“আমি যে ফর্মগুলো দেখেছিলাম, সেগুলো অতি সাধারণ টু অ্যান্ড ফ্রো ফর্ম। আমি তোমাকে গান শোনাচ্ছি-এটাই ফর্ম।“
Published : 16 Feb 2025, 05:17 PM
বয়স যখন বারোতে, তখন কবি মঙ্গলচরণ চট্টোপাধ্যায়ের ‘আমি ধান কাটার গান গাই’ কবিতায় প্রথম সুর দেন প্রতুল মুখোপাধ্যায়। এরপর কিশোর থেকে তারুণ্য এবং পরের জীবনে এসে তিনি সুর দিয়েছেন সুকান্ত ভট্টাচার্য, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, অরুণ মিত্র, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষের মত কবিদের কবিতাতেও। প্রথম জীবনে গান লেখার কথা মাথাতেই না আনা এই গায়ককে গীতিকার করে তোলে সত্তরের দশকে পশ্চিমবঙ্গের নকশালবাড়ি আন্দোলন।
কলকাতার সংবাদমাধ্যম রোববারডটইনে প্রকাশিত প্রতুলের একটি সাক্ষাৎকার থেকে প্রতুলের গীতিকার হয়ে ওঠার গল্প জানা গেছে।
প্রতুল না ফেরার দেশে চলে গেছেন শনিবার সকালে। ৮৩ বছর বয়সী প্রতুলকে জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে এই হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন শিল্পী। এর মধ্যে প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের শরীরে একটি অস্ত্রোপচার হয়। এরপর তার হার্ট অ্যাটাকও হয় এবং তিনি আক্রান্ত হন নিউমোনিয়াতেও।
চেতনা হারালে গত মঙ্গলবার তাকে হাসপাতালের আইটিইউতে নেওয়া হয়েছিল। সেখান থেকে আর ফেরানো যায়নি গানে গানে মানুষের কথা বলে যাওয়া এই শিল্পীকে।
সাক্ষাৎকরে প্রতুল বলেন, “প্রথমে গান আমি লিখতে পারতাম না। এদিক ওদিক কবিতায় সুর দিতাম। সুর দেওয়াটা আমার সহজাত ছিল। কিন্তু নকশালবাড়ি আন্দোলন আমাকে গীতিকার করেছে। ওরা (নকশাল) যে 'তিনটি প্রবন্ধ' পড়ে, সেখানে নানারকমের তত্ত্ব আছে, কোটেশন আছে। এগুলো কী পড়ে পড়ে শোনাবে?
“এগুলো যদি গান করে শোনানো হত, তাহলে সহজে বোঝানো যেত। মাও সে তুং বলেছেন- মৃত্যু অবসম্ভাবী, কিন্তু সমস্ত মৃত্যু সমান নয়। সেখান থেকেই- 'জন্মিলে মরিতে হবে রে, জানে তো সবাই/ তবু মরণে মরণে অনেক/”
সরকারি কর্মকর্তা হওয়া সত্ত্বেও প্রতুল নকশাল আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। সাংস্কৃতিক কর্মী হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন আন্দোলনে। যদি রাজনৈতিক চেতনা তার তৈরি হয়েছিল ১০ বছর বয়সে। যে চেতনা যুগিয়েছিল একই বই। সত্তরে আন্দোলনের দামামা যখন তুঙ্গে তখন বহু গান তরুণ আন্দোলনকারীদের মুখে মুখে তুলে দিতেন প্রতুল।
“সূর্য রায়ের আঁকা ছবি, সুকান্ত ভট্টাচার্য ও মঙ্গলাচারণ চট্টোপাধ্যায়ের, বিষ্ণু দে, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের লেখা ছড়া। আইপিটিএ আমলের বই। এই বইটা দাদা আমাকে উপহার দিয়েছিল। তাতে লেখা ছিল, 'পানু বড় হও'। সেই পাতা ছিঁড়ে গেছে। আমার ডাকনাম পান্না, সেখান থেকে এই নামটা এসেছে। তো এই বইটা ছিল আমার কমিউনিস্ট আদর্শ প্রথম পাঠ।“
গানের আসরে প্রতুল সাধারণত খালি গলায় গাইতেন। তার পরিবেশনায় হারমোনিয়াম, তবলা বা কোনো ধরনের বাদ্যযন্ত্রের প্রয়োজন হয়নি। ভিন্ন গায়কি তৈরি করে এই ‘টেনর কণ্ঠের’ গায়ক গাইতেন।
পরিবেশনার সেই স্বকীয় ধরন নিয়ে প্রতুলের ভাষ্য তিনি কীভাবে গান করবেন সেটি নিয়ে তার কোনো ধারণাই ছিল না।
প্রতুল বলেন, “এই ফর্মটা পেলাম কারণ অন্য কোনও ফর্ম সম্পর্কে আমার কোনও ধারণাই ছিল না। এটা করব না, সেটা করব না- এই সিদ্ধান্তটা আমাকে নিতে হয়নি। আমি যে ফর্মগুলো দেখেছিলাম, সেগুলো অতি সাধারণ টু অ্যান্ড ফ্রো ফর্ম। আমি তোমাকে গান শোনাচ্ছি-এটাই ফর্ম। আমার প্রথম দেখা স্টেজ পারফরম্যান্স জলসা। '৪২-এ আমার জন্ম, বুঝতেই পারছ আমি কত পুরনো লোক।
