২০২২: মহামারীর আঁধার কেটে রোশনাই ফিরল মঞ্চে

এ বছর এসেছে অর্ধ শতাধিক নতুন নাটক, মুখর ছিল নাট্যাঙ্গন। তবে ভাঙন দেখা দিয়েছে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনে।

পাভেল রহমানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Dec 2022, 08:13 AM
Updated : 30 Dec 2022, 08:13 AM

কোভিড মহামারী সব কিছুই থমকে দিয়েছিল, নাটকের মঞ্চ হয়ে পড়েছিল অন্ধকার। সেই খাঁড়া কাটিয়ে নাট্যকর্মীরা এবছরই ফিরেছেন মঞ্চে, এনেছেন অর্ধ শতাধিক নতুন নাটক। সেইসঙ্গে নাট্যোৎসব, আলোচনা অনুষ্ঠানসহ নানা আয়োজনে বছরজুড়ে মুখর ছিল দেশের নাট্যাঙ্গন।

এছাড়া পেশাদার থিয়েটার চর্চার প্রয়াস নিয়ে বেশ কিছু রেপার্টরি নাট্য প্রযোজনাও মঞ্চে এসেছে। একাধিক নাট্যদলের শিল্পীদের সমন্বয়েও এসেছে নাট্য প্রযোজনা। পাশাপাশি সাধারণ রঙ্গালয়ের ১৫০ বছর পূর্তি উদযাপনও করেছে নাট্যকর্মীরা।

তবে দেশের নাট্যদলগুলোর প্রতিনিধিত্বশীল সংগঠন গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের কমিটিতে দেখা দিয়েছে ভাঙন। শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক ও গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সভাপতি লিয়াকত আলী লাকীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ এবং গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক কামাল বায়েজীদ ও অর্থ সম্পাদক রফিকুল্লাহ সেলিমকে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বহিষ্কারের ঘটনা ছিল নাট্যাঙ্গনের আলোচিত বিষয়।ফেডারেশনে ভাঙনের সূত্র ধরে ‘সাধারণ নাট্যকর্মী’ নামে নতুন প্লাটফর্মও গড়ে উঠতে দেখা যায়।

বিদায়ী ২০২২ সালের সার্বিক মূল্যায়নে নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “করোনার কারণে কিছুটা থমকে ছিল নাট্যাঙ্গন। সেটা কাটিয়ে উঠে এ বছর বেশ কিছু নতুন নাটক মঞ্চে এসেছে। এটা আশা জাগানিয়া ব্যাপার। তবে সংখ্যা বাড়লে তো হবে না, নাটকের মানও বাড়তে হবে। মৌলিক নাটকের সংকট বিগত কয়েক বছর ধরেই দেখা যাচ্ছে। নতুন মৌলিক নাটক লেখা হচ্ছে কম। ফলে অনুবাদ, গল্প, উপন্যাস থেকে রূপান্তরই বেশি হচ্ছে। মৌলিক নাটক লেখার চর্চা বাড়াতে হবে।”

বিভিন্ন নাট্যদলের শিল্পীদের সমন্বয়ে এখন বেশি কিছু রেপার্টরি নাট্যদল নিয়মিত নাটক আনছে মঞ্চে। তাছাড়া গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের নেতৃত্বেও ভাঙন। সব মিলিয়ে গ্রুপ থিয়েটার চর্চা কি সংকটে?

রামেন্দু মজুমদার বলেন, “গ্রুপ থিয়েটার কাঠামোতে ভাঙচুর এখন সময়ের দাবি। আমি মনে করি এটা স্বাভাবিক পরিণতি। গ্রুপ থিয়েটারে যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল, তাতে ভালো নাটকের চর্চা বাধাগ্রস্ত হয়। নাটকের দলের তো মূল কাজ নাটক করা। কিন্তু সেখানে যদি পদ-পদবি, কমিটি মুখ্য হয়ে উঠে, তখন ভালো নাটক করাটা কঠিন হয়ে যায়। এজন্য বিকল্প হিসেবে কেউ কেউ রেপার্টরি নাট্য প্রযোজনার দিকে ঝুঁকছে। আমি এটাকে ইতিবাচক মনে করি।”

