অস্কারের এবারের আসরে সাড়া ফেলেছে ‘এভরিথিং এভরিহোয়্যার অল অ্যাট ওয়ান্স’ সাতটি পুরস্কার ঝুলিতে পুড়েছে সিনেমাটি, এরমধ্যে সেরা চলচ্চিত্রের পুরস্কারও রয়েছে। এই সিনেমাটি তৈরি হয়েছে মাত্র ২ কোটি ডলারে।
মহামারীরকালে একটি ঘরের ভেতর সাধারণ মানের কম্পিউটারে ওপেন সোর্স সফটওয়্যার ব্যবহার করে পাঁচশর বেশি চোখ ধাঁধানো ভিজুয়াল ইফেক্ট তৈরি করেন মাত্র পাঁচজনের একটি দল। কম খরচে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কীভাবে তারা এই সম্ভবকে সম্ভব করলেন, সেই গল্প তুলে ধরেছে ইন্ডিয়াঅয়্যার।
দারুণ সব ভিজুয়াল ইফেক্টের মাধ্যমে একজন সাধারণ নারীকে ধীরে ধীরে ‘মাল্টিভার্স-হপিং অ্যাকশন’ তারকায় দেখল দর্শকরা। এই নারী এভলিনের ভূমিকায় ছিলেন মিশেল ইয়ো। ড্যানিয়েলদের (মার্কিন নির্মাতা ড্যানিয়েল কোয়ান এবং ড্যানিয়েল শেইনার্ট) এই সিনেমার শত শত ইফেক্টগুলো রীতিমতো অবিশ্বাস্য ঠেকবে যে কারও কাছে, যদি জানতে পারে যে কোনো ‘হাই-এন্ড পোস্ট-প্রোডাকশন’ সুবিধা ছাড়াই বানানো হয়েছে এগুলো।
ড্যানিয়েলদের বন্ধু জ্যাক স্টলটজের নেতৃত্বে মাত্র কয়েকজন ছিলেন এই ভিএফএক্স তৈরির নেপথ্যে, যারা আগে কখনও এমন ফিচার ফিল্মে ইফেক্ট সুপারভাইজার হিসেবে কাজ করেননি, যাদের কাছে ছিল না প্রযুক্তির অত্যাধুনিক সম্ভার।
কীভাবে যুক্ত হয়েছিলেন এই কাজে- উত্তরে স্টলটজ বলেন, “তারা (নির্মাতা) আমার কাছে এসেছিল, কারণ তারা তাদের আগের সিনেমার ‘সুইস আর্মি ম্যান’ সিনেমার ভিজ্যুয়াল ইফেক্টের জন্য একটি পোস্ট হাউসের সাথে কাজ করেছিল। তবে তাদের কাজের প্রক্রিয়া তাদের ভালো লাগেনি।”
‘এভরিথিং এভরিহোয়্যার’ এ যুক্ত হওয়া নিয়ে স্টলটজ বলছেন, “আমরা সবসময় যেভাবে একসাথে কাজ করেছি, তার তুলনায় এটাকে খুবই খাপছাড়া মনে হয়েছিল। যেখানে আমি আমার কম্পিউটারটি ড্যানের বাড়িতে নিয়ে আসতাম এবং রেন্ডার চলার সময় কেবল আমরা আমাদের ডেস্কের নিচে ঘুমাতাম।
“আমরা এমন কিছুই চেয়েছিলাম কিংবা এমনটা নয়- বলার পরিবর্তে তারা আরও ঘনিষ্ঠভাবে আলাপ করতে চাইলেন। সুতরাং শেষ পর্যন্ত আমাকে খুঁজে বের করতে হল, কাজটি কীভাবে করা যায়।”
কাজটি চালিয়ে নিতে কয়েকজন ভিজুয়াল ইফেক্ট শিল্পীদের নিয়ে একটি ছোট দল গঠন করেন স্টলটজ, যারা নিজেদের মতো করে চলচ্চিত্রে কাজ করে যাচ্ছিলেন। নিজেদের কাজের জন্যই ইফেক্টগুলো শিখেছিলেন তারা।
“আমরা প্রত্যেকেই শিখেছি কীভাবে নিজেদের বেডরুমে ভিজ্যুয়াল ইফেক্টগুলি নিজেদেরই করতে হয়, কারণ আমাদের তা প্রয়োজন ছিল। অবশেষে পাঁচজন লোক ভিজ্যুয়াল ইফেক্ট শটগুলোর ৮০% এরও বেশি শেষ করে,” বলেন স্টলটজ।
