“আমার খুব আশা বাংলাদেশ সরকার বাংলা খেয়াল নিয়ে কিছু করবে…এই আনন্দ নিয়ে মরতে দিন বুড়োটাকে।”
Published : 19 Oct 2022, 12:02 AM
‘খেয়াল’ শুনতেও মিলনায়তন পূর্ণ; একের পর এক গাইছেন কবীর সুমন, আর উচ্ছ্বাসে মিলছে তুমুল করতালি। সুমন কিছুটা মজা করেই বললেন, “আমাকে তুলে দেওয়ার জন্য কি হাতিতালি দিচ্ছেন?” সবাই সমস্বরে বললেন, “না”।
কথোপকথন আর বাংলা খেয়াল পরিবেশনায় মুগ্ধতা ছড়িয়ে সুমন বললেন, “এখনও দেখতে পাই, পায়রা ডাকাডাকি করছে, কাক উড়ছে। তাদের তো কেউ থামাতে পারিনি। সেই দৃশ্য দেখার জন্য আমি বেঁচে আছি। আর বেঁচে আছি বাংলা ভাষায় খেয়ালের জন্য।”
রাগ সংগীতের মধ্যে কণ্ঠ আর তবলার সঙ্গতে সৃষ্ট চমৎকার শৈলী খেয়ালকে কোন রূপে আনছেন সুমন, তা শুনতে মঙ্গলবার বিকালের আগে থেকেই ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশন মিলনায়তনের সামনে ভিড় করতে থাকেন ভক্তরা; যদিও ফটক খোলে পৌনে ৪টায়।
দুই বাংলার জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী শায়ান চৌধুরী অর্ণব ও তার স্ত্রী সুনিধি নায়েককেও দেখা গেল দর্শক সারিতে।
অর্ণব বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বললেন, “কবীর সুমন দুই বাংলার খ্যাতিমান শিল্পী। প্রথমবার ঢাকায় তার বাংলা খেয়ালের অনুষ্ঠান হচ্ছে, তাই দেখতে আসা।”
অনুষ্ঠান শেষে ফের কথা হলে অর্ণব বলেন, “দারুণ মুগ্ধ হয়েছি। বাংলা খেয়াল নিয়ে তো কবীর সুমন অনেক দিন ধরেই কাজ করে চলেছেন। উনি আমাদের কাছে সঙ্গীতের ভাণ্ডার। ছোটবেলা থেকেই তো উনার গান শুনছি। বাংলা খেয়াল নিয়ে আমাদের কাজের পথকে এগিয়ে দিয়ে যাচ্ছেন সুমন।”
বিকাল সাড়ে ৪টায় মঞ্চে আসেন কবীর সুমন। শুরু করেন সুমনসুলভ গল্প-আড্ডা, আর বাংলা খেয়াল। সুমন গেয়ে উঠেন, “এই নাগরিক জীবন আর নাগরিক মন/ দিন ফুরিয়ে গেছে সঙ্গীতায়োজন।”
রাগ ইমন, রাগ দুর্গা, পুরবী ঠাটে একে একে পরিবেশন করেন ‘এ মোহ-আবরণ খুলে দাও’, ‘দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার গানের ও পারে’, ‘সেই যে ছোঁয়া সন্ধ্যের বাঁকে’।
আজাদ রহমান স্মরণে কবীর সুমনের নতুন রাগ
বাংলা খেয়াল শোনানোর ফাঁকে কথায়-আলাপে স্মরণ করেন সত্যকিঙ্কর বন্দোপাধ্যায় এবং বাংলাদেশের প্রয়াত সঙ্গীতগুরু আজাদ রহমানকে।
সুমন বলেন, “সত্যকিঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের পর আজাদ রহমান একের পর এক বাংলা খেয়ালের বন্দিশ রচনা করেছেন। তার সাথে আমার আলাপ হলো না। তার মৃত্যুর পর আজাদ রহমানকে নিয়ে রাগ তৈরি করেছি।”
পরে গেয়ে শোনান রাগ ‘আজাদ’, যার কথা ‘অস্তাচলে শেষটাই/ যার শুরু পূর্ব রাগে/ সাগর পেরিয়ে তার পাওয়া/ সারা সাত জাগে’।
সুমন যখন মঞ্চে খেয়াল পরিবেশন করছিলেন, তখন তার পাশেই দুটি ব্যানার দেখা যায়। যার একটি ছিল সত্যকিঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের এবং অন্যটি আজাদ রহমানের।
ধ্রুপদী সঙ্গীত মানুষের কাছে যায়নি মন্তব্য করে সুমন বলেন, “এখানে যারা আছেন, তারা কতজন মঞ্চ বসে খেয়াল শুনেছেন? একটু হাত তুলুন।”
