তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা গ্লিটজকে বলেছেন, নীতিমালা মেনে সিনেমা আমদানি করা যাচ্ছে। কাউকে কোনো বাধা দেওয়া হচ্ছে না।
Published : 17 Feb 2025, 01:23 AM
সিনেমা আমদানির ‘জট’ খুলতে এবং সরকারি প্রণোদনা বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলনে যাচ্ছে চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতি; দাবি পূরণ না হলে সারাদেশে এক যোগে সব প্রেক্ষাগৃহে সিনেমা দেখানো বন্ধের প্রস্তুতিও নিচ্ছেন তারা।
সমিতির উপদেষ্টা সুদীপ্ত কুমার দাস গ্লিটজকে বলেছেন, দেশে ‘চলচ্চিত্র শিল্পের সংকট’ কাটানোর পদক্ষেপ নিতে এ মাসের ২২ তারিখ তারা একটি মতবিনিময় সভার আয়োজন করতে যাচ্ছেন। সারাদেশের হল মালিক, প্রযোজক, পরিবেশক, পরিচালক, চলচ্চিত্রের সংগঠন, টেকনিশিয়ানরা সেখানে থাকবেন। চলচ্চিত্র শিল্পের সংকট ও সবার দাবিগুলো সেখানে তুলে ধরা হবে।
"আমরা চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট কিছু মানুষকে একত্রিত করছি। আমরা সবার কথা শুনব, তারপর একটা সিদ্ধান্ত নেব। রোজার ঈদ পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হবে। যদি কোনো সমাধানে না আসে, হল তো এমনিই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, যেগুলো টিকে আছে, সেগুলোও একযোগে বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত আসতে পারে।"
মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমাগুলো হলে দর্শক টানতে ব্যর্থ হচ্ছে দাবি করে সুদীপ্ত বলেন, "গেল বছর ব্যবসা করেছি শুধু 'তুফান' সিনেমা দিয়ে। 'দরদ' সিনেমার যা আশা করেছিলাম তা হয়নি, তবে কিছুটা ব্যবসা হয়েছে।
“এর আগে ও পরে যেসব সিনেমা মুক্তি পেয়েছে, দর্শক টানার মত বা একটা সপ্তাহ চলার মত কোনো সিনেমাও ছিল না। কোনো কোনো সিনেমার ১০০টা টিকেটও বিক্রি হয় না। এই যে পরিস্থিতি চলছে, এভাবে টিকে থাকা যায় না।"
সিনেমা আমদানির নিয়মের কারণে আমদানিকারক, পরিবেশক ও হল মালিকরা বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন বলেও অভিযোগ করেন প্রদর্শক সমিতির এই উপদেষ্টা।
তিনি বলেন, "সিনেমা আমদানির নীতিমালায় বছরে যে ১০টি সিনেমা আমদানির নিয়ম করে দেওয়া হয়েছিল, সেটাও হচ্ছে না। সিনেমা আমদানির সেই কোটা অন্তত পূরণ করতে দেওয়া হোক।
“‘পুষ্পা ২' সিনেমা নিয়ে দর্শকদের আগ্রহ ছিল, এটা আনার খুব চেষ্টা আমাদের ছিল। কিন্তু সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী প্রকাশ্যেই ভিটো দিয়ে সিনেমা আমদানি আটকে দিলেন। ভারতীয় আগ্রাসনের কথা বলে বাধা দেওয়া হল।"
সুদীপ্ত বলছেন, চলচ্চিত্রের সমস্যার কথা জানাতে উপদেষ্টাদের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেছিলেন প্রদর্শক সমিতির দায়িত্বশীলরা। কিন্তু অনুমতি পাওয়া যায়নি।
"বর্তমান সরকার যদি চলচ্চিত্রের বিরুদ্ধেই হয়, চলচ্চিত্র না চালানোর পক্ষে থাকে, তাহলে আমরা হলই বন্ধ করে দিই। শুধু শুধু বিদ্যুৎ বিল আমাদের স্টাফদের বেতন নিজের পকেট থেকে কেন দেব। সেটা যে কত বড় বিপর্যয় হবে, সেটাই আমরা আমাদের আলোচনায় তুলে ধরব।"
মতবিনিময় সভায় কী কী বিষয় নিয়ে আলোচনা হতে পারে প্রশ্ন করলে সমিতির এই নেতা বলেন, "সিনেমা আমদানি; বড় সিনেমার ফাঁকে ফাঁকে হলগুলো যেন বাঁচানো যায় তেমন সিনেমা আমরা আমদানি করতে চাই।
