পঞ্চাশ বছর ধরে যিনি সুধা বর্ষণ করছেন উপমহাদেশের সংগীতপ্রেমীদের হৃদয়ে তিনি রুনা লায়লা- বাংলাদেশের সংগীতজগতের কিংবদন্তি। রুনা লায়লা নামটি উচ্চারিত হলেই কানে বেজে ওঠে কত মনভোলানো গানের কলি, কত স্মৃতি, কত সুরঝংকার।
Published : 10 Apr 2015, 10:21 PM
১৯৬৫ সাল থেকে চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দেওয়া শুরু তার। উর্দু ছবি ‘জুগনু’ দিয়ে শুরু। তারপর গড়িয়ে গেছে পঞ্চাশটি বছর। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে গেয়েছেন অসংখ্য জনপ্রিয় গান। পাশাপাশি হিন্দি, উর্দু চলচ্চিত্রে গান গেয়েছেন|। গেয়েছেন ইংরেজি, পাঞ্জাবি, সিন্ধি, গুজরাতি, পশতু, বেলুচি, ফার্সি, নেপালি, ইতালীয়, স্প্যানিশ,আরবি, ফরাসি,মালয়, জাপানি ও অন্যান্য ভাষার গান।
রুনা লায়লার জন্ম ১৯৫২ সালে সিলেটে। তার বাবা ছিলেন রাজশাহীর মানুষ। বাবার চাকরি সূত্রে করাচিতে তার শৈশব ও কৈশোর কাটে। বাড়িতে সংস্কৃতির চর্চা ছিল। খুব ছোটবেলা থেকেই নাচ শিখতেন তিনি। বড়বোন দীনা লায়লা শিখতেন গান। বড় বোনকে গাইতে দেখেই তিনিও গান গাওয়া শুরু করেন। দীনার প্রভাব তার উপরে ছিল গভীর। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীনা লায়লার অকাল মৃত্যুর শোক তিনি কখনও ভুলতে পারেননি। দীনার স্মৃতি রক্ষার্থে তিনি বেশ কয়েকটি দাতব্য সংগীত জলসার আয়োজন করেন এবং সেখান থেকে পাওয়া অর্থ ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য দান করেছেন।
রুনা লায়লা গান শিখেছেন ওস্তাদ আবদুল কাদের, ওস্তাদ হাবিব উদ্দিন আহমেদ, প্রিয়া রং, ওস্তাদ গোলাম কাদির প্রমুখের কাছে। মাত্র ছ’ বছর বয়সে মঞ্চে গান গেয়ে শ্রোতাদের মুগ্ধ করেন তিনি।
১৯৬৫ সালে 'জুগনু' ছবিতে প্লেব্যাকের পর আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। একের পর এক উর্দু ছবিতে কণ্ঠ দেন তিনি। পাশাপাশি ‘জিয়া মহিউদ্দিন শো’, ‘বাজমে লায়লা’(এই টিভি শো টি তার নামেই হতো) ইত্যাদি জনপ্রিয় টিভি শোতে নিয়মিত অংশ নিতেন তিনি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৪ –এ স্বপরিবারে ঢাকায় ফেরেন তিনি। পাকিস্তানে তখন রুনা লায়লার দারুণ নামডাক। পরিচিত অনেকেই তাকে অনুরোধ জানায় ওখানেই থেকে যেতে। কিন্তু দেশের টানে সেই প্রতিষ্ঠা ছেড়ে চলে আসতে দ্বিধা করেননি রুনা লায়লা।
আশির দশকে রুনা লায়লার টিভি শো মানেই ছিল দর্শকের অধীর প্রতীক্ষা। টিভি শোতে তিনি গান পরিবেশন করতেন সম্পূর্ণ নিজস্ব ঢং-এ। অলংকারে শোভিত থাকতেন তিনি। জমকালো শাড়ি তো পরতেনই, সেইসঙ্গে ম্যাক্সি, গারারার মতো পোশাকও পরেছেন টিভি অনুষ্ঠানে যা সে সময় ছিল অকল্পনীয়। আশির দশকে প্রায় প্রতি ঈদেই রুনা লায়লার বিশেষ অনুষ্ঠান দর্শক মাতিয়েছে। তার গান শুধু শোনারই বিষয় ছিল না, ছিল দেখারও বিষয়। পরবর্তীতে এই গায়কী ও পরিবেশনার ধরন অনেকে শিল্পীই অনুসরণ করেছেন। টিভিতে গানের অনুষ্ঠানে আউটডোর রেকর্ডিং রুনার অনুষ্ঠানেই দেখা যায়। ধানখেতের ধারে, রেললাইনের পাশে দাঁড়িয়ে দেশের গান পরিবেশন করেছেন রুনা লায়লা। ‘প্রতিদিন তোমায় দেখি সূর্যোদয়ে’ , ‘স্মৃতি ঝলমল’, ‘আমায় গেঁথে দাও না মাগো’ ইত্যাদি অসংখ্য দেশের গানেও তার জনপ্রিয়তা বিপুল।
‘দুই জীবন’, ‘নিশান’, ‘দোস্ত দুশমন’, ‘প্রতিনিধি’, ‘স্বরলিপি’, ‘বেদের মেয়ে জোসনা’, ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত পর্যন্ত’ ‘দূরদেশ’, ‘বন্দিনী’, ‘অন্তরে অন্তরে’, ‘আগুন’, ‘আনারকলি’সহ অসংখ্য ব্যবসাসফল চলচ্চিত্রে গান গেয়েছেন তিনি।
কিন্নরকণ্ঠী রুনা ‘দমাদম মাসকালান্দার’সহ অনেক জনপ্রিয় হিন্দি গান গেয়েছেন। ভারতে ও পাকিস্তানে ‘সুকণ্ঠী বুলবুল’ হিসেবে তিনি দারুণ জনপ্রিয়।
রুনা লায়লার জীবনের কিছু ঘটনা, শিল্পী হিসেবে তার সাধনা ও সংগ্রাম নিয়ে নির্মিত ‘শিল্পী’ ছবিতে অভিনয় করেন তিনি। এ ছবিতে তার বিপরীতে ছিলেন চলচ্চিত্র নায়ক আলমগীর।
সংগীতে অবদানের জন্য রুনা লায়লা স্বাধীনতা দিবস সম্মাননা পেয়েছেন। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সেরা কণ্ঠশিল্পীর সম্মান জয় করেছেন পাঁচ বার। পেয়েছেন দেশবিদেশের অনেক সম্মাননা। বিশ্বের অনেক দেশে সংগীত পরিবেশন করেছেন তিনি। যেখানেই গেছেন সে দেশের দর্শক, শ্রোতা আর উপমহাদেশের প্রবাসীরা বিপুল উচ্ছ্বাসে বরণ করেছেন তাকে। তবে রুনা লায়লার সংগীত জীবনের পঞ্চাশ বছরে তার সেরা প্রাপ্তি অবশ্যই অসংখ্য শ্রোতার ভালোবাসা। এখনও রুনা লায়লা মানেই সুরের রাজত্বে সম্রাজ্ঞী।