“চুঁচুড়োতে জলসায় দেখতাম ঘড়িমোড়ের কাছে ছোট একটা জায়গা ঘিরে ফেলে, মাথায় ছাউনি মতো দিয়ে দেওয়া হল। কে আসবে? শ্যামল মিত্র। কিছুই না- একটা স্টেজ, একটা হারমোনিয়াম নিয়ে শ্যামল মিত্র এলেন, একজন তবলিয়া এলেন, একজন অ্যানাউন্স করলেন- 'গান শোনাবেন শ্যামল মিত্র, তবলায় সঙ্গত করবেন', শুরু হল 'সেদিনের সোনাঝরা সন্ধ্যায়'। এটাই শুধু দেখেছি। “
নিজের গানে কীর্তনের প্রভাবের কথাও বলেছেন প্রতুল।
তিনি বলেন, “আরেকটা ফর্ম দেখেছিলাম। আমাদের বাড়ির সামনে মাঝে মাঝে অহরাত্র কীর্তন হত। সেখানে সবাই উন্মাদের মতো নৃত্য করত। ভাবটা অনেকটা রক মিউজিকের সঙ্গে মেলে। এই কীর্তন ও নাচ খুব টানত আমাদের বাড়িতে হারমোনিয়াম ছিল না, রেডিও ছিল না, গ্রামোফোন ছিল না। ফলে নানা ফর্ম ও তার প্রসেস অফ এলিমিনেশন অ্যান্ড ইনোভেশন- আমার ক্ষেত্রে হয়নি। আই গট নাথিং, আই মেড ইট সামথিং- এইটুকু। ফলে বিভিন্ন জায়গার প্রভাব পড়েছে আমার গানে। সিনেমার গান শুনতাম, দেখতাম বাউলরা কীভাবে কথা বলতে বলতে গানের মধ্যে ঢুকে যেতেন।“
রোগাটে শরীরের জন্য প্রতুলকে কথা শুনতে হয়েছে তার গান গাওয়ার সক্ষমতা নিয়েও।
প্রতুলের কথায়, “ছোটবেলা থেকেই বুঝেছিলাম যে আমি গাইতে পারি। কিন্তু আমার এই তো চেহারা, অত্যন্ত বাজে চেহারা, এমনিই রোগা, তখন তো আরও রোগা ছিলাম। সবাই বলত, এই চেহারা, কী হবে তোর? দিদিকে দেখতে এসেছে। আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করল এ কী করে? বাড়ির লোক বলল, স্কুলে পড়ে, কিন্তু ভালো গান গায়। ওরা আমাকে গান গাইতে বললে একটা গানও গেয়ে দিলাম। শুনে বলল, ভালো, কিন্তু এই যা চেহারা, এই স্বাস্থ্য দিয়ে কী হবে? এই শুনতে শুনতে আমি একটা স্বাধীন মন পেয়ে গেলাম, আমার তো কিছুই হবে না, আমার কেরিয়ারের চিন্তা করার দরকার নেই। আমি একটা নৌকো চড়েছি, সেই নৌকো কোথায় যাবে জানি নে। ভবঘুরেপনা চেপে বসল। আমার এই খারাপ স্বাস্থ্যটাই কাজে লেগেছে।“
প্রতুল অনুরাগীদের অনেকের ধারণা ছিল, তিনি কখনো অ্যালবাম বের করবেন না। কিন্তু নব্বইয়ের দশকে প্রতুলের অ্যালবাম আলোড়ন তোলে।
প্রতুলের ভাষ্য, তার গানগুলো পরের প্রজন্মের সামনে তুলে দিতেই তিনি অ্যালবাম বের করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
“আমি ভাবলাম আর্কাইভ না করলে একেবারেই কিছু থাকবে না। তবে ঠিক গায়ক লোকটাকে দেখতে না পাওয়া গেলে হয় না। জলজ্যান্ত একটা মানুষ, যে ঘামছে- গাইতে গাইতে গাইতে যার ঘাম ঝরছে-সেটা ভিডিও করেও ধরা যায় না। ফলে ওটার কোনও বিকল্প কখনওই হবে না। কিন্তু অন্তত একটা সূত্র তো থেকে গেল।“
প্রতুলের প্রথম একক অ্যালবাম ‘যেতে হবে’ প্রকাশিত হয় ১৯৯৪ সালে।
অ্যালবামগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘পাথরে পাথরে নাচে আগুন’, ‘যেতে হবে’, ‘ওঠো হে’, ‘কুট্টুস কাট্টুস’, ‘স্বপ্নের ফেরিওয়ালা’, ‘তোমাকে দেখেছিলাম’, ‘স্বপনপুরে’, ‘অনেক নতুন বন্ধু হোক’, ‘হযবরল’, ‘দুই কানুর উপাখ্যান’, ‘আঁধার নামে’।.
আরও পড়ুন...
যেভাবে জন্ম নিয়েছিল প্রতুলের চার গান
তিনি ছিলেন 'অনন্য পারফর্মার': প্রতুল স্মরণে সহশিল্পীরা
'আমি বাংলায় গান গাই' গানের শিল্পী প্রতুলের প্রয়াণ
প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার
ভালো নেই প্রতুল মুখোপাধ্যায়, চিকিৎসা চলছে হাসপাতালে