‘পাপমুক্ত সিনেমা’ কী? যা বোঝালেন রাসেল মিয়া

ভাইয়ারের ‘নির্মাতা’ বদলে দিতে চাইছেন তার আগের বক্তব্য; এড়িয়ে যেতে চাইছেন আগের ঘটনা।

মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 Sept 2022, 02:45 AM
Updated : 8 Sept 2022, 02:45 AM

‘পাপমুক্ত’ সিনেমা বানানোর দাবিদার রাসেল মিয়াকে নিয়ে আলোচনার পারদ চড়ছে।

একজন বাউল শিল্পীর নামে মামলা এবং সাজাপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীর মুক্তির দাবি করে তার বক্তব্য নতুন করে উঠে আসছে আলোচনায়।

সেই সঙ্গে অভিযোগ উঠেছে, নারীর প্রতি সহিংসতা উসকে দেয় এমন দৃশ্যে অভিনয় করেছেন রাসেল। পাশাপাশি রকিবুল আলম রকিব নামের এক পরিচালকের নামের আড়ালে পরিচালক সেজেছেন তিনি।

এসব অভিযোগ নিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পক্ষ থেকে রাসেল মিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সব বিতর্ক এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। নিজের আগের বক্তব্যের নতুন ব্যাখ্যা দেওয়ারও চেষ্টা করেন তিনি।

গত শুক্রবার সাতটি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় ‘ভাইয়ারে’ সিনেমাটি। মুক্তির আগে এ সিনেমার অভিনয়শিল্পী হেলেনা জাহাঙ্গীরকে বলতে দেখা গিয়েছিল, “এটি একটি পাপমুক্ত ছবি। কেউ ওজু করে সিনেমাটি দেখে গিয়ে নামাজ পড়তে পারবেন। ওযু নষ্ট হবে না।”

সিনেমা মুক্তির পর একটি প্রেক্ষাগৃহের সামনে কান্নারত রাসেল মিয়াকে বলতে দেখা যায়, “আল্লাহর কসম, আমি কোরআন শরিফের উপর হাত রেখে বলতে পারি, এটা আসলেই একটা পাপমুক্ত ছবি।”

সিনেমার প্রচারে ‘পাপমুক্ত’ শব্দটা ব্যবহার করার কারণ জানতে চাইলে রাসেল এর দায় হেলেনা জাহাঙ্গীরের উপর চাপিয়ে দেন।

তিনি বলেন, “পাপমুক্ত ছবি এটা আমি বলিনি। হেলেনা জাহাঙ্গীর আপা বলেছেন।”

‘পাপমুক্ত’ সিনেমা বলতে কী বোঝাতে চেয়েছেন, তা জানতে চাইলে হেলেনা জাহাঙ্গীর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটা তো পাপমুক্ত ছবি। এখানে ব্যক্তিগত কোনো পাপ হয়নি।”

ব্যক্তিগত পাপ বলতে কী বুঝিয়েছেন- জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, “এটি অশ্লীলতামুক্ত ছবি।”

Also Read: সোশাল মিডিয়ায় ‘অপপ্রচারের চক্র’ গড়েছিলেন হেলেনা জাহাঙ্গীর: র‌্যাব

Also Read: জামিন পেলেন হেলেনা জাহাঙ্গীর, মুক্তিতে ‘বাধা নেই’

এফবিসিসিআইর পরিচালক, জয়যাত্রা গ্রুপের কর্ণধার এবং জয়যাত্রা টেলিভিশনের চেয়ারপারসন হেলেনা জাহাঙ্গীর নানা মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে গত বছর কিছুদিন কারাগারে ছিলেন।

হেলেনা জাহাঙ্গীর আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক উপকমিটির সদস্য ছিলেন। কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগেরও উপদেষ্টা পরিষদে ছিলেন তিনি। ‘বাংলাদেশ আওয়ামী চাকরিজীবী লীগ’ নামের একটি ‘ভূইফোঁড়’ সংগঠনে তার সভাপতি হওয়ার খবর চাউর হলে তাকে দুই কমিটি থেকেই বাদ দেয় আওয়ামী লীগ।

