৭ | ১৯৩৩৪ | ৪০৭১৬ |
২০২২ সালে বছর জুড়ে মোট রোগী ভর্তি হয়েছে ৬২ হাজার ৩৩৫ জন, অর্থাৎ ওই বছর মোট ভর্তি রোগীর ৩১ শতাংশই ছিল নভেম্বর মাসে। ২০২৩ সালে মোট ভর্তি রোগীর ১২ দশমিক ৭০ শতাংশ ভর্তি হয়েছে নভেম্বর মাসে।
ডিসেম্বরে ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর চিত্র
বছর | ২০১৮ | ২০১৯ | ২০২০ | ২০২১ | ২০২২ | ২০২৩ |
ভর্তি রোগী | ২৯৩ | ১২৪৭ | ২৩১ | ১২০৭ | ৫০৪০ | ৯২৮৮ |
জানুয়ারিতে ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর চিত্র
বছর | ২০১৯ | ২০২০ | ২০২১ | ২০২২ | ২০২৩ | ২০২৪ (১১ দিন) |
ভর্তি রোগী | ৩৮ | ১৯৯ | ৩২ | ১২৬ | ৫৬৬ | ৬০৭ |
ঢাকায় এখনও মশার উপস্থিতি
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার জাতীয় ম্যালেরিয়া ও এইডিসবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আওতায় গত বছরের ৮ থেকে ১৮ ডিসেম্বর ঢাকার ৯৯টি ওয়ার্ডে বর্ষা পরবর্তী মশার জরিপ চালায়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জরিপের ফল অনুযায়ী, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৫৯টি ওয়ার্ডের ১৮১৫ বাড়ি পরিদর্শন করে ২২৪টি বাড়িতে পাওয়া গেছে এইডিস মশার লার্ভা। অর্থাৎ ১২ দশমিক ৩৪ শতাংশ বাড়িতেই এখনও এইডিস মশার লার্ভা আছে।
উত্তর সিটি করপোরেশনের ৪০টি ওয়ার্ডের ১৩৩৪টি বাড়ি জরিপ করে ১৫৫টি, বা ১১ দশমিক ৬২ শতাংশ বাড়িতে এইডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে।
কোনো এলাকার ব্রুটো ইনডেক্স ২০ এর বেশি হলে সেখানে মশার ঝুঁকিপূর্ণ উপস্থিতি বিবেচনা করা হয়।
দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পরিদর্শন করা ৫৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে ২১টির ব্রুটো ইনডেক্স ২০-এর বেশি। অর্থাৎ ৩৫ দশমিক ৬০ ওয়ার্ডে মশার উপস্থিতি এখনও ঝুঁকিপূর্ণ।
ডিএনসিসির ৪০টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১১টি ওয়ার্ডের ব্রুটো ইনডেক্স ২০ এর বেশি। অর্থাৎ, ২৭ দশমিক ৫ শতাংশ ওয়ার্ডে মশার উপস্থিতি ঝুঁকিপূর্ণ।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এইডিস মশা এখন সারাদেশে সারা বছরই থাকবে। কারণ এইডিস মশা প্রজননের জন্য যে তাপমাত্রা দরকার তা সারা বছরই থাকে। এরসঙ্গে পানি যোগ হলে এইডিস মশার প্রজনন হবে।”
“মশা তার প্রজননের জন্য কিছু কিছু জায়গায় এখনও পানি পেয়ে যাচ্ছে। নির্মাণাধীন ভবন, বহুতল ভবনের পার্কিংয়ে গাড়ি ধোয়ার জায়গা, বাসায় পানি জমিয়ে রাখার স্থানে এইডিস মশা পাওয়া যাচ্ছে।”
তিনি বলেন, “এইডিস মশা যেহেতু পাওয়া যাচ্ছে সেহেতু ডেঙ্গুও থাকবে। তবে শীতকালে মশা কম পাওয়া যাবে। ডেঙ্গু থেকে আমাদের মুক্তি নাই।”
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মশা কমলেও একেবারে শূন্যের কোটায় আসবে না। কারণ তাপমাত্রা ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের চেয়ে কম হলে মশার লার্ভা জন্মাতে পারে না। দেশে এখনও তাপমাত্রা এর নিচে নামেনি।
“তাছাড়া আমাদের দেশে অপরিচ্ছন্নতার কারণে বৃষ্টি ছাড়াও নিত্য ব্যবহার্য পানি জমে থাকছে। বোতলে, কনটেইনারে পানি জমে থাকছে। আমরা আমাদের পরিবেশকে নোংরা করে ফেলেছি।”
তিনি বলেন, ডেঙ্গু এখন সারা বছরই থাকবে। এতে কিছু মানুষ ঝুঁকিতে রয়েছেন। বিশেষ করে বয়স্ক মানুষ, যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, গর্ভবতী নারী ও শিশুরা আক্রান্ত হলে তাদের মৃত্যুঝুঁকি বেশি।
“বাংলাদেশে যেহেতু ডেঙ্গুর অনেকগুলো সেরোটাইপ পাওয়া গেছে, যেহেতু ডেঙ্গু আক্রান্ত গুরুতর রোগীর সংখ্যাও অনেক বেশি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।”