মৌসুমীর ভাষায়, এখনকার নতুন শিল্পীরা ‘অনেক মেধাবী’, উৎসাহ না দিয়ে সাংবাদিকরা ‘স্ক্যান্ডাল’ নিয়ে মেতে থাকলে তারা এগোতে পারবে না।
Published : 09 Nov 2022, 11:03 AM
চলচ্চিত্রের নতুন শিল্পীদের বিভিন্ন ‘নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে’ জড়িয়ে পড়ার পেছনে সাংবাদিকদেরও ভূমিকা আছে বলে মনে করেন চিত্রনায়িকা মৌসুমী।
তিনবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত এই অভিনেত্রীর পর্যবেক্ষণ বলছে, ৯০ এর দশকে তিনি যখন ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন, সেই সময়ের সাংবদিকদের সঙ্গে এখনকার সাংবাদিকদের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য অনেক।
মঙ্গলবার মুক্তিপ্রতীক্ষিত ‘ভাঙন’ সিনেমার সংবাদ সম্মেলনে হাজির হয়েছিলেন মৌসুমী। এক সাংবাদিক তাকে প্রশ্ন করেছিলেন, নায়িকা চরিত্রে নতুন যারা অভিনয় করছেন, শাবনূর-মৌসুমীদের মত তারা নিজেদের মেলে ধরতে পারছেন না কেন।
জবাবে মৌসুমী বলেন, “আমাদের নতুন শিল্পীরা অনেক মেধাবী। তারা বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে কাজ করছে। তাদের উৎসাহ দিতে হবে। স্ক্যান্ডাল নিয়ে আলোচনায় মেতে থাকলে তারা এগোতে পারবে না। সাংবাদিকদের দেখার দৃষ্টিভঙ্গিটা পাল্টাতে হবে। উৎসাহ দিতে হবে। সাংবাদিকদের আরও প্রোটেকটিভ হতে হবে।”
কী ধরনের ‘প্রোটেকশনের’ কথা মৌসুমী বলছেন? তার জবাব, “আমরা যখন কাজ করেছি, সাংবাদিক ভাইয়েরাই আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রোটেক্ট করেছেন। নতুন কাজ করার সময় আমরাও অনেক ভুল-ভ্রান্তি করেছি। আমাদের ভুল হয়েছে। সেটাকে শুধরে নেওয়া, সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা, কাউন্সেলিংয়ের মধ্য দিয়ে সঠিক পথে দাঁড় করিয়ে দেওয়ার কাজটা সাংবাদিক ভাইয়েরাই করেছেন।
“এখনকার সাংবাদিকরা তা করেন না। এখন সাংবাদিকরা যাচ্ছেতাই বলেন, যাচ্ছেতাই ভিডিও করেন, যা তা টাইটেল দিয়ে নিউজ ছেড়ে দেন। আপনাদের কারণে আমাদের ছেলে-মেয়েদের ভালো হওয়ার কোনো রাস্তা অবশ্য নেই। তারপরও আপনাদের দায়িত্ব দিলাম। আপনারা ঠিক করেন।”
সরকারি অনুদানের সিনেমা ‘ভাঙন’-এর এই সংবাদ সম্মেলনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল গুলশানের একটি পার্লারে। উপস্থিত সাংবাদিকদের স্থান সঙ্কুলান না হওয়ায় পরে পার্লারের গ্যারেজে সরিয়ে নেওয়া হয় সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন। ভাঙন সিনেমার নির্মাতা মির্জা সাখাওয়াৎ হোসেন ছাড়াও শিল্পী, কলাকুশলীরা উপস্থিত ছিলেন।
সিনেমা নিয়ে মৌসুমী বললেন, প্রযুক্তিবাংলা কথাচিত্রের ব্যানারে ‘জীবনঘনিষ্ঠ, সাহিত্যনির্ভর’ চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়েছে ‘মোহন গায়েনের বাঁশি’ নামের একটি ছোট গল্প অবলম্বনে।
“পুরনো রেল স্টেশনের হকার, চুড়িওয়ালী, ভিখারি, পকেটমার, পতিতা, দালাল, মাদকসেবীসহ কয়েকজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর যাপিত জীবনের গল্প ভাঙন। আমার চরিত্রের নাম জুলি।”
মৌসুমী জানালেন, সিনেমার গল্পে ছিন্নমূল কিছু মানুষের চরিত্র প্রাধান্য পেয়েছে। তাদের জীবন-যাত্রা, ভালোবাসা, সুখ-দুঃখ এসব আছে; বিচ্ছেদ আর কষ্টের কথাও আছে।
