'“বাংলাদেশের সিনেমা খুব বিরল, নারী নির্মাতা আরো বিরল; প্রগতিশীল ধারনার সিনেমা তার চেয়েও বিরল। রুবাইয়াতের ‘আন্ডার কন্সট্রাকশন’ সিনেমার মধ্যে এ দুষ্প্রাপ্যতা বিদ্যমান।” - যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনভিত্তিক অনলাইন শিল্প সাময়িকী দ্য আর্ট ফিউজে এমনটাই বলা হয়েছে বাংলাদেশি নির্মাতা রুবাইয়াত হোসেনের দ্বিতীয় সিনেমা সম্পর্কে।
Published : 26 Jan 2016, 04:23 PM
স্টকহোম চলচ্চিত্র উৎসবে চলচ্চিত্রটি সম্পর্কে বলা হয় - “বিতর্কিত চলচ্চিত্র নির্মাতা রুবাইয়াত হোসেন নিজের মতো করে আবিস্কার করে চলেছেন বাংলাদেশি সমাজের নীতি-নৈতিকতা। এবার রয়া নামের একজন মঞ্চাভিনেত্রী, যে ‘রক্তকরবী'র নন্দিনী কর্তৃক অনুপ্রাণিত হয়ে মধ্যবিত্ত জীবনে নিজেকে ভেঙ্গে নতুন করে গড়তে চায়; খুঁজে পেতে চায় নতুন করে নিজ কামনাকে।”
বলাকা সিনেমা হলে সিনেমাটি দেখার পর একজন সাধারণ দর্শক অবশ্য বলে উঠলেন, “এটা কেমন সুস্থ ধারার সিনেমা হলো? মায়ের দূর্দিনে তার থেকে থিয়েটার বড়ো হলো? থিয়েটার করে জাতিরে উনি কি শিখাবে? এর থেকে তো এফডিসির সিনেমা ভালো। ওরা এমন স্বার্থপর হওয়া শেখায় না।”
এমন বাস্তবতায় ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা এক নারীর একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর গল্পই ‘আন্ডার কনস্ট্রাকশন' -এর মূল বিষয়বস্তু। যদিও সিনেমাটা বোঝার জন্য ‘রক্তকরবী' নাটকটা দেখা বা পড়া থাকা খুব জরুরী।
‘রক্তকরবী' রবীন্দ্রনাথের শেষ দিকের লেখা নাটক। ১৯২৬ এর দিকে শিলংয়ে বেড়াতে গিয়ে কনক্রিট আর কাঁটা তারের জঞ্জালের ভেতর একটি রক্তকরবী ফুটে থাকতে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে নাটকটি লেখেন। ফুলের মতো এক চরিত্র - সুন্দরী, উর্বরা, যুবতী নন্দিনীকে নির্মাণ করেন রবীন্দ্রনাথ । কনক্রিটের জঞ্জালের মতো এক রাজ্য, যার রাজা নিজেকে রাখেন প্রজাদের দৃষ্টির আড়ালে। তৈরী করেন শোষন ও ত্রাসের রাজত্ব। নন্দিনী সে রাজ্যের প্রেম ও মুক্তির স্বপ্ন। প্রেমের বার্তা নিয়ে নন্দিনী অপেক্ষা করে রঞ্জন এসে সকলকে মুক্ত করবে। খনিতে কাজ করা নামহীন শ্রমিকদের মুক্ত করবে সে। নন্দিনীর প্রেম রাজাকেও করে তোলে মুগ্ধ, ঈর্ষা পরায়ন হয়ে ওঠেন তিনি রঞ্জনের প্রতি নন্দিনীর ভালোবাসা দেখে। এক সময় মঞ্চে আসে রঞ্জনের প্রাণহীন দেহ, যা রাজ্যের সকলকে করে তোলে বিপ্লবী আর সে বিপ্লবে রাজাও অংশগ্রহণ করেন।