চট্টগ্রামের নাট্যদল তির্যকের দলপ্রধান একুশে পদকজয়ী আহমেদ ইকবাল হায়দার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “করোনা মহামারী কাটিয়ে নতুন চিন্তা, নব-উদ্যমে থিয়েটার চর্চা শুরু হয়েছে। এটা আশা জাগানিয়া।

“আমার ধারণা ছিল, করোনার মধ্য দিয়ে নাট্যচর্চা এক নতুন গতি পাবে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যেমন এক নব নাট্য আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। করোনার দুঃসময় কাটিয়ে নাটকের আরেক নবযাত্রা শুরু হবে বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু সেটা খুব বেশি হতে দেখিনি। অনেক নতুন নাটক আসছে। কিন্তু সামগ্রিক যে নবচিন্তার যাত্রা হওয়ার কথা, সেটা হয়নি।”

বছরজুড়ে নতুন নাটক

নিয়মিত প্রযোজনা হিসেবে বেশ কিছু নাটক মঞ্চে এনেছে নাট্যদলগুলো। এছাড়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগ তাদের পরীক্ষা প্রযোজনা এবং নাট্যোৎসবকে ঘিরে অন্তত ২৫টির মতো নতুন নাটক মঞ্চে এনেছে। সব মিলিয়ে অর্ধ-শতাধিক নতুন নাটক মঞ্চে এসেছে বলে জানান থিয়েটার বিষয়ক পত্রিকা ক্ষ্যাপার নির্বাহী সম্পাদক অপু মেহেদী।

নাট্যাঙ্গনের বিভিন্ন তথ্য, খবর, ছবি ও ভিডিওচিত্র নিয়মিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করে থাকে ‘ক্ষ্যাপা’। এছাড়া ‘থিয়েটার সংযোগ’ নামে একটি ফেইসবুক ভিত্তিক গ্রুপও পরিচালনা করছে থিয়েটারের এই পত্রিকাটি।

‘ক্ষ্যাপা’র নির্বাহী সম্পাদক অপু মেহেদী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিভিন্ন জেলা শহরেও অনেক নাটকের দল আছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ নানান জায়গায় নিয়মিত নাটক মঞ্চস্থ হয়। সেই খবর অনেক সময় ঢাকায় বসে আমরা পাই না। তাদের কেউ কেউ থিয়েটার সংযোগ গ্রুপে কিছু তথ্য শেয়ার করছেন। সেসব তথ্য বিশ্লেষণ করে বলা যায়, ২০২২ সালে ৫০টিরও বেশি নতুন নাটক মঞ্চে এসেছে।”

এ বছর প্রাচ্যনাট মঞ্চে এনেছে ‘আগুনযাত্রা’, এথিক এনেছে ‘রাজদ্রোহী’, বাঙলা থিয়েটার এনেছে ‘নীল দর্পণ’, অনুস্বর বছরের বিভিন্ন সময়ে তিনটি নাটক মঞ্চে এনেছে, যার মধ্যে আছে- ‘জীবন’, ‘হুতাশ মরণ’ ও ‘জাদুকর’। বটতলা এনেছে ‘রাইজ অ্যান্ড শাইন’। এছাড়া বটতলা পরিচালিত থিয়েটার স্কুল অ্যাক্টরস স্টুডিও এনেছে ‘সম্পূর্ণ কাল্পনিক’ ও শিশুদের নিয়ে প্রযোজনা ‘আমরা সবাই রাজা’।

