সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের ব্যবস্থাপনায় ২০০৮ সাল থেকে এ আয়োজন করে চলেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নাট্য সংসদ
Published : 16 Dec 2023, 10:16 PM
দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের দৃশ্য এবং বাঙালির বিজয়ের ক্ষণটি নিজ চোখে দেখতে অধীর অপেক্ষায় হাজারো মানুষ; ইতিহাসের সেই মাহেন্দ্রক্ষণটি নাটকের মধ্য দিয়ে ফিরিয়ে আনা হল ঐতিহাসিক সেই রেসকোর্স ময়দানেই, যা আজ মানুষ সোহরাওয়ার্দী উদ্যান নামে চেনে।
১৯৭১ সালের বিজয় দিবসে দর্শকদের জন্য কোনো চেয়ার ছিল না। তবে সেই ঘটনা নিয়ে নাটক দেখতে দর্শকদের জন্য ছিল অনেক চেয়ার। চেয়ারে জায়গা না হওয়ায় মঞ্চের চারদিকে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন অনেকে। এমনকি রাস্তাতেও ছিল প্রচণ্ড ভিড়। ফাঁকা জায়গা ছিল না একটুকু, যেন ‘তিল ঠাঁই আর নাহিরে’।
নাটকের অভিনেতা অমিতাভ রায় জানালেন, এক যুগের বেশি সময় ধরে প্রতিবারই বিজয় দিবসে পুনর্মঞ্চায়ন করা হচ্ছে ঐতিহাসিক এই ঘটনাটি। শুরু থেকেই মিত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জগজিৎ সিং অরোরার চরিত্রে অভিনয় করে আসছেন তিনি।
নাটক শেষে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপে অমিতাভ রায় বলেন, “নাটকটি শুরু হয়েছিল ২০০৮ সালে। মাঝে মহামারীর সময় দুবার বিরতি পড়েছে।”
অরোরা চরিত্রে অভিনয় করার অনুভূতি জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, “২০০৮ সাল থেকে আমি অরোরা চরিত্রে অভিনয় করছি। যখন দেশের পক্ষে পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের স্বাক্ষর নিই, তখন একটা অন্যরকম অনুভূতি কাজ করে। ভালো লাগা থেকেই এ দীর্ঘ সময় ধরে অভিনয় করছি। হাজার হাজার মানুষ যখন এই মাহেন্দ্রক্ষণ দেখতে আসে, তখন গর্বে বুক ভরে যায়। মাঝেমধ্যে নিজেই ভুলে যাই এটা নাটকের মঞ্চ।”
পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের সেই দৃশ্য দেখতে আসা ছোট্ট শিশুটির চোখে এ নাটকই যেন বাস্তব। মা-বাবার সঙ্গে আসা ছোট্ট মেয়েটির চোখেমুখেও উচ্ছ্বাস খেলা করছিল।
আত্মসমর্পণের ক্ষণটি ছিল ১৬ ডিসেম্বর বিকাল ৪টা ৩১ মিনিট। সাধারণত ঠিক ওই সময়েই শুরু হয় নাটক। তবে এবারের বিজয় দিবসে একটু পরে শুরু হল মঞ্চায়ন। তবে ভিড় জমে গিয়েছিল নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই।
সকলের অপেক্ষার মধ্যেই মঞ্চের দিকে একটি জিপ গাড়ি আসতে দেখা যায়। গাড়ির সঙ্গে হেঁটে আসছে অসংখ্য মানুষ। রাস্তা খালি রাখার জন্য অনবরত হুইসেল বাজানো হচ্ছিল।
হুইসেল বাজাতে বাজাতে মঞ্চে ওঠানো হল পরাজিত পাকিস্তানি বাহিনীর জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজীকে। অরোরার কাছে আত্মসমর্পণের চুক্তিতে সই করলেন তিনি।
মাত্র সাত থেকে আট মিনিটের এই নাটক দেখেই উপস্থিত দর্শক যেন বিজয় উল্লাসে মেতে উঠল। আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে সবার মুখে একটাই ধ্বনি–‘জয় বাংলা'।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে শেষ হয় দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর বাঙালি নিধনযজ্ঞ। বাঙালির সেই ঐতিহাসিক বিজয়ের মুহূর্তের মঞ্চায়ন করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নাট্য সংসদ। অনুষ্ঠানটির আয়োজন ও সার্বিক ব্যবস্থাপনায় ছিল 'সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম-মুক্তিযুদ্ধ’৭১'৷
কয়েক মিনিটের নাটকটি স্মরণ করিয়ে দেয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মম থাবা থেকে মাতৃভূমিকে মুক্ত করতে দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধ আর লাখো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার ইতিহাস।
নিয়াজী সেদিন ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈনিককে সঙ্গে নিয়ে জেনারেল অরোরার নেতৃত্বাধীন ভারতীয় সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন। আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠানে সাক্ষী হিসাবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের প্রতিনিধি এ কে খন্দকার।
নাটকে নিয়াজী চরিত্রে অভিনয় করেছেন সুমন পারভেজ, অরোরা চরিত্রে অমিতাভ রায়, নেভি অফিসার চরিত্রে লিপটন ইসলাম, জ্যাকব চরিত্রে খন্দকার মো. লেনিন, সগত সিং চরিত্রে তাপস সরকার রুদ্র, দেওয়ান চরিত্রে দিগার মো. কৌশিক, পাঞ্জাবি চরিত্রে বাঁধন ও নাসিফ, এ কে খন্দকার চরিত্রে সাজ্জাদ, হায়দার চরিত্রে অভিনয় করেছেন শাফিন ইসলাম।
এছাড়াও ধারাভাষ্য লেখক ও বর্ণনাকারী ছিলেন শেখ জাহিদ আজিম। তারা সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নাট্য সংসদের সাবেক ও বর্তমান সদস্য।