কিছু সংখ্যক দর্শক হাত তোলার পর সুমন বললেন, “আমি নিজেও অনেক দিন খেয়াল শুনতে যাইনি। কারণ খেয়াল সম্পর্কে একটা ভয় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আনন্দ নিয়ে গাইতে হবে। শুনতে হবে।”
সুমন গেয়ে শোনান- ‘বনের চামেলী ফিরে আয়’, ‘নাচে সখিগণ কুঞ্জে’, ‘কিছু নেই তবু আছে একা নীল তারা’ এবং সবশেষে ‘ডেকেছি কত সাড়া দিলে না’ গেয়ে শেষ করেন বাংলা খেয়াল অনুষ্ঠান।
পরিবেশনার ফাঁকে নিজের খেয়াল শেখার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে সুমন বলেন, “ছোটবেলায় আমি হিন্দুস্তানি খেয়াল শিখেছি, যা বুঝতে পারিনি। মাস্টার মশাইয়ের কাছে আমি জানতে চেয়েছি; তিনি যেটা বুঝতে পেরেছেন, আমাকে বলেছেন। যেটা উনিও বুঝতেন না, সেটি বলতেন যে- আমি বুঝতে পারছি না।
“তখন মাস্টার মশাইকে বলতাম, আমার মাতৃভাষা বাংলায় কেন খেয়াল নাই? তারও অনেক দিন পর আমি বাংলায় খেয়াল রচনা করতে পেরেছি, কিন্তু আমার মাস্টার মশাইকে আর শোনানো হয়নি। উনি চলে গিয়েছেন।”
খেয়াল শোনাতে পারবেন বলেই এবার ঢাকার এই আয়োজনে আসতে রাজি হন জানিয়ে সুমন বলেন, “আরিফ যখন আমার সঙ্গে প্রথম যোগাযোগ করে, তখনই বলেছিলাম। বাংলা খেয়াল কিন্তু রাখতে হবে; নইলে যাব না।”
তিন দিন গান পরিবেশনের জন্য এক সপ্তাহের সফরে ঢাকায় অবস্থান করছেন কবীর সুমন। গেল শনিবার আধুনিক বাংলা গান পরিবেশন করেন, আর মঙ্গলবার পরিবেশন করলেন বাংলা খেয়াল। আগামী শুক্রবার ফের আধুনিক বাংলা গান শোনাবেন সুমন।
খেয়াল শুনতে কিংবা গাইতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই উল্লেখ করে কবীর সুমন বলেন, “ড্রাম বাজান, ঢোল বাজান। দেখুন, শুধু সঙ্গীতটা যেন থাকে।”
নবীন শিল্পীদের উদ্দেশে সুমন বলেন, “গান নিয়ে 'এক্সপেরিমেন্ট' করুন। এক্সপেরিমেন্ট করতে ভয় পাবেন না। গান নিয়ে ভয় পাবেন না। মনের আনন্দে গান করুন। মনের আনন্দে ভুল করুন। ভুল করে থেমে যাবেন না। আবার ভুল করুন।”
বাংলাদেশ সরকারের কাছে অনুরোধ করে সুমন বলেন, “বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। তাই বাংলাদেশ সরকারের কাছে অনুরোধ 'বাংলা খেয়াল' এর পাশে থাকবেন। আমাকে যদি প্রয়োজন হয়, ডাকলেই আমি সবসময় থাকব।
“আমার খুব আশা, বাংলাদেশ সরকার বাংলা খেয়াল নিয়ে কিছু করবে। যদি বাংলাদেশ সরকার কিছু করে, তবে আমার খুব আনন্দ হবে। এই আনন্দ নিয়ে মরতে দিন বুড়োটাকে।”
পশ্চিমবঙ্গে বাংলা খেয়াল’র দীর্ঘমেয়াদী পাঠক্রম চালু হয়েছে জানিয়ে সুমন বলেন, “আমার খুব আনন্দ হচ্ছে যে পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘমেয়াদে বাংলা খেয়াল পাঠক্রম চলছে। সরকারিভাবে বাংলা খেয়ালকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।”
পশ্চিমবঙ্গের চেয়েও বাংলাদেশের মানুষ তার গান বেশি শুনেছে জানিয়ে তিনি বলেন, “তার কারণটা আমি জানি না।"
একপর্যায়ে সুমন বললেন, “আমি অপার আনন্দ পাচ্ছি; আপনারা কি পাচ্ছেন, জানি না।” তারপর প্রাণ খুলে গেয়ে ওঠেন ‘হারে রে রে রে রে, আমায় ছেড়ে দে রে’।
এভাবে পরিবেশনা আর কথামালায় দুই ঘণ্টারও বেশি সময় দর্শক-স্রোতাদের ধ্রুপদী সংগীতের আবেশে জড়িয়ে রাখেন কবীর সুমন৷