অন্যদিকে নতুন নাট্যদল থিয়েটারিয়ান প্রথম প্রযোজনা হিসেবে মঞ্চে এনেছে ‘ডেথ অব এ সেলসম্যান’, দেশ নাটক এনেছে ‘পারাপার’, নাট্যধারা এনেছে ‘স্বর্ণময়ী’, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যদল অনুশীলন এনেছে ‘নায়ক ও খলনায়ক’, নাট্যকেন্দ্র এনেছে ‘পুণ্যাহ’, কমলা কালেক্টিভ ও ব্রিটিশ কাউন্সিল যৌথভাবে এনেছে ‘নীল ছায়া’, থিয়েটার এনেছে ‘পোহালে শর্বরী’, নাগরিক নাট্যাঙ্গন এনেছে  ইনামুল হক স্মরণে ‘৭১ ও একজন নাট্যকার’, জামালপুরের থিয়েটার অঙ্গন এনেছে ‘তেজ’, বরিশালের শব্দাবলী এনেছে ‘উপসংহার’, হবিগঞ্জের জীবন সংকেত এনেছে ‘অবিনাশী কাল’, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাহিত্য একাডেমি এনেছে মুক্তিযুদ্ধকালীন গণহত্যার সত্য ঘটনা নিয়ে ‘রক্তাক্ত ৭১, ফেনী থিয়েটার এনেছে ‘পেজগী’। এছাড়া ৬৪ জেলায় শিল্পকলা একাডেমির ব্যবস্থাপনায় মুক্তিযুদ্ধের গণহত্যা নিয়ে পরিবেশ থিয়েটার মঞ্চস্থ করেছে শিল্পকলা একাডেমি।

বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ এনেছে চাকমা নাট্যপালা ‘রাধামণ ধনপুদি, সেলিম আল দীনের  ‘চাকা’ ও ‘বনপাংশুল’। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগ এনেছে ‘তাসের দেশ’, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরমন্সে স্টাডিজ বিভাগ এনেছে ‘বিসর্জন’, ‘করুণা ও ভীতির গল্প’, ‘মহুয়া’। এছাড়া ১৫টি নতুন নাটক নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় বার্ষিক নাট্যোৎসব অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে মঞ্চস্থ হয় ‘কবর’, ‘ক্যাম্প’, ‘কাকচরিত্র’, ‘হিস্যা’, ‘দ্য গেম’, ‘ফুডকনফারেন্স’, ডেথ অব দ্য মুন’, ‘দ্য গিফ্ট অব দ্য ম্যাজাই’, ‘ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর’, ‘ফ্যাতাড়, ‘চূর্ণলিপি’, ‘কণ্ঠনালীতে সূর্য, ‘রূপান্তর’, ‘একটি আদর্শ সেবা সংস্থা’ ও ‘মহুয়া’।

ত্রিশালের কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার এন্ড পারফরমেন্স বিভাগ মঞ্চে এনেছে ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলা’, ‘দি লেসন’, ‘উনপুরুষ’, ‘হ্যামলেট মেশিন’, ‘যৈবতী কন্যার মন’, দ্য উড বি জেন্টেলম্যান’। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগ এনেছে ‘মাইক মাস্টার’। নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ড্রামা ক্লাব এনেছে ‘ওথেলো’, গ্রীন বিশ্ববিদ্যালয় এনেছে ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি’। বুয়েট ড্রামা সোসাইটি এনেছে ‘দ্য মাউস ট্র্যাপ’।

গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনে ভাঙন

গত ২২ জানুয়ারি গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সম্পাদক (প্রচার) মাসুদ আলম বাবুর স্বাক্ষরে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক কামাল বায়েজীদ ও অর্থ সম্পাদক রফিবুল্লাহ সেলিমকে অব্যাহতি দেওয়ার বিষয়টি জানানো হয়।

সেই ঘটনার পর গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি রামেন্দু মজুমদার থিয়েটার পত্রিকা ক্ষ্যাপার ফেইসবুক পেইজে একটি খোলা চিঠি প্রকাশ করে সংগঠনটির কমিটি ভেঙে দেওয়ার আহ্বান জানান। বিষয়টি নাট্যাঙ্গনে তুমুল আলোচনা তৈরি করে।

এর কিছুদিন পরই কামাল বায়েজীদ সংবাদ সম্মেলন করে অর্থ আত্মসাতের ঘটনা মিথ্যা বলে দাবি করেন। সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে কাউকে অব্যাহতি দেওয়া যায় না দাবি করে তিনি বলেন, এটা ‘অগণতান্ত্রিক’।

তবে সংগঠনটির প্রচার সম্পাদক মাসুদ আলম বাবু বলেন, “সংগঠনের গঠনতন্ত্র মেনে নির্বাহী কমিটির সভার সিদ্ধান্তেই দুজনকে অব্যহতি দেওয়া হয়।”