“কী দুঃখ নিয়ে হাজার হাজার মানুষের মাঝে ভেসে বেড়ায়, জীবনটাকে পার করে দেয় এইসব বিষয় তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। নির্মাতা জীবনের কাছ থেকে দেখা কিছু চরিত্রকে এই সিনেমায় তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।
“এটা যেহেতু বাণিজ্যিক ছবি না; সরকারের অনুদানের ছবি। অনেক কিছুই মাথায় রাখতে হয়েছে। শিল্প ও নান্দনিক বিষয়গুলো মাথায় রেখে কাজ করতে হয়েছে। গানগুলোও খুব সুন্দর, গানের সুর সুন্দর হয়েছে। বাঁশির দারুণ ব্যবহার হয়েছে। অনেক নতুনত্ব যেমন আছে, গ্রামের হারিয়ে যাওয়া অনেক বিষয়ও তুলে আনা হয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে আমার কাছে ভালো লেগেছে।”
ভাঙনে দর্শকের জন্য কী থাকছে? গত শতকের সাড়া জাগানো সিনেমা ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ সিনেমার নায়িকা মৌসুমী বললেন, “আমরা সাধারণ মানুষরাও সুন্দরভাবে বাঁচতে চাই। রেললাইনের পাশে, বস্তিতে কিংবা ছিন্নমূল জীবন যাপন করে যারা, তাদেরও জীবন আছে। তারাও সুন্দর করে ভাবে। ভালোবাসার গল্প রয়েছে।
“সেইসব মানুষের পাশে দাঁড়ানো এবং সহযোগিতার হাত বাড়ানোর ম্যাসেজ রয়েছে এই ছবিতে। ধনী শ্রেণি তো অসহায় মানুষদের শোষণ করে যাচ্ছে। সেই শোষণ থেকে বিরত থাকা, অসহায় মানুষদের সুন্দর করে বাঁচার সুযোগ তৈরি করে দেওয়া। তাদেরও দেশের মাটিতে সমান অধিকার রয়েছে এই বক্তব্যগুলোই চলে এসেছে।”
একই দিনে মৌসুমী অভিনীত দুটি সিনেমা মুক্তি পাচ্ছে। তিনি জানালেন, দুটো সিনেমা পরপর দুই সপ্তাহে মুক্তির কথা ছিল। দেশান্তরের মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল ১১ নভেম্বর। ৪ নভেম্বর মুক্তির কথা ছিল ভাঙনের। তবে পরে সিদ্ধান্ত বদলায়।
তবে আলাদা সপ্তাহে মুক্তি পেলেই ভালো হত বলে মনে করেন এ তারকা। তিনি বলেন, “আমি এখন কোনটা রেখে কোনটার কথা বলব। কারণ দুইটাই আমার কাছে ভীষণ প্রিয়। অনেক ভালো গল্পের ছবি। দুইটা ছবির জন্যই সমানভাবে মায়া কাজ করছে।”
ভাঙনের শুটিংয়ের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল? মৌসুমী বললেন, খোলা জায়গায় শুটিং করতে গিয়ে ভক্তদের ভিড়ের কারণে বেগ পেতে হয়েছে।
“পরিচিত মুখ নিয়ে কাজ করতে পারলে পরিচালকের ভালো লাগে। এতে পরিচালকের অনেক সুবিধা হয়। সহজে প্রচার হয়। কিন্তু এমন আউটডোরে পরিচিত মুখ নিয়ে শুটিং করাটা কঠিন। মানুষের ভিড়ে আমরা ঠিকমত শুটিংই করতে পারিনি। এত ভিড় হয়েছিল যে দর্শকদের নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। পরিচালকের অনেক লস হয়েছে এজন্য।
“কারণ ট্রেনের টাইমিং বুঝে আমাদের শট ধরতে হয়েছে। দেখা যাচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ সময় সেটে মানুষ ঢুকে শটটা নষ্ট হয়ে গেছে। পরে আবার ট্রেনের জন্য অপেক্ষা। এসব কারণে এক দিনের জায়গায় তিন দিন শুটিং করতে হয়েছে।”
ছিন্নমূল মানুষের সঙ্গে মিশে অভিনয়ের অভিজ্ঞতাও সংবাদ সম্মেলনে বললেন এ নায়িকা।
“আমরা দুই-তিনটা রেল স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে শুটিং করেছি। প্লাটফর্মে যারা কাজ করেন, তাদের অনেক আগ্রহ ছিল আমাদের নিয়ে। যেহেতু তাদেরই জীবনের গল্প। তারা আমাদের আপন ভাবছিল। আমরাও তাদের আপন করে নিতে পেরেছিলাম। ছবিটা দেখার সময় সাধারণ মানুষদের ভালোলাগা কাজ করবে।”
এখনকার দর্শকরা সিনেমার কারিগরি বিষয়গুলোতেও নজর রাখেন। সেট ডিজাইন, কালার কারেকশন, মেকআপ, গেটআপ ইত্যাদি বিষয়ে ভাঙন টিম কতটা সচেতন ছিল?