স্টল্টজ, ইথান ফেল্ডবাউ, বেঞ্জামিন ব্রুয়ার, জেফ ডেসম ও ম্যাথিউ ওয়াহকোনেন, মোট পাঁচজন নিয়ে গঠিত দলটি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত স্বতন্ত্রভাবে শট তৈরি করার জন্য সাধারণ ভিজ্যুয়াল ইফেক্ট প্রয়োগ করেছিল।
মূলত আফটার ইফেক্টের মতো প্রোগ্রামে তারা সবাই পরিচিত ছিল। “থ্রিডি প্রোগ্রামগুলো আমরা জানতাম না, আমরা আসলেই জানতাম না। তবে আমরা প্রত্যেকেই আফটার ইফেক্টস জানতাম এবং বুঝতাম কীভাবে সহজে কাজগুলো তুলে পেলা যায়,” বলেন স্টলটজ।
ভিজ্যুয়াল ইফেক্ট টিমটি ‘এভরিথিং এভরিহোয়্যার’ নির্মাতাদের উভয় জগতের সেরাটি দিতে পেরেছিল। কারণ স্টলৎজ এবং তার দল চলচ্চিত্র নির্মাতাদের চাহিদা বুঝতে পেরেছিল। নাথান ফেল্ডবাউ বলেন, “এটা আদতে প্রথাগত কাজের মতো করে হয়নি, যেখানে একজন একটা পরিকল্পনা দাঁড় করান, তা তৈরি করতে পাঠান আরেকজনকে, তারপর আরেকদল তা পরিপূর্ণ রূপ দেয়।”
জেফ ডেসম বলছেন এভাবে- “একজন পরিচালকের চোখে দেখুন গোটা ব্যাপারটা, আপনার জানতে হবে মূল বিষয়টি এবং সিদ্ধান্ত নিতে হয় আপনার হাতে কী আছে, যা গল্পটিকে সবচেয়ে ভালোভাবে প্রকাশ করতে পারে।”
স্টলটজ সব সময় খুব উদ্বিগ্ন ছিলেন সময় আর অর্থ নিয়ে। তার দল তখন এমন মানসিক প্রস্তুতিও নিয়েছিল যে নিজেদের প্রতিটি শট নিয়ে তার সন্তুষ্ট থাকবেন, এটা নিখুঁত না হলেও।
“আমরা এটা নিশ্চিত করতে চেয়েছিলাম, সবগুলো কাজ যেন পরীক্ষায় অন্তত ‘বি’ হলেও পায়। আর যদি সময় থাকে, তবে আমরা সেই ‘বি’গুলোকে ‘এ’ কিংবা ‘এ’ প্লাস করতে করতে পারি। এটা এমন ছিল না যে নিখুঁত না হওয়া পর্যন্ত কাজ করতেই থাকব। বরং মানের দিক থেকে ভালো হলো কি না, সেটা নিশ্চিত করব। তারপর ভাবব, আরও নিখুঁত করা যায় কি না?”
সীমিত সুবিধা ‘এভরিথিং এভরিহোয়ার’র ভিজুয়াল দিকটি স্বতন্ত্র করে তুলেছিল। স্টলটজ বলেন, “কিছু কারণে কম্পিউটার গ্রাফিক্সের নির্দিষ্ট কিছু ব্যবহারের লক্ষ্য স্থির করি আমরা। প্রথমত, এক্ষেত্রে আমরা সেরা কেউ না; দ্বিতীয়ত, সব কিছু প্রয়োজনীয়ও না।”
“আমাদের লক্ষ্য ছিল মার্ভেলের চেয়ে পিছিয়ে থাকতে পারি, তবে ঘোস্টবাস্টার্সের (১৯৮৪ সালে মুক্তি পাওয়া সিনেমা) চেয়ে যেন এগিয়ে থাকি,” বলেন ইথান ফেল্ডবাউ।
“আমি প্রায়ই ‘হু ফ্রেমড রজার র্যাবিট (১৯৮৮ সালে মুক্তি পাওয়া সিনেমা) এর কথা আনছিলাম। তাদের খুব আধুনিক কম্পিউটার ছিল না। তাদের মানব মস্তিস্ক ছিল, দেখার একটি চোখ ছিল আলো ও ছায়ার রূপ বিশ্লেষণের।”
ফেল্ডবাউ বলেন, “আমরা মার্ভেল সিনেমাকে ছাড়িয়ে যাওয়ার মতো সাহস দেখাইনি, কারণ আমাদের তেমন কোনো সুবিধা ছিল না, তেমন দক্ষ মানুষও ছিল না, ছিল না তেমন উচ্চ গতির কম্পিউটার।
“যেমন ধরুন আমার অ্যানালগ ফিল্মের অভিজ্ঞতা ছিল, অভিজ্ঞতা ছিল অপটিকাল প্রিন্টিংয়ের, এটা সিনেমায় কীভাবে কাজে লাগানো যায়, আমি সনাতনী পদ্ধতিতেই সেই পথ বের করেছি।”