কামাল বায়েজীদ সংবাদ সম্মেলনে লিয়াকত আলী লাকীর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে ধরে বলেন, “লিয়াকত আলী লাকী একই সাথে শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক এবং গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সভাপতি। লাকীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়ম নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে দুদকে একটি অনুসন্ধান চলছে। পত্র-পত্রিকায় এ নিয়ে লেখালেখি হচ্ছে। আমি তাকে একদিন এ বিষয়ে মৌখিকভাবে বলেছিলাম, তিনি যেন কিছুদিন সংগঠনের কাজ থেকে বিরতি নেন। এই কারণে তিনি আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে অব্যাহতি দিয়েছেন।”

গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের ভাঙনের জটিলতা নিরসনে বিভিন্ন নাট্যদলের নাট্যকর্মীরা মিলে ‘সাধারণ নাট্যকর্মী’ নামে একটি প্লাটফর্ম গড়ে তোলে। এই প্লাটফর্মের ব্যানারে ২৩ জুলাই নাটক সরণির মহিলা সমিতির নীলিমা ইব্রাহিম মিলনায়তনে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সভাপতি লিয়াকত আলী লাকীকে এই সভায় থাকতে অনুরোধ করা হলেও তিনি সেখানে উপস্থিত হননি। সভায় বক্তব্য দেন রামেন্দু মজুমদার, মামুনুর রশীদ, মফিদুল হক, আসাদুজ্জামান নূর, নাসির উদ্দীন ইউসুফ, আহমেদ ইকবাল হায়দার, মোহাম্মদ বারী, আজাদ আবুল কালাম, অলোক বসু, কামাল বায়েজীদ, রফিকুল্লাহ সেলিম, কামরুন নূর চৌধুরী, তপন হাফিজ প্রমুখ। এর আগে সভার ধারণাপত্র পাঠ করেন অলোক বসু। সঞ্চালনা করেন মারুফ কবির। ‘সাধারণ নাট্যকর্মী’ ব্যানারে পরবর্তীতে কয়েকটি জেলা শহরেও মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়।

মাইলফলক প্রদর্শনী

বছরের ২৩ মার্চ ৩০০তম মঞ্চায়নের মাইলফলক ছুঁয়েছে মোমেনা চৌধুরীর একক অভিনীত নাটক ‘লাল জমিন’। মান্নান হীরার রচনা ও সুদীপ চক্রবর্তীর নির্দেশনায় শূন্যন রেপার্টরি থিয়েটারের প্রথম প্রযোজনা ‘লালজমিন’। এটি বাংলাদেশের সর্বাধিক মঞ্চায়িত একক অভিনীত নাটক।

১৮ নভেম্বর আরণ্যক নাট্যদলের ‘রাঢ়াঙ’ নাটকটি ২০০তম মঞ্চায়নের মাইলফলক ছুঁয়েছে। ২০০০ সালে নওগাঁয় আলফ্রেড সরেনের নেতৃত্বে ভূমির জন্য লড়াই, তার আত্মত্যাগ, সাঁওতালদের দীর্ঘ সংগ্রামের বিশাল উত্তরাধিকারকে মঞ্চে তুলে ধরার প্রয়াসই ‘রাঢ়াঙ’। রচনা ও নির্দেশনা দিয়েছেন মামুনুর রশীদ। ২০০৪ সালে রাঢ়াঙ মঞ্চে আনে আরণ্যক। 

Also Read: হাউজফুল রাঢ়াঙ: টিকেট না পেয়ে ফিরে গেল দর্শক

গত ১০ নভেম্বর, ৫০তম মঞ্চায়নের মাইলফলক ছুঁয়েছে পদাদিক নাট্য সংসদের নাটক ‘কালরাত্রি’। ২০১৫ সালের ৬ নভেম্বর নাটকটির প্রথম মঞ্চায়ন হয়েছিল। লামিসা শিরীন হোসাইনের ‘লোন সার্ভাইবার’ গল্প অবলম্বনে নাট্যরূপ দিয়েছেন তানভীর আহমেদ সিডনী। মঞ্চে নাটকটি নির্দেশনা দিয়েছেন ওয়াহিদুল ইসলাম।