“সরকারি অনুদানের ক্ষেত্রে শিল্প ঐতিহ্য নিয়ে চার থেকে পাঁচটা সিনেমায় অনুদান দেওয়া হোক এবং বাণিজ্যিক সিনেমায় অনুদান বাড়িয়ে দেওয়া হোক। হল সংস্কারের জন্য বিনা সুদে ঋণ দেওয়া, এফডিসিতে নব্বই দশকের যেসব প্রণদনা ছিল বা যেসব সুযোগ সুবিধা দেওয়া হত, সেসব যেন দেওয়া হয়। এই দাবিগুলো আমরা তুলে ধরব।"
বাংলাদেশে একসময় হলিউডের বা ইংরেজি চলচ্চিত্র নিয়মিত আমদানি হলেও হিন্দি চলচ্চিত্র আমদানি বন্ধ ছিল। প্রেক্ষাগৃহ মালিকদের আন্দোলনে ২০২৩ সালে সরকার ভারতীয় সিনেমা দেশে দেখানোর অনুমতি দেয়।
বাংলাদেশে ভারতীয় সিনেমা আমদানি করা হয় ২০০৪ সালে স্বাক্ষরিত সার্কভুক্ত দেশগুলোর মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি বা সাফটা চুক্তির আওতায়। সেই নীতিমালা অনুযায়ী কোনো দেশ একটি সিনেমা রপ্তানি করলে আরকেটি সিনেমা আমদানি করতে হয়।
২০২৩ সালে সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় পাঁচটি শর্তে বছরে ১০টি উপমহাদেশীয় সিনেমা আমদানির অনুমতি দেয়।
• শুধু বাংলাদেশের বৈধ চলচ্চিত্র প্রযোজক, পরিবেশকরা উপমহাদেশীয় ভাষায় নির্মিত চলচ্চিত্র আমদানির সুযোগ পাবেন।
• উপমহাদেশীয় ভাষায় নির্মিত চলচ্চিত্র সাবটাইটেলসহ পরীক্ষামূলকভাবে শুধু দুই বছরের জন্য রপ্তানির বিপরীতে আমদানি করার সুযোগ থাকবে।
• প্রথম বছর ১০টি চলচ্চিত্র রপ্তানির বিপরীতে আমদানি করতে পারবে। বছরে ১০টি করে উপমহাদেশীয় সিনেমা মুক্তি পাবে বাংলাদেশে।
• আমদানিকৃত উপমহাদেশীয় ভাষার চলচ্চিত্র প্রদর্শনের পূর্বে অবশ্যই বাংলাদেশ ফিল্ম সেন্সর বোর্ডের সনদ গ্রহণ করতে হবে।
• বাংলাদেশ ঈদ-উল-ফিতর, ঈদ-উল আজহা ও দুর্গাপূজার সপ্তাহে উপমহাদেশীয় ভাষার কোনো চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা যাবে না।
ক্ষমতার পালাবদলের পর গত অক্টোবরে ভারত থেকে আমদানি করা হয়েছে শুধু শ্রদ্ধা কাপুর ও রাজকুমার রাও অভিনীত 'স্ত্রী ২' সিনেমাটি। এর বিপরীতে বাংলাদেশের 'প্রহেলিকা' ভারতে যায়।
চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির অভিযোগ, এরপর তারা আরো কয়েকটি সিনেমা আমদানির অনুমতি চাইলেও সরকারের তরফ থেকে ‘বাধা’ দেওয়া হয়েছে ‘ভারতীয় সিনেমার আগ্রাসনের’ কথা বলে।
এর বদলে পাকিস্তানি সিনেমা আমদানির সুযোগ রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের সিনেমা পাকিস্তানে চলে না বলে তারা আমদানি করতে চায় না। সাফটা চুক্তির শর্তের কারণে পাকিস্তানি সিনেমাও আমদানি করা যাচ্ছে না বলে সমিতির ভাষ্য।
সমিতির অভিযোগের বিষয়ে সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করে জানা যায়, তিনি বিদেশে রয়েছেন।
পরে ফারুকীকে হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠালে তিনি উত্তরে লেখেন, “এটা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত না।”
তিনি তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন। তবে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামও ফোন ধরেননি।
হল মালিক সমিতি যে অভিযোগ তুলেছে, সে বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী কোনো জবাব দেননি।
বিদেশি সিনেমা, বিশেষ করে ভারতীয় চলচ্চিত্র আমদানির বিষয়ে বহু বছর ধরেই দুই ভাগ হয়ে আছেন চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট।
পরিচালক, প্রযোজক ও শিল্পীদের এক পক্ষ মনে করেন, ভারতীয় সিনেমা আমদানির সুযোগ দেশের চলচ্চিত্রকে ধ্বংস করে দেবে।
আবার হল মালিকেরা মনে করেন, বলিউডি সিনেমা মুক্তির মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের সিনেমা হলগুলো আবার প্রাণ ফিরে পেতে পারে।