কোভিড মহামারীর খড়গ নেমেছিল এই সিনেমার উপরও। স্টলটজদের সেজন্য সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিতে হয়েছিল।
ফেল্ডবাউ বলেন, “পোস্ট প্রোডাকশন দ্রুত শেষ করতে চেয়েছিলাম আমরা, সেজন্য আমাদের সম্পাদক রোজার্সের সঙ্গে এক ছাদের নিচে থাকব ভেবেছিলাম। কিন্তু প্রোডাকশন যখন গুছিয়ে আনি, তখনই আসে লকডাউন। সবাই বিচ্ছিন্ন। কেমন করে সবাই হাত লাগিয়ে কাজটি শেষ করা যায়, সেজন্য নতুন পরিকল্পনা করতে হয়েছিল। শুরু হল ডেটা ম্যানেজমেন্টের খেলা, ফাইল একজনের কাছ থেকে আরেকজনের কাছে পাঠানো।”
স্টলটজের প্রথম চিন্তাটি ছিল, বিভিন্ন স্থানে থাকা সবার জন্য তাদের প্রয়োজনীয় শটটি পাওয়া নিশ্চিত করা।
তিনি বলেন, “আমরা এক্ষেত্রে রেজিলিও ফাইল সিঙ্ক সফটঅয়্যারটি ব্যবহার করেছি। এর মাধ্যমে যার যার হার্ড ড্রাইভ শেয়ার করা গেছে, এটা ছিল খুবই চমকপ্রদ, অনেকটা ড্রপবক্সের মতো বলতে পারেন। সবাই যার যার জায়গা থেকে একই ড্রাইভে কাজ করতে পারছিল।”
ডেসমের ভাষ্যে, “এটা ছিল শেখার চমৎকার এক অভিজ্ঞতা। ছোট্ট একটি দল চমৎকার বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে সমষ্টিগতভাবে কীভাবে একটি কাজ এগিয়ে নিতে পারে, এটা ছিল তারই নজির।”
স্টলটজ এক্ষেত্রে জোর দিচ্ছিলেন যৌথায়নের উপর। তিনি বলেন, “আমি কাজটি সবার জন্য সহজ করতে চেয়েছি। প্রতিটি শটটে একটি ফোল্ডারের কাঠামোর ছকে রাখা হয়েছিল, যাতে যে কেউ খুলেই কাজ এগিয়ে নিতে পারে।”
সম্পাদনার কাজটি কতটা সুচারুরূপে করতে হয়েছিল, সেই কথা বললেন ডেসম। “জবু টুপাকি চরিত্রটি যখন করিডোরে এভলিনের সঙ্গে মিলিত হল, সেই শটগুলোর অধিকাংশে জেমি লি কার্টিসকে দেখা যাচ্ছিল। তখন আমাদের মনে হল কার্টিসকে সরিয়ে দিতে হবে, প্রতিটি শট থেকে তাকে মুছে দিতে হবে। সম্পাদনার এই কাজটি বেশ কঠিন ছিল। কারণ শটগুলো ছিল মুভিং, আলোর তারতম্যও ছিল। কার্টিসের গায়ে ছিল ফারের কোট, সেটাও কাজটি কঠিন করে তুলেছিল।”
এভরিথিং এভরিহোয়ার সিনেমার আইকনিক ‘বাজেল’ দৃশ্যায়ন নিয়েও খাটতে হয়েছে স্টলটজের দলকে।
সিনেমায় বাজলটি যখন প্রথম একটা পর্দার আড়াল সরিয়ে দেখা যায়, তখন পুরো আবহটি কম্পিউটার গ্রাফিক্সের কাজ মনে হতে পারে দর্শকদের কাছে। আসলে তা ছিল না। এটা টু ডি ইমেজেরই ছিল, যা আলোক প্রক্ষেপনের মাধ্যমে করা হয়েছিল বলে জানান স্টলটজ।
ফেল্ডবাউ জানান, অ্যাডোব আফটার ইফেক্টস ও ব্লেন্ডারের মত ওপেন-সোর্স থ্রি ডি গ্রাফিক্স সফটওয়্যার ব্যবহার করেই বেশির ভাগ টুডি ইফেক্ট তৈরি করেছেন তারা।
কম বাজেটে অথচ দ্রুত সময়ে কাজ করার একট তাড়া ছিল স্টলটজের দলের। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি ছিল ড্যানিয়েলসের সঙ্গে বোঝাপড়াটা। আর সেটাই তাদের ইতিহাসে স্থান করে দিয়েছে।