অন্যদিকে ১৯ অগাস্ট ৫০তম মঞ্চায়নের মাইলফলক ছুঁয়েছে লোক নাট্যদল প্রযোজিত ‘বৈকুণ্ঠের খাতা’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘বৈকুণ্ঠের খাতা’ নির্দেশনা দিয়েছেন লোক নাট্যদলের সাধারণ সম্পাদক কামরুন নূর চৌধুরী। ২০১১ সালের ২ জুন বৈকুণ্ঠের খাতা’র প্রথম মঞ্চায়ন হয়েছিল।

এছাড়া ‘মহাজনের নাও’ নাটকটি এ বছর দেড় যুগ উদযাপন করেছে। ২০১০ সালের ১৮ জুন মরমি সাধক শাহ আবদুল করিমের জীবনীভিত্তিক মঞ্চনাটক ‘মহাজনের নাও’ প্রথম মঞ্চায়ন হয়েছিল। ২২ জুলাই নাটকটির ১৩০তম প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে এক যুগ পূর্তি উদযাপন করছে সুবচন নাট্য সংসদ। শাকুর মজিদের লেখা থেকে নাটকটি নির্দেশনা দিয়েছেন সুদীপ চক্রবর্তী।

সাধারণ রঙ্গালয়ের ১৫০ বছর

ঔপনিবেশিক যুগে সমাজের বিশেষ শ্রেণির মনোরঞ্জন করত মন্দির বা জমিদার বাড়ির উঠানের চিত্তবিনোদন অনুষ্ঠান, সার্ধশত বছর আগে সেই ধারা ভেঙে শুরু হয়েছিল নতুন অধ্যায়, জন্ম হয় সাধারণ রঙ্গালয়ের। প্রথম টিকিট কেটে নাটকের মঞ্চায়ন শুরু হয় সর্বসাধারণের জন্য। ব্রিটিশ আমলে নীল চাষ আর কৃষকদের উপর জুলুম-নিপীড়নের পটভূমিতে দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীল দর্পণ’ নাটকের মঞ্চায়ন দিয়েই ১৮৭২ সালের ৭ ডিসেম্বর সেই ধারা শুরু হয়েছিল।

সামাজের সাধারণ দর্শকদের সুযোগ হয় রঙ্গালয়ে প্রবেশের, এরপরে কেটে গেছে দেড়শ বছর। ঐতিহাসিক সেই দিনটিকে ঘিরেই এ বছর দুই বাংলার নগরনাট্যে অনুষ্ঠিত হয়েছে বিশেষ আয়োজন। কলকাতায় বঙ্গ নাট্য সংহতি বছরব্যাপী আয়োজন সাজিয়েছে। আর ঢাকায় আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে ‘ঢাকা থিয়েটার’ ও ‘বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার’।

গত ৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশের মামুনুর রশীদের নির্দেশনায় ‘নীল দর্পণ’ নাটকের মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে কলকাতায় বঙ্গ নাট্য সংহতির বছরব্যাপি আয়োজন শুরু হয়। বঙ্গ নাট্য সংহতির বছরব্যাপী আয়োজনে ১৭টি পুরনো নাটকের নব মঞ্চায়ন, পঞ্চরঙ্গ নাটিকা, আলোচনা সভা, গবেষণা গ্রন্থ, স্মরণিকা প্রকাশের কথা রয়েছে।

এছাড়া ৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ঢাকার নাটক সরণির মহিলা সমিতির আইভি রহমান মিলনায়তনে আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল ‘ঢাকা থিয়েটার’ ও ‘বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার’। ‘ন্যাশনাল থিয়েটার : ইতিহাসের পুনর্ভাষ’ শীর্ষক এই আলোচনা সভায় মুখ্য আলোচক ছিলেন অধ্যাপক রতন সিদ্দিকী। আলোচক ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের অধ্যাপক পবিত্র সরকার, বাংলাদেশের নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, অধ্যাপক লুৎফর রহমান, সাধনা আহমেদ। পাঠ-অভিনয় ও আলোচনা করেন শিমূল ইউসুফ।

