শেক্সপিয়ারের সুর ধরে ‘পিয়ার আলির ভাঙ্গা মুখ’

ইতালির শেক্সপিয়ার ফ্রিঞ্জ ফ্রেস্টিভালে এবার প্রদর্শিত হবে বিলেতের বার্মিংহামের বাঙালি কম্যুনিটির নাটক ‘পিয়ার আলির ভাঙ্গা মুখ’। নাটকটির একটি বিশেষ প্রদর্শনী দেখে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম পাঠকদের জন্য লিখেছেন লেখক ও থিয়েটারকর্মী সেলিনা শেলী।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 August 2022, 07:46 AM
Updated : 27 August 2022, 07:46 AM

ইতালির শেক্সপিয়ার ফ্রিঞ্জ ফ্রেস্টিভালে এবার প্রদর্শিত হবে বিলেতের বার্মিংহামের বাঙালি কম্যুনিটির নাটক ‘পিয়ার আলির ভাঙ্গা মুখ’। নাটকটির একটি বিশেষ প্রদর্শনী দেখে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম পাঠকদের জন্য লিখেছেন লেখক ও থিয়েটারকর্মী সেলিনা শেলী।

বিলেতে শেক্সপিয়ার নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার শেষ নেই। শেক্সপিয়ারকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা, সমগ্র ইউরোপ ও বিশ্ব দরবারে ছড়িয়ে দেওয়ার আয়োজনে ও কলা-কৌশলেও যথেষ্ট এ দেশে এবং তা সাধারণত সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায়ই করা হয়। চারশ’ বছর আগে রচিত নাটক ও তার সামাজিক প্রেক্ষিতকে বর্তমানের সাথে সম্পর্কিত করা ও দেশের এবং বিশ্বের নব নব প্রজন্মকে শেক্সপিয়ার চেনানো-তাদেরকে শেক্সপিয়ারের নাটককে’ ভেঙে-চুরে যা ইচ্ছে তাই করবার স্বাধীনতা দেওয়া- এ এক বিস্ময় বটে।

‘Reimagining Shakespeare’ এদেশে গবেষণা, লেখালেখি এবং পারফর্মিং আর্টসের যে বিশাল প্রাঙ্গণ উন্মুক্ত করে রেখেছে, সেখানে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে রয়েছে সকলের অবাধ সন্তরণের অধিকার-শিল্প সৃষ্টির স্বাধীনতা। নাটক থেকে উপন্যাস, কঠিন জটিল নাটকগুলোকে সহজ উপন্যাসে রূপান্তর করা, একক বা দুটো চরিত্রকে ধরে স্কুলের বাচ্চাদের জন্য নাটিকা লেখা, চারশ’ বছর আগের নাটকের মূল সুরটা বর্তমান সময়ের কোনো ঘটনা প্রবাহে গেঁথে ফেলা, কমেডিকে ট্রাজেডি আর ট্রাজেডিকে কমেডি করে উপস্থাপন করা, সিনেমা- কি না হয় এখানে। চারশ’ বছরের পুরাতন শেক্সপিয়ারকে আধুনিক করে রাখার যাবতীয় উপাচার, আয়োজন, উৎসাহ এই একবিংশ শতাব্দিতেও স্রোতস্বিনী হয়ে বয়ে চলেছে।

শেক্সপিয়ারের reimagination বা reinterpretation, retelling যে নামেই বলি না কেন- সেই বহরে এবার যুক্ত হল বাংলা নাটক ‘পিয়ার আলির ভাঙ্গা মুখ’। শুধু বহরে যুক্ত হওয়া নয়, নাটকটি আমন্ত্রিত হয়েছে ইতালির ভেরোনাতে শেক্সপিয়ার ফ্রিঞ্জ ফেস্টিভাল ২০২২ এর মহাযজ্ঞে। এই আন্তর্জাতিক আয়োজনে এবার নির্বাচিত নাটকের সংখ্যা আট। আর সেগুলো আসছে গ্রিস, নরওয়ে, জর্জিয়া, ইউক্রেন, যুক্তরাজ্য ও ইতালি থেকে।