হেলেনার মতো তিনিও ‘পাপমুক্ত’ বলেছিলেন- এমন ভিডিও থাকার কথা মনে করিয়ে দিলে রাসেল বলেন, “আমি রাসেল মিয়া বারবার বলছি সিনেমা পাপমুক্ত, সিনেমা হালাল। সিনেমা করতে গিয়ে কাহারও হাত পর্যন্ত ধরিনি, এটা আমি বোঝাতে চাইনি।

“আমি বোঝাতে চেয়েছি ভাইয়ারে ছবিটি করতে গিয়ে আমরা ব্যক্তিগত কোনো পাপ করিনি। ব্যক্তিগত পাপ ছাড়াও যে চলচ্চিত্র অঙ্গনে শতশত সিনেমা নির্মাণ হয়ে থাকে, আমি সেটাই প্রিয় দর্শকদের বোঝাতে চেয়েছি।”

আবেগের বশে পাপমুক্ত বলে ফেলেছিলেন দাবি করে তিনি বলেন, “আপনারা দেখেছেন, ভাইয়ারে ছবি নিয়ে শুটিং থেকে শুরু করে প্রচার-প্রচারণায় আমি যে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছি, এই পরিশ্রমের ফলাফল হিসেবে চিত্রামহল সিনেমা হলে আমি যখন হাউজ ফুল দর্শক দেখতে পাই, তখন সাংবাদিকদের সামনে আবেগে আপ্লুত হয়ে কসম খেয়ে বলে ফেলেছি, এই ছবি করতে গিয়ে আমি ব্যক্তিগত কোনো পাপ করিনি।

“আমার এই কথায় যদি কোন ধর্মপ্রাণ মানুষ কোনো ধরনের কষ্ট পেয়ে থাকেন, তাহলে আমাকে আল্লাহর ওয়াস্তে মাফ করে দিবেন।”

সম্প্রতি রাসেল মিয়ার একটি শুটিং দৃশ্য ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়েছে, যা ধরে তার ‘পাপমুক্তির’ দাবিতে কটাক্ষ করা হচ্ছে।

সে বিষয়ে রাসেল বলেন, “এটা তো ছড়িয়ে পড়ার কিছু নাই। আমার শুটিংয়ের স্বাভাবিক একটা ছবি, যা ফেইসবুকেই দেওয়া আছে। সেই ছবিটা কেউ এডিট করে অন্তরঙ্গ করে ছেড়ে দিয়েছে। মিডিয়াগুলো যাচাই না করেই নিউজ করে দিচ্ছে।

“এক শ্রেণির মানুষ আমার বিরুদ্ধে লেগেছে। আমি তাদের বেতন দিই না, তাও আমার পিছে কাজ করছে। কেউ যদি এটা করে শান্তি পায় করুক।”

২০২০ সালে বাউলশিল্পী রিতা দেওয়ানের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন রাসেল।

একজন চলচ্চিত্রের মানুষ হয়ে সংগীতশিল্পীর বিরুদ্ধে মামলার করার কারণ জানতে চাইলে রাসেল বলেন, “মামলা করেছি, কারণ প্রকাশ্যে উনি আল্লাহকে নিয়ে কটূক্তি করেছে। এমন কথা বলেছে মুসলমান হিসেবে আমার আঘাত লেগেছে। দেখলাম আর কেউ প্রতিবাদ করছে না। ভাবলাম যা হওয়ার হবে, আমি এর প্রতিবাদ করব। সেই চিন্তা থেকেই আইনের আশ্রয় নেওয়া।”

মামলা করে তাকেই আদালতে বেশি ‘দৌড়াতে’ হচ্ছে দাবি করে তিনি বলেন, “আমি সাড়ে তিন বছর ধরে মামলাটা টানছি। প্রতি মাসে একবার হাজিরা দিচ্ছি। সে হাজিরা দিয়েছে মাত্র দুই বার।”

যুদ্ধাপরাধের দায়ে দণ্ডিত একজন আসামির মুক্তি চাওয়ার বিষয়ে রাসেল বলেন, “আমি একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। একজন ইউটিউবার আমাকে বলল, ‘আপনি উনার মুক্তি চান?’ বললাম, আমি মুক্তি চাইব কেন? শুধু বলেছি- আমার নেত্রী, আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী, তার বিবেচনায় যা হবে তিনি তাই করবেন।”