বছরজুড়ে নাট্যোৎসব

বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রাজধানীর নাটকের দলগুলো ঢাকা শহরেই নাট্যোৎসব করে। কিন্তু ঢাকার নাট্যদল নাটনন্দন বছরের শুরুতেই চট্টগ্রামে উৎসব আয়োজন করে। গত ১১ থেকে ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত ‘নাটনন্দন নাট্যোৎসব’এ সাত দিনে ছয়টি দলের অংশগ্রহণে সাতটি নাটক মঞ্চায়ন হয়। উৎসবের স্লোগান ছিল ‘সম্প্রীতির জাগরণ, নাটকে অন্বেষণ’।

ঈদের ছুটিতে সারা দেশের নাট্যাঙ্গনে কোনো নাটকের মঞ্চায়ন না থাকলেও বিগত কয়েক বছর ধরেই নাট্যোৎসব আয়োজন করছে জামালপুরের নাট্য সংগঠন ‘থিয়েটার অঙ্গন’। ২০১৬ সাল থেকে প্রতি বছরই ঈদের ছুটিতে জামালপুরে নাট্যোৎসবের আয়োজন করে সংগঠনটি। গত ১২ জুলাই ‘তেজ’ নাটকের প্রদর্শনীতে উৎসবের সূচনা হয়। জামালপুরের তিনটি নাট্যদল এই উৎসবে নাটক মঞ্চায়ন করে।

কুমিল্লায় টাউন হলে চার দিনব্যাপী নাট্যোৎসবের আয়োজন করেছে সাংস্কৃতিক সংগঠন যাত্রিক নাট্যগোষ্ঠী। সংগঠনটির ৪৮ বছরে পদার্পণ উপলক্ষে চার দিনব্যাপী এই নাট্যোৎসব শুরু হয় ৯ সেপ্টেম্বর, শেষ হয় ১২ সেপ্টেম্বর।

বিগত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় এবারও বাংলাদেশ ও ভারতের শিল্পীদের অংশগ্রহণে রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমিতে হয়েছে ১১ দিনব্যাপী ‘গঙ্গা-যমুনা সাংস্কৃতিক উৎসব’। ২১ থেকে ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত এ উৎসবে বাংলাদেশ ও ভারতের ১২২টি সাংস্কৃতিক সংগঠনের শিল্পীরা অংশ নেয়।

সৈয়দ মহিদুল ইসলামের ২০তম প্রয়াণ দিবস এবং ব্যতিক্রম নাট্যগোষ্ঠীর ৪৬ বছরে পদার্পণ উপলক্ষে ৪ থেকে ৮ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হয় ‘সৈয়দ মহিদুল ইসলাম স্মরণ উৎসব ২০২২’।

১৭ নভেম্বর থেকে চট্টগ্রামে ‘নান্দীমুখ আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসব ২০২২’ অনুষ্ঠিত হয়। চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে নান্দীমুখ আয়োজিত ১০ দিনব্যাপী এ উৎসবে বাংলাদেশ, ভারত, ফ্রান্স, জাপান, মেক্সিকো, স্পেন ও সুইডেনের ১২টি নাট্যদল অংশ নেয়।

১-৮ ডিসেম্বর টানা আট দিন অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় বার্ষিক নাট্যোৎসব। ‘হে উৎসুক দৃষ্টিপাত, এ তীর্থে আসো যদি হে শ্রীজ্ঞান, কায়ায় কায়ায় সৃজিব/ নব নব জীবনের মানুষ-রূপ-আখ্যান’ প্রতিপাদ্যে উৎসবের আয়োজন করেছেন ঢাবি থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগ। মঞ্চস্থ হয় ১৫টি নাটক।

১৭-২১ ডিসেম্বর ত্রিশালের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা ও পরিবেশনা বিদ্যা বিভাগ আয়োজন করে আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসব। এতে নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগ গ্রীণ বিশ্ববিদ্যালয় এবং ভারতের একটি নাট্যদল নাটক পরিবেশন করে।

১৯ থেকে ২৩ ডিসেম্বর ৫ দিনব্যাপি নাট্যোৎসব আয়োজন করে সিরাজগঞ্জের নাট্যলোক। দলটির ২৩ পূর্তি উপলক্ষ্যে শহীদ এম মনসুর আলী মিলনায়তনে এই উৎসবের আয়োজন করা হয়। এতে ঢাকা, সিরাজগঞ্জ ও ভারতের নাট্যদল নাটক মঞ্চস্থ করে।