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, দেশে বহু হল বন্ধ হয়ে গেলেও এখনও দেড়শর মত প্রেক্ষাগৃহ টিকে আছে। এসব হলে কর্মীর সংখ্যা আনুমানিক দেড় হাজার। এছাড়া প্রযোজক, পরিচালক, শিল্পী, টেকনিশিয়ানসহ ৫০ হাজার মানুষ এই চলচ্চিত্র শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু দর্শক খরায় টিকে থাকা হলগুলোও বন্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে আছে।
সমিতির আইন বিষয়ক সম্পাদক ও বগুড়ার মধুবন সিনেপ্লেক্সের মালিক রোকনুজ্জামান ইউনূস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, প্রায় ছয় মাস হল তারা তথ্য উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন। কিন্তু উপদেষ্টা হল মালিকদের সময় দিচ্ছেন না। সিনেমা আমদানির ফাইলও চাপা পড়ে আছে।
“হল মালিকরা ভালো ছবির অভাবে লোকসান গুনছে। কতদিন আর এভাবে লোকসান দেওয়া যায়। তাই আগামী ২২ ফেব্রুয়ারি আমরা সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে ঈদের পর থেকে দেশের সব সিনেমা হল বন্ধ ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি। অনেকে রোজার আগেই হল বন্ধের কথা ভাবছে।”
জয়পুরহাটের পৃথিবী সিনেমা হলের মালিক সোহেল আহাম্মেদ বলেন, “কোটি টাকা খরচ করে হল চালু রাখলেও সিনেমা হলে লোক আসছে না। এটা রেখে লাভ কী। ভালো ছবিও আমদানি করার পারমিশন সরকার দিচ্ছে না। প্রতি শোতে ১০-১২ জন দর্শক হয়। তা দিয়ে কর্মচারীদের খাবারের খরচও উঠতে চায় না।”
সান্তাহারের পূর্বাশা সিনেমা হলের মালিক মো. হেলাল বলেন, “ভালো ছবি নেই তাই হলও চলছে না। বসিয়ে রেখে বেতন দেওয়া হচ্ছে কর্মচারীদের। দেশেও ভালো ছবি তৈরি হচ্ছে না, আবার ছবি আমদানিও করতে দিচ্ছে না। হল খোলা রেখে লোকসান গোনার চেয়ে ঈদের আগেই হল একেবারে বন্ধ করে দেব ভাবছি।”
এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা গ্লিটজকে বলেন, “এখানে কখনোই বাধা দেওয়া হচ্ছে না, কোনো সিনেমাকেই বাধা দেওয়া হচ্ছে না। নীতিমালা অনুযায়ী সব কিছুই অবাধভাবে চলমান আছে।
“স্পেসিফিক কেউ বাধা দিলে সেটা নিয়ে লিখিত অভিযোগ দিতে পারে। তবে আমাদের দেশে চলচ্চিত্র আমদানির যে নীতিমালা আছে, সেটা অনুসরণ করে যে কেউ চলচ্চিত্র আমদানি করতে পারছে। কিছুদিন আগে আমাদের ফেস্টিভাল হয়েছে সেখানে আমরা বিদেশি প্রচুর চলচ্চিত্র দেখিয়েছি। কোনো কিছুই বাধাগ্রস্ত নয়, সবকিছু অবাধ।”
চলচ্চিত্রের সমস্যার কথা জানাতে প্রদর্শক সমিতির দায়িত্বশীলরা কয়েক দফা চেষ্টা করেও উপদেষ্টাদের সঙ্গে দেখা করতে পারেননি বলে যে অভিযোগ উঠেছে। তবে তা ‘সত্যি নয়’ বলে দাবি করেন মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, “মন্ত্রণালয় খুবই ওপেন, প্রতি মাসের মঙ্গলবার, বুধবার করে অন্তত চার থেকে পাঁচটা করে মিটিংয়ে বসা হচ্ছে চলচ্চিত্র পরিবেশক ও হল মালিকদের সঙ্গে। প্রচুর আলাপ-আলোচনা হয়। কোনো কিছুই বন্ধ নেই। যার কাছ থেকে এসব অভিযোগ এসেছে আমার মনে হয় তা সত্যি নয়।”
চলচ্চিত্রের উন্নয়নে কাজ চলছে দাবি করে তিনি বলেন, “আমরা হল মালিক সমিতির সঙ্গেও বসেছি, দুই তিনটা সভা হয়েছে। চলচ্চিত্রের উন্নয়নের জন্য সাংঘাতিকভাবে আমাদের উপদেষ্টারা কাজ করে যাচ্ছেন, আমরা বিভিন্ন নীতিমালা পরিবর্তন করছি, একদম অবাধ নিরপেক্ষভাবে সব কার্যক্রম চলছে।
“তথ্য মন্ত্রণালয় পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণমুক্ত। গত ১৬ বছর নানা নিয়ন্ত্রণ ছিল, এখন সব ইতিবাচকই দেখছি আমরা।”