যুক্তরাজ্য থেকে নির্বাচিত নাটক ‘পিয়ার আলির ভাঙ্গা মুখ’। এ নাটকটি লিখেছেন ও নির্দেশনা দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্ট্যাডিজ বিভাগের শিক্ষক শাহমান মৈশান। মৈশান The University of Birmingham এ প্রতিষ্ঠিত বিলেতের গর্ব The Shakespeare Institute (SI) এ বর্তমানে পিএইচডি করছেন। শেক্সপিয়ার ইন্সিটিউটের সঙ্গে যৌথভাবে নাটকটি প্রযোজনা করেছে প্রবাসী বাঙালিদের স্থানীয় দুটি সংগঠন-বাংলা কানেকশন ও সন্ধানী আর্টস। নাটকটি ইতালির ভেরোনার কেন্দ্রে অবস্থিত Teatro Comploy এ আগামী ২৮ অগাস্ট প্রদর্শিত হবে। উৎসবের প্রস্তুতি হিসেবে গত ১৭ আগস্ট বার্মিংহামের মিডল্যান্ড আর্টস সেন্টারে নাটকটির একটি বিশেষ প্রদর্শনী আয়োজন করা হয়। আমার সৌভাগ্য হয় সেখানেই নাটকটি দেখবার।

নাটকটির স্ক্রিপ্ট তৈরি হয়েছে শেক্সপিয়ারের অপেক্ষাকৃত কম পরিচিতি পেরিক্লেস (Pericles) নাটকের মূল সুর নিয়ে। মৃত্যু পরোয়ানা ঠেকাতে পেরিক্লেস, দ্য প্রিন্স অব টয়া দেশান্তরী হতে বাধ্য হন। বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে যেতে এক পর্যায়ে সুযোগ পান স্ত্রী ও কন্যাকে নিয়ে যাওয়ার। কিন্তু জলপথে প্রবল প্রাকৃতিক দুর্যোগে পুনরায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় সবাই। নানা ঘাত-প্রতিঘাত, নানাদেশ, নানান দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা এবং শেকড়হীন অবস্থার যে অস্তিত্বের সঙ্কট, সেটাই প্রফেসর মাইকেল ডবসনের ভাষায়- an empathetic journey of pericles. পেরিক্লেস অবশেষে তার কন্যা ও স্ত্রীর সঙ্গে মিলতে পারেন, যদিও তাদের জীবিত দেখার আশা তিনি পরিত্যাগ করেছিলেন।

পেরিক্লেসকে ধরেই পিয়ার আলিকে নির্মাণ করেছেন মৈশান মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে। নিতান্তই বালক পিয়ার আলী পরিবার বিচ্ছিন্ন হয়ে ১৯৭১ সালে শরণার্থীর কাফেলার সঙ্গে উপস্থিত হয় কলকাতায়। সেখান থেকে বিলেতে এলিজাবেথের পুত্র হয়ে পালিত হতে থাকে। হঠাৎ করেই এলিজাবেথ মারা গেলে পিয়ার আলির আঠারো বছর বয়সে তাকে হস্তান্তর করা হয় এলিজাবেথের ডায়েরি। শুরু হয় পিয়ার আলির একক ভ্রমণ- শেকড় খোঁজা তথা অস্তিত্বের লড়াই। পিয়ার আলি মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বাবার পরিচয় পেলেও কোন বধ্যভূমিতে তার কবর, খুঁজে পায় না। অনেক পরে সে তার মৃত মায়ের কবর জানতে পারে যুদ্ধে আর্মি ক্যাম্পে একই সঙ্গে নির্যাতিত হওয়া আরেক নারীর কাছে- জীবন যাকে ঠাঁই দিয়েছে পশ্চিমের আরেক দূর দেশে। পিয়ার আলি জানতে পারে ধর্ষণের ফলে তার মায়ের গর্ভে জন্ম নিয়েছিলো এক কন্যা- সে জীবিত আছে এই পৃথিবীর অন্য আরেক দূর দেশে। না দেখা মায়ের গর্ভজাত সে কন্যাকে বোন ডেকে নিজের অস্তিত্বের নিঃসঙ্গ ভ্রমণের সমাপ্তি টানে।