“আমি শুধু এটুকুই বলেছি। আমার বক্তব্য ভুলভাবে প্রচার হইছে। সে সময় যুবলীগের এক নেতা আমাকে ফোন দিয়ে বলল, ‘আপনি কি তার মুক্তি চেয়েছেন?’ বললাম, আমি এভাবে বলছি। সেটা অন্যভাবে প্রচার করছে। আমি মুক্তি চাইলেই কি মুক্তি দিবে? আমি কি আইনের লোক? প্রচলিত আইনে যা হওয়ার তাই তো হবে।”

রাসেল মিয়ার রাজনৈতিক পরিচয় সম্পর্কেও জানতে চাওয়া হয়েছিল হেলেনা জাহাঙ্গীরের কাছে। প্রথমে তিনি প্রশ্নটি এড়িয়ে যেতে চান। পরে বলেন, “দেখেন আমার কি কারও সম্পর্কে অত খোঁজ নেওয়ার সময় আছে? যদি অভিযোগ সত্য হয়, তাহলে রাসেলের সঙ্গে আর কাজ করব না।”

গুঞ্জন রয়েছে, ভাইয়ারে সিনেমাটি প্রথমে ইউটিউবে মুক্তি দেওয়ার জন্য বানানো হয়েছিল। যা পরে আরেকটু লম্বা করে সিনেমা হলে মুক্তি দেওয়া হয়।

এ প্রসঙ্গে রাসেল বলেন, “গত এক যুগে কোনো দর্শক বলতে পারছে, সে সিনেমা দেখে কান্না করছে? আমার ভাইয়ারে দেখে হল থেকে বের হয়ে দর্শক বলছে, ‘আমরা কান্না করছি’। কে বলে টেলিফিল্ম থেকে সিনেমা বানানো? দর্শক যা বলবে আমি তো তাই মানব?”

প্রেক্ষাগৃহে সিনেমা মুক্তি দিতে হলে নির্মাতার পরিচালক সমিতির সদস্য হতে হয়। অভিযোগ আছে, ভাইয়ারে বানিয়েছেন রাসেল মিয়া নিজে। কিন্তু তিনি পরিচালক সমিতির সদস্য নন বলে রকিবুল আলম রকিবের নামে মুক্তি দিয়েছেন। এমন অনেকেই করেন। এফডিসিতে বিষয়টিকে বলে- ‘পরিচালক ভাড়া করা’।

‘ভাইয়ারে’ সিনেমার পরিচালক রকিব শুরু থেকে সিনেমার সঙ্গে ছিলেন কি না- জানতে চাইলে রাসেল বলেন, “একবারে শুরু থেকে ছিলেন না। তিনি পরে যুক্ত হয়েছেন।”

রকিবের ভাইয়ারে সিনেমায় অন্তর্ভুক্তির ঘটনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “ছবির কাজ ওপেনিংয়ের সময় তিনি সিনেমার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। এক-দুইদিন পরে এসে ইন করেছেন। টোটাল ছবিটা তার হাত দিয়েই শেষ হয়েছে।”

রাসেলের হয়ে ভাড়া খাটার অভিযোগ অবশ্য রকিবও অস্বীকার করেন।

এত সমালোচনার মধ্যেও আরও দুটি সিনেমার কাজ শুরু করতে যাচ্ছেন রাসেল।

তিনি বলেন, “দুইটা সিনেমার কাজ শুরু করব। খুব শিগগিরই শুটিং হবে। দুই-একদিনের ভেতর সাংবাদিক ডেকে সিনেমার নাম, শিল্পীদের নামসহ বিস্তারিত জানানো হবে।”

চলচ্চিত্রে থেকে যাওয়ার পরিকল্পনাই করছেন রাসেল। তার ভাষ্যে, “আমি চলচ্চিত্রে এসেছি। চলচ্চিত্রেই থাকব। ভাইয়ারে ছবিটা দেখে দর্শক কান্না করেছেন। আমি তাদের কথা দিতে পারি, আগামীতে আরও ‘হার্টটাচ’ ছবি আমি উপহার দেব।”