সবাই গায়ক হতে চায়, বাদ্যযন্ত্রশিল্পী হতে চায় না: বেলাল খান

পাগল তোর জন্য, ভালোবাসি হয়নি বলা, একলা প্রহরসহ বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় গান গেয়ে শ্রোতাদের কাছে পরিচিত হয়েছেন বেলাল খান। গায়ক হিসেবে সুনামের পাশাপাশি সুরকার ও সংগীতশিল্পী হিসেবেও পরিচিতি রয়েছে তার। সুরকার ও সংগীত পরিচালক হিসেবে দুটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও পেয়েছেন এই শিল্পী। বেলাল খানের সুরে একটি গানে সম্প্রতি কণ্ঠ দিয়েছেন ভারতের সংগীত তারকা নচিকেতা চক্রবর্তী। কিছু দিনের মধ্যেই এর মিউজিক ভিডিও প্রকাশ হবে। আপাতত সুর, সংগীত পরিচালনার পাশাপাশি দেশ-বিদেশে স্টেজ শো নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন বেলাল। এরই মধ্যে গ্লিটজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কথা বলেছেন বাংলা গানের সেকাল-একাল নিয়ে। সংগীত নিয়ে নিজের চিন্তা এমনকি বিভিন্ন পরিকল্পনার কথাও জানালেন এই শিল্পী।

মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 March 2023, 05:20 AM
Updated : 18 March 2023, 05:20 AM

কেমন আছেন, কী করছেন ইদানীং?

ভালো আছি। এখন স্টেজ শো’র সিজন চলছে। টানা শো করছি।

ঈদ নিয়ে কোনো পরিকল্পনা?

বেশ কয়েকটি পরিকল্পনা আছে। রমজানের সঙ্গে সম্পর্কিত এমন কিছু ইসলামী ভাবধারার গান করব। ঈদ টার্গেট করে কয়েকটা নতুন গান বানাচ্ছি। সেগুলো মিউজিক ভিডিও আকারে ঈদের আগে আগে প্রকাশ হবে।

রমজান উপলক্ষে কি গাইবেন?

এর আগেও রমজান উপলক্ষে আব্দুল আলীমের ‘আল্লাহু আল্লাহু’ গানটা গেয়েছিলাম। শ্রোতারা খুবই প্রশংসা করেছিলেন। এবার নতুন গান হতে পারে, নজরুলের গান হতে পারে। এখনও ফাইনাল করিনি। কিছু একটা করব।

আপনার সুরে নচিকেতা চক্রবর্তী গাইলেন- এটা কীভাবে হলো?

এটা গীতিকার কবির বকুল ভাইয়ের প্ল্যান ছিল। লকডাউনের আগে বকুল ভাই তার ডায়েরি থেকে আমাকে একটা কবিতা দিলেন। আমি সুর করলাম। সুরটা খুবই পছন্দ করলেন। এরপর আমি আর কবির ভাই খুঁজছিলাম, কাকে দিয়ে গাওয়ানো যায়। কবিতা সুর করলে যা হয়, গানের মতো হয় না, আবার গানের মতোই হয়, তবে শুনতে ব্যতিক্রম লাগে। সেই জায়গা থেকে ভাবছিলাম, কে গাইলে গানটা আলাদা হবে।

এরই মধ্যে নচিকেতা চাঁদপুরে একটা অনুষ্ঠানে এলেন। এরপর ঢাকায়। কবির বকুল ভাই সুরটা শোনালেন। নচিকেতা খুবই পছন্দ করলেন। তিনি বললেন, ‘আমি আজকেই গানটা গাইতে চাই’। বিকাল ৫টায় শোনানোর পর ৯টার মধ্যে স্টুডিওতে এসে গান নিয়ে বসে গেছি। এভাবেই গানটার রেকর্ডিং হয়ে গেল।

গানটা নিয়ে নচিকেতার অনুভূতি কেমন ছিল?