নাটকটির ডিজাইনে ডিজিটাল গ্রাফিক্সের উল্লেখযোগ্য ব্যবহার রয়েছে। যা করেছেন বাংলা কানেকশনের কর্ণধার ও পুরস্কারপ্রাপ্ত স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা মকবুল চৌধুরী। বিশেষ করে পিয়ার আলি যখন বধ্যভূমিতে একের পর এক এপিটাফ খুঁজে চলে তার পিতার সন্ধানে- মকবুল চৌধুরীর গ্রাফিক্স ভিজুয়াল সেখানে দর্শককে সহায়তা করে এই দৃশ্যের নির্যাসটুকু পুরোপুরি উপলব্ধি করতে। গ্রাফিক্স অভিনেতার জন্য সহায়ক হয়েছে বলে আমি বিশ্বাস করেছি একজন দর্শক হিসেবে। নাটকটিতে মঞ্চসজ্জা বলতে কিছু নেই। তবে আবহ তৈরি আর আলোকে যথাযথ ব্যবহারের জন্য দুই পাশ বড় বেশি উন্মুক্ত মনে হয়েছে।

এই একক নাটকটিতে অভিনয় করেছেন এ শহরের বাংলা কম্যুনিটিতে সু-অভিনেতা হিসেবে খ্যাত তারেক চৌধুরী। পঁয়তাল্লিশ মিনিটের নাটকটি তিনি ধরে রেখেছেন শক্ত করেই। তবে মঞ্চে তিনি খানিকটা ইচ্ছে স্বাধীন বলেই আমার মনে হয়েছে। অভিনেতার জন্য মঞ্চে আলো, শব্দ, মিউজিক, কোরিওগ্রাফ, প্রপসের ব্যবহার, এ নাটকের ক্ষেত্রে গ্রাফিক্স এতগুলো উপাদানের সঙ্গে সমন্বয়ে বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরির যে কেমেস্ট্রি তা আত্মস্থ করতে অভিনেতার পরিশ্রমের ঘাটতি ¯স্পষ্ট বোঝা গেছে। একাডেমিক আবহাওয়ায় নাটক তৈরিতে অভ্যস্ত নির্দেশক হিসেবে মৈশানের কাছেও এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ বলেই আমার মনে হয়েছে। নাটকটির অন্যান্য কারিগরি সহযোগিতা করেছেন খালেদ আহমেদ ও জুনায়েদ আন্দ্রেই।

মৈশানের পিএইচডি প্রজেক্টের অংশ হিসেবে এই নাটকটি নির্মিত। ১৭ অগাস্ট ছোট্ট মিলনায়তনটি পুরোপুরি পূর্ণ ছিল। দর্শক সারি থেকে শেক্সপিয়ার ইন্সটিউটের অধ্যয়নরত একজন নন-বাংলাদেশি দাঁড়িয়ে যখন বললেন- তার দেখা শেক্সপিয়ার reimagination এর একটা অন্যতম উল্লেখযোগ্য কাজ এটি, তখন সত্যি চিত্ত আনন্দিত হয়। অনেক অনেক শুভকামনা মৈশান, মকবুল চৌধুরী, তারেক চৌধুরীসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে। বাংলা নাটক ও বাংলার মুক্তিযুদ্ধ শেক্সপিয়ারকে বাহন করে পৌঁছে যাক বিশ্বের দরবারে। ২৮ অগাস্ট ভেরোনার মঞ্চায়ন সফল হোক।