কাঁটাতারের ভাগ আর দাগের এপার ওপারে সেই মেয়েটা কখনো নুসরাত, আবার কখনো নিরুবালা হয়ে মিলেমিশে এক হয়ে গেল মুনমুন মুখার্জীর আবৃত্তি ও কথকতায়।
Published : 25 Oct 2019, 12:19 PM
বৃহস্পতিবার রাতে র্যাডিসন ব্লু চিটাগাং বে ভিউ হোটেলে একক পরিবেশনা 'প্রণতি গ্রহণ করো..." তে কবিতার প্রণতি নিয়ে হাজির হয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের আবৃত্তি শিল্পী মুনমুন।
বঙ্গবন্ধু বাচিক বিদ্যালয়ের উদ্বোধন উপলক্ষে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রামে ভারতীয় সহকারী হাই কমিশনার অনিন্দ্য ব্যানার্জী, বিএফইউজের সহ-সভাপতি রিয়াজ হায়দার চৌধুরী, বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আহকাম উল্লাহ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাশেদ হাসান, বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলার সভাপতি সাজ্জাদ হোসেন ও উপদেষ্টা বোরহান উদ্দিন চৌধুরী মুরাদ।
মুনমুনের পরিবেশনা শুরু হয় আশীষ মুখোপাধ্যায়ের 'ভাগ মানি না দাগ মানি না' আবৃত্তির মধ্য দিয়ে। তিনি বলেন, "কাঁটাতার হয়ত শুধু সীমানা আলাদা করেছে, কিন্তু বাংলা আমাদের জুড়ে রেখেছে।"
এরপর পূর্ণেন্দু পত্রীর 'সেই গল্পটা' থেকে মেঘের সাথে বজ্রের বিয়ে আর পাহাড়টাকে কোনোদিন ভুলতে না পারার দুঃখগাথা যখন মুনমুন শোনাচ্ছিলেন, তখন সীমানার দাগ মুছে হলভর্তি শ্রোতার মনে মেঘের জন্য কষ্ট অথবা নিজের গোপন করা ব্যথাটিই যেন বেজে উঠল।
'ভাগ না হওয়া' নজরুলের 'বাসন্তী' কবিতা থেকে যখন মুনমুন আবৃত্তি করছিলেন, 'কুহেলীর দোলায় চড়ে' যেন ছন্দে আনন্দে ভাসছিল সবাই।
“আজ ফ্লাইটে আসতে আসতে মোবাইলে দেখা একটা খবরে মন ভালো হয়ে যায়। অপরাধের শাস্তি হলে আনন্দ পাই, সবচেয়ে আনন্দ হবে যখন এসব আর ঘটবেই না। জীবদ্দশায় দেখে যেতে চাই, এ কবিতা আমায় আর পড়তে হবে না।”
কোন সে কবিতা? কোন সে খবর? সে খবর ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির হন্তারকদের সর্বোচ্চ শাস্তির। সে কবিতা সৌমেন অনন্তের 'সেই মেয়েটা'।
“এই মেয়েটার মেয়ে হওয়াই ভুল ছিল/... এই মেয়েটার মানুষ হবার পণ ছিল/... এই মেয়েটার এত্ত সাহস 'না' বলে? এই মেয়েটা উঁচিয়ে মাথা পথ চলে।”
আবৃত্তি শেষ করে মুনমুন বলেন, "নারী জীবন কোনো ভুল নয়, ভুল তারাই, যারা নারীকে কলুষিত করে।”
অপ্রেমের চেয়ে যে প্রেম ভালো, সে কথা মুনমুন শোনান তসলিমা নাসরিনের কবিতা থেকে।
তিনি যথন আবৃত্তি করছিলেন- 'এমন ভেঙে চুরে ভালো কেউ বাসেনি আগে', তখন সত্যিই মনে হতে থাকে, “আমাকে এত আশ্চর্য সুন্দর শব্দগুচ্ছ কেউ শোনায়নি কোনওদিন/এত প্রেম কেউ দেয়নি,/এমন ভেঙে চুরে ভালো কেউ বাসেনি।"
এরপর শুভ দাশগুপ্তর ‘মেঘ বলল যাবি’ কবিতা থেকে গেরুয়া নদী আর একলা পাহাড়ের গল্প শুনিয়ে মেঘের সঙ্গী হতে সবাইকে যেন একে একে ডেকে যান মুনমুন।
বাংলা মানে তো রবীন্দ্রনাথ। 'সকল কাঁটা ধন্য করে' তার শরণ নিতেই হয় মুনমুনকে। আবার অরুণ কুমার চক্রবর্তীর 'রবি ঠাকুর পেন্নাম হই' থেকে তিনি শ্রোতাদের সামনে হাজির করেন অন্য এক প্রাণের ঠাকুরকে।
গান আর কবিতার এই সাযুজ্য জীবনের নানা বাঁকে যে এক, সে কথাও বলেন এ শিল্পী।
“নিরুবালা, এটা কোনো কবিতা নয়, একটা রচনা। অনেক বছর আগে আনন্দবাজারের রবিবাসরীয়তে পড়েছিলাম সঞ্চারী মখোপাধ্যায়ের লেখা। পড়ে আমি কেঁদেছিলাম, তখনই ঠিক করি এটা একদিন ছড়িয়ে দেব। যেখানেই থাকি নিরুবালাদের যেন উপেক্ষা না করি।"
এই নিরুবালা আর মালারা কলকাতায়, দিল্লিতে আছে, আছে ঢাকা আর চট্টগ্রামেও।
সুনীলের 'ভালোবাসি ভালোবাসি' আর আরণ্যক বসুর 'মনে থাকবে'র রেশ মনে ধরে শ্রোতাো যখন পাঁচ তারকা হোটেলের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আলো-আঁধারি থেকে বেরিয়ে এলেন, তখনই গ্রাম ছেড়ে জীবিকার খোঁজে নগরের ফুটপাতে শয্যাপাতা মানুষ দেখে মনে পড়ে যায়, "তুমি আমায় মাফ কোরো নিরুবালা, করবে তো?"