তিনি খুবই পছন্দ করেছেন। এয়ারপোর্টে গিয়েও আমাকে ফোন দিয়ে বলেছেন- ‘বেলাল, গানটা ফাইনাল কম্পোজ হওয়ার পর আমাকে শোনাবে। সুরটা এখনও কানে লেগে আছে’। আমরা প্রথম যৌবনে নচিকেতার কণ্ঠে যেমন গান শুনেছি, তেমন স্বাদের গান। খুব দ্রুতই ভিডিওসহ সাউন্ডটেক থেকে গানটা প্রকাশ করা হবে।

আমাদের দেশের কাজ নিয়ে তার মূল্যায়ন কেমন ছিল?

ছয় বছর পর নচিকেতা বাংলাদেশে এসেছিলেন। আমার সঙ্গে যেমন গান করলেন, নতুন অনেকেই তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। আরও কয়েকটা গান করে গেছেন। সব মিলিয়ে নচিকেতা বলেছেন, ‘কে বলে বাংলাদেশে ভালো গান হয় না? এত অদ্ভুত সুন্দর সুন্দর কথা ও সুর তৈরি হচ্ছে এখানে; না এলে জানতাম না। ভেবেছিলাম আমরাই একটু ভিন্ন চিন্তা করি। এবার দেখলাম, নতুনরা ভিন্ন ভিন্ন কাজ করছে’।

কোনো শিল্পীকে সেই অর্থে দেশব্যাপী জনপ্রিয়তা পেতে দেখা যায়নি। এর কারণ কী হতে পারে? বর্তমানে কি এমন কোনো সঙ্কট আছে, যা তরুণদের শিল্পী হয়ে উঠার বাধা হিসেবে কাজ করে?

এটার ব্যাখ্যা দেওয়া আমার জন্য কঠিন। আমার মিউজিকের জার্নিটা এত লম্বা এখনও হয়নি যে, শিল্পীদের বিষয়ে মূল্যায়ন করতে পারব না। এখনও শিখছি, শেখার চেষ্টার ভেতরে আছি। আমি চেষ্টা করি নিজেকে প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ করার। প্রতিটি গানে খেয়াল রাখি একই সুর, কথা, গায়কি রিপিট করছি কি না। প্রতিনিয়ত নিজেকে ভাঙার ভেতরে থাকি। আমার বিশ্বাস যারা নিজেকে ভাঙার প্রক্রিয়ায় থাকে তাদের গান এখনও জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।

এখনকার গানের স্থায়িত্ব কমার কারণ কী?

স্থায়িত্ব কমে গেছে সেটা বলা যায় না। এখনও এমন গান হচ্ছে যা চার-পাঁচ বছর পরেও মানুষ শুনবে। তবে আগে গান প্রকাশ হত শুধু অডিও মাধ্যমে। গান প্রকাশের নির্দিষ্ট মাধ্যম ছিল। এখন একটা মাধ্যমে গান প্রকাশ হচ্ছে, নাটক, সিনেমা, খবর, হাস্যরস সবই প্রকাশ হচ্ছে। কোনো বাধা নাই। দেশের সব মানুষ ওই প্ল্যাটফর্মে ঝাঁপিয়ে পড়ছে।

যদি এমন হত, মিউজিকের জন্য নির্দিষ্ট প্ল্যাটফর্ম থাকবে। সব মিউজিক সেখানে পাওয়া যাবে। বাকি বিষয়গুলো আলাদা জায়গায় থাকবে। তাহলে বুঝা যেত, মানুষ গান বহুবার শুনে কি না। আর এখনকার গানের মূল্যায়ন এখন করা যাবে না। দশ বছর পর যদি কোনো গান বেঁচে থাকে, বুঝতে হবে গানটার আয়ু ছিল। এখন তো বলা যাবে না কোন গানটার আয়ু কত। আরও সময় দিতে হবে।

জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন, শিল্পীর কাজের ক্ষেত্রে পুরস্কার কোনো পরিবর্তন আনে কি?