পোশাক শিল্প এখন গৃহকর্মীদের কর্মসংস্থানের বিকল্প। সেখানে ঝুঁকিপূর্ণ অমানবিক পরিশ্রম হলেও তা সম্মানের কাজ। ‘রক্তকরবী'র নামহীন খনি শ্রমিকের মতোই আমাদের এখনকার পোশাক শিল্প শ্রমিকেরা পুঁজিদাস। বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পের এই পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক মহলের জন্য আগ্রহোদ্দীপক।তবে রুবাইয়াতের এই ইস্যুর ব্যবহার গল্পের কোথাও আরোপিত মনে হয়নি।
প্রথম সিনেমা ‘মেহেরজান' এর গল্পে পাকিস্তানি সেনাবাহিনি থেকে পলাতক সৈনিকের প্রতি বাঙ্গালি নারীর প্রেম চিত্রায়ন করে রুবাইয়াত মুক্তিযুদ্ধের অনুভূতিতে যে আঘাত হেনেছিলেন, তারপর দ্বিতীয় সিনেমায় তিনি কি করেন তা নিয়ে চাপা আগ্রহ বিরাজ করছিলো। তবে এবার কোনো ঝুঁকি নেননি এই নির্মাতা। মধ্যবিত্ত প্রগতিশীল নারী অভিনয়শিল্পীর সমাজে শৈল্পিক প্রতিষ্ঠা পাওয়ার সংগ্রামকে ধারণ করতে চেয়েছেন। নাম করনের দিক থেকে রুবাইয়াত শতভাগ সার্থক। তার শহর নির্মানাধীন, গল্পের চরিত্র নিজেও নিজেকে নির্মাণে ব্যস্ত আর তার ফ্ল্যাটের পাশের ভবনটিও নির্মানাধীন। এবং নির্মাতা হিসেবে রুবাইয়াত নিজেও আন্ডার কনস্ট্রাকশন।
তুলনামূলকভাবে অনেক ব্যায়বহুল সিনেমা ‘আন্ডার কনস্ট্রাকশন'। কারিগরী দিক থেকে সমসাময়িক অনেক সিনেমার চেয়ে এর শব্দ গ্রহণ, চিত্র গ্রহণ, পোশাক বা লোকেশন সামগ্রিক বিচারে বেশ ভালো। পর্দা দেখতে পরিচ্ছন্ন লেগেছে। নগরে বৃষ্টির দৃশ্যাবলী কিংবা একক শটে স্বপ্নের দৃশ্যের চিত্রায়ন রুবাইয়াতের চিত্র বর্ণণার দক্ষতার পরিচয় প্রদান করে।
সিনেমায় মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন ‘রক অন' খ্যাত ভারতীয় অভিনেত্রী শাহানা গোস্বামী। নাট্যনির্মাতা রাসেলের চরিত্রটিও পর্দায় রূপদান করেছেন ভারতের রাহুল বোস। এছাড়াও অভিনয় করেছেন বাংলাদেশের মিতা চৌধুরী, তৌফিকুল ইসলাম ইমন প্রমূখ
পুরুষতান্ত্রিক সমাজে রয়ার বিপ্লব কিংবা কোনো নারী নির্মাতার প্রতিষ্ঠা সহজ নয়, যা রুবাইয়াত রয়ার মধ্য দিয়ে আমাদের দেখানোর চেষ্টা করেছেন। সমাজের অন্ধকার ঘরে যে পুরুষেরা এখনো ‘রক্তকরবী'র রাজা হয়ে বসে আছেন, তারা যদি সত্যিই বিপ্লব আসন্ন তা অনুধাবন করতে না পারেন তবে তাদের রাজ্যের আমূল ধ্বংস অনিবার্য। নারীর অগ্রযাত্রার বাধা কেউ হতে পারবে না, যখন রয়ার মতো সবাই বিপ্লবী হয়ে উঠবে, সংসারের মায়ায় তাদের আর আটকে রাখা যাবে না।