তারেক মাসুদের কাছ থেকে আরও অনেক কিছু পেতে পারত বাংলাদেশ।
Published : 07 Dec 2020, 06:01 PM
অথচ এখন আক্ষেপ করা ছাড়া আর কি-ই বা করার আছে। ৬ ডিসেম্বর ছিল তার জন্মদিন। অবেলায় চলে যাওয়া এই পরিচালককে নিয়ে লিখলেন আরাফাত শান্ত।
তারেক মাসুদ, যে আক্ষেপের শেষ নেই। তার অকালে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু কত বড় ক্ষতি তা আমরা এখন টের পাই।
তার মতো কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার বাংলাদেশ মনে হয় না পাবে। আর পেলেও তিনি তারেক মাসুদ হবেন না। তার মৃত্যু বারবার মনে করায় ১৯৮৯ সালে ২০ জানুয়ারি বাংলাদেশের আরেকে বরেণ্য পরিচালক আলমগীর কবিরের দুর্ঘটনায় অকালে চলে যাওয়া।
এখনও ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলন তুমুলভাবে ‘মিস’ করে তাকে। সেখানে তারেক মাসুদের মতো প্রতিভা হারানোর ক্ষতি তো অপূরণীয়।
তারেক মাসুদ ১৯৫৬ সালে তদানীন্তন ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা উপজেলার নূরপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার মায়ের নাম নুরুন নাহার মাসুদ ও বাবার নাম মশিউর রহমান মাসুদ।
ভাঙ্গা ঈদগা মাদ্রাসায় পড়াশোনা শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে ঢাকার লালবাগের একটি মাদ্রাসা থেকে মৌলানা পাস করেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তার মাদ্রাসা শিক্ষার সমাপ্তি ঘটে।
যুদ্ধের পর তিনি ফরিদপুরের ভাঙ্গা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রাইভেটে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় অংশ নেন। এরপর আইএ পাশ করেন আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ থেকে ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্স শেষ করে তিনি তার প্রথম প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ শুরু করেন।
তারেক মাসুদের সিনেমা বুঝতে ও তাকে চিনতে, তার 'চলচ্চিত্রযাত্রা' বইটা পড়ার বিকল্প নেই। ক্ষণস্থায়ী জীবনেই তিনি যে মাপের সব কিছু নিয়েই পড়াশোনা করেছেন আর যা সিনেমা দেখেছেন সেই আমলে, তার তুলনা নেই।
এস এম সুলতানের জীবন নিয়ে 'আদম সুরত' বানাতে অনেকদিন লাগছিল। সবাই হাসাহাসি করতো, অনেকেই জিগ্যেস করতো – “শেষ করতে পারবা না আর ছবিটা? নাকি সুলতানের মরণের জন্য ওয়েট করছো?”
তারেক মাসুদ হেসে বলতেন, “আমি শেষ করতে চাই তবে তা শেষ করার জন্য নয়, কাজটা শেষ হলেই শেষ করবো।”
‘সুলতান’ নির্মাণের সময়ের বেশিরভাগ সময়েই কথা হত মানুষের জীবন-দর্শন নিয়ে। বিশেষ করে বাঙালির সমাজ, ইতিহাস, সংস্কার-সংস্কৃতি নিয়ে। তার সঙ্গে এস এম সুলতানের সাত বছর ধরে চলা সময়ের কথা বলতেন।
বলতেন “সুলতান ভাইয়ের ওপর ছবি করতে আমার সাত বছর লেগেছে। সাত বছরে মানুষ হয়ত তেরটা ছবি করে। কিন্তু, আমার জীবনে পরববর্তীতে যা অর্জন সবই এই সাত বছরের জন্য অর্জিত হয়েছে।”
মহান শিল্পী এস এম সুলতান এর কথা প্রায়ই বলতেন। বলতেন, “আমি গ্রামের ছেলে কিন্তু সত্যিকারের গ্রাম দেখতে শিখেছি সুলতান ভাইয়ের চোখ দিয়ে।”
লিয়ার লেভিনের ‘র’ ফুটেজ নিয়ে ‘মুক্তির গান’ যে ধরনের চলচ্চিত্র সেই পরিসরের সিনেমা আগামী ৪০ বছরেও হবে না। ‘মুক্তির গান’ সিনেমায় যে পরিশ্রম আর বিপুল নিষ্ঠায় যা করেছেন, তার মূল্য এই দেশের সেই সময়ের সরকার দিয়েছে সেন্সরে ঝুলিয়ে রেখে।
‘মাটির ময়না’ নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নাই। সেটা তো ইতিহাস। পুরো বিশ্ব সিনেমার ইতিহাসে ‘মাটির ময়না’ ঠাঁই পায় যা বাংলাদেশে তার জাতীয় চলচ্চিত্রের প্রতিযোগিতা করতে হয় 'বিচ্ছুবাহিনী' সিনেমার সঙ্গে।
‘নরসুন্দর’, ‘অন্তর্যাত্রা’, ‘রানওয়ে’ এসব সিনেমার চেয়ে ভালো সিনেমা আর-কি হতে পারে?
তারেক মাসুদকে পরিচালক আলমগীর কবির বলেছিলেন, “চারটা রেপ সিন, ১০টা গুলি ফাইট, পাঁচ-ছয়টা স্লোগান দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা বানানোর চেয়ে না বানানো ভালো।”
তারেক মাসুদ ছিলেন তাদের দলে।
মৌসুমী ভৌমিক এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “স্বপ্ন দেখবো বলে’ গানটা অনেকের প্রিয়, কিন্তু ‘যশোর রোড’ মুক্তির গানে যে ভাবে গেয়েছি তার সাথে কিছুর তুলনা চলে না।”
আহমদ ছফার চিন্তাভাবনায় আস্থা রাখতেন তারেক মাসুদ। সব সময় বলতেন ছফার কথা। নিউইয়র্কে থাকতে রাত দিন পড়তেন, এমনও হয়েছে সকালে শুরু করে রাতের শেষ দিকে ফিরতেন বাসায়।
তার প্রতিটা কাজের মানে আন্তর্জাতিক কিন্তু গভীরভাবে শেকড়ে প্রোথিত। খুব চাইতেন দেশে একটা ভালো ফিল্ম আর্কাইভ হোক। এই ওটিটি প্লাটফর্মের যুগে নিশ্চিত ভাবে তিনি দারুণ কাজ করতে পারতেন।
ছেলেমেয়েরা এত সিনেমা দেখে এটাকে তিনি খুব বড় সুযোগ হিসেবে ভাবতেন। ইরানি কিংবদন্তি আব্বাস কিয়রোস্তামি তাকে স্নেহ করতেন। অনেক বড় বড় ফিল্ম স্কলার তার সিনেমা দিয়ে বাংলাদেশ দেখেছেন।
জন্মদিনে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা এ অকাল প্রয়াত অসম্ভব মেধাবী চলচ্চিত্র নির্মাতার প্রতি।