এটা অনুভবের ব্যাপার। আমি যদি মনে করি, পুরস্কার আমার ভেতরে কোনো পরিবর্তন আনবে- তাহলে আসবে। আমি এমন কিছু মনে করি না। কারণ, আমার কাজের সঙ্গে পুরস্কারের সেতুবন্ধন খোঁজার চেষ্টা করি না। এমন যদি হত, পুরস্কার পাওয়ার পর আমাকে আর কাজ করতে হবে না; কিংবা পুরস্কার পাওয়ার পর কাজের ক্ষুধা মরে গেছে, ইচ্ছা শেষ হয়ে গেছে তাহলে একটা কথা ছিল। আমি যতদিন বাঁচি কাজ করে যেতে হবে। সুতরাং এখনও কাজের দিকেই মনযোগ আছে।

আপনি মূলত সুরকার, কম্পোজার না গায়ক?

আমি গান গাইতেই এসেছিলাম। এখনও গান গাওয়াটা উপভোগ করি। তবে এর মধ্যে গান বানানোর আনন্দটা পেলাম। এই আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। যখন অন্য কারও গলায় আমার সুর স্থায়িত্ব পেতে দেখি, সে আরেক রকম আনন্দ। আমি সব ধরনের আনন্দই উপভোগ করি।

দেশের কম্পোজারদের ঘাটতি চোখে পড়ে কি না?

প্রায় সব কম্পোজার নির্দিষ্ট কিছু সফটঅয়্যার দিয়েই কাজ করেন। ঘাটতির বড় জায়গায়টা বাদ্যশিল্পীর। দেশে ভালো মানের বাদ্যশিল্পী তৈরি হচ্ছে না। এই ঘাটতি আগামীতে আরও বেশি ভোগাবে। সফটঅয়্যার যে কেউ চালাতে পারে; কিন্তু বাদ্যযন্ত্র বাজানো অন্য বিষয়। এর জন্য কঠোর সাধনা করতে হয়। সফটঅয়্যার দিয়ে গান ও বাজনাকে পলিশ করা যায়, বাজানো যায় না। এখন সবাই কম্পোজার হতে চায়, সবাই গায়ক হতে চায়, কেউ বাদ্যশিল্পী হতে চায় না। ফলে বাদ্যশিল্পীর ঘাটতি পূরণ হচ্ছে না।

এই ঘাটতি পূরণের উপায় কী?

এটা আরও সিনিয়ররা বলতে পারবেন। তবে আমার যেটা মনে হয়, দেশে ইনস্ট্রুমেন্ট বাজিয়ে সংসার চালানোর উপায় এখনও তৈরি হয় নাই। প্রায় এক যুগ সময় দিলে একটা ইনস্ট্রুমন্টে পর্যাপ্ত দখল আসে। দেশে এখন ইনস্ট্রুমেন্ট বাজিয়ে বাহবা পাওয়া যায়, কিন্তু পেট চালানো যায় না। তাকে অন্য কোনো জবও করতে হয়। এটাই বড় কারণ হতে পারে।

বাংলা গানের ভবিষ্যৎ কী?

বাংলা গানের দিন খুবই ভালো ছিল। একটা ঐতিহ্য বহন করেছে দীর্ঘদিন। এই সময়ে এসে বাংলা গানের সেই ঐতিহ্যটা গ্লোবালাইজ হচ্ছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের, ভাষার, স্বাদের গানের সঙ্গে মিলে একটা নতুন রাস্তা বের হচ্ছে।

অনেকেই বলতে পারেন, বাংলা গানের সেই মৌলিক ও শুদ্ধ সুর, ধরন নেই। অনেকেই বলেন গানের স্বাদ বদলে গেছে। স্বাদটা তো বদলাবেই। এখন ইংলিশ, হিন্দি, উর্দু, অ্যারাবিয়ানসহ বিশ্বের সব ভাষার গানের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে। ওইসব গানের সঙ্গে টিকে থাকতে হলে অবশ্যই বাংলা গানে বৈচিত্র্য আনতে হবে। সব মিলিয়ে বাংলা গানের ভবিষ্যৎ ভালো।