মৌসুমী বললেন, “আমার কাছে মনে হয়েছে শুটিংয়ের সময় সাখাওয়াৎ ভাই অসুস্থ ছিলেন, তারপরও সেট ডিজাইন থেকে শুরু করে প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে উনি যথেষ্ট সচেতনতার পরিচয় দিয়েছেন। এখানে প্রাণ রায় কাজ করেছেন। তার শিল্পবোধ সম্পর্কে সবারই ধারণা আছে। তিনি অত্যন্ত গুণী একজন শিল্পী।
“আমরা সবাই মিলে ভালোটা করার চেষ্টা করেছি। এছাড়া সাখাওয়াৎ ভাই নির্মাতা, তার উপরে আমাদের কথা থাকতে পারে না। তিনি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন। অনুদানের ছবি হিসেবে অনেক বেশিই আয়োজন করেছেন তিনি।”
বাংলা সিনেমায় দেখা যায় মধ্য বয়সে পৌঁছেও নায়ক-নায়িকা কলেজ-ভার্সিটির শিক্ষার্থীর ভূমিকায় অভিনয় করছেন। ভাঙনে মৌসুমীর চরিত্র আর বয়সের সামঞ্জস্য কতটা ছিল?
ভাঙনের জুলি বললেন, “যে মেয়েটার চরিত্র আমি করেছি, সে ছিন্নমূল একজন। তার ডিভোর্স হয়ে যায়, শ্বশুরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। অনেক পোড় খাওয়া একটা জীবন। সেই চরিত্রের বয়স আমার বর্তমান বয়সের কাছাকাছিই।”
কেয়ামত থেকে কেয়ামত, আম্মাজান, দেবদাস, খাইরুন সুন্দরীসহ মৌসুমীর ‘হিট’ সিনেমাগুলোর মত ভাঙন সর্বস্তরের দর্শকের কাছে পৌঁছাতে পারবে? এ অভিনেত্রী বললেন, এটা বলা মুশকিল।
“আজ পর্যন্ত আমি যে ছবিটা ভালো বলেছি, সে ছবিটা ভালো চলেছে এমনটা কখনো দেখিনি। যে ছবিতে ভেবেছি আমার অ্যাওয়ার্ড পাওয়া উচিত, সে ছবিতে কিচ্ছু হয়নি। আবার যে ছবিকে ভাবনায় আনিনি, সেই ছবিতে অ্যাওয়ার্ড পেয়েছি। দর্শক পছন্দ করেছেন। হলে গেলে বোঝা যাবে। আমার জায়গা থেকে আমি বলব ভালো লেগেছে।”
মৌসুমী ছাড়াও ভাঙনে অভিনয় করেছেন ফজলুর রহমান বাবু, মির্জা আফরিন, প্রাণ রায়, সৃষ্টি মির্জা, রাশেদা চৌধুরী, খলিলুর রহমান কাদেরী, হিমেল রাজ, আনোয়ার সিরাজী, সঞ্জয় রাজ, মিশু চৌধুরী, মির্জা সাখাওয়াৎ হোসেন। আগামী ১১ নভেম্বর ৩০টি হলে মুক্তি পাচ্ছে ভাঙন।