টিভি নাটকের শিল্পীদের সবচেয়ে বড় সংগঠন অভিনয় শিল্পী সংঘ প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানকে ইউটিউবে নাটকটি আবারও মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
Published : 18 Apr 2024, 09:28 PM
‘রূপান্তর’ নামের নাটকটি নিয়ে গত কয়েক দিনে যেসব নাটকীয়তা ঘটে গেছে, তাতে বিস্মিত, হতবাক নির্মাতা রাফাত মজুমদার রিংকু।
তিনি বলছেন, যে ঘটনা এ সমাজেই বিদ্যমান, সেই একই ঘটনা নাটকের গল্পে উঠে আসায় এমন প্রতিক্রিয়া তৈরি হতে পারে, সেটা তিনি কল্পনাও করেননি।
নীহার আহমেদের চিত্রনাট্যে নাটকের প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন ফারহান আহমেদ জোভান। নাটকে তার নাম সৌরভ, তিনি একজন চিত্রশিল্পী। প্রেমের গল্প এগিয়ে যেতে যেতে বোঝা যায়, সৌরভ দেখতে পুরুষের মত হলেও মানসিকভাবে তিনি একজন নারী। অর্থাৎ, তিনি একজন রূপান্তরকামী।
গত ১৫ এপ্রিল সন্ধ্যায় ইউটিউবে নাটকটি প্রকাশিত হওয়ার পর সোশাল মিডিয়ায় একটি অংশের তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। ওই বিরূপ প্রতিক্রিয়ার মুখে ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান একান্ন মিডিয়ার ইউটিউব চ্যানেল থেকে সরিয়ে ফেলা হয় ‘রূপান্তর’।
ওই নাটকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছিল প্রযুক্তি খাতের কোম্পানি ওয়ালটন। সে কারণে ফেইসবুকে অনেকে ওয়ালটনের পণ্য বর্জনের ডাক দেয়। তাদের অভিযোগ ছিল, রূপান্তর নাটকের মাধ্যমে ট্রান্সজেন্ডার অর্থাৎ রূপান্তরকামীদের নিয়ে প্রচারকে উৎসাহিত করা হয়েছে।
এ পরিস্থিতিতে ওয়ালটনের পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশ করে বিবৃতি দেওয়া হয়। বলা হয়, নাটকের বিষয়বস্তু সম্পর্কে তাদের আগে জানানো হয়নি। সেজন্য বিজ্ঞাপনী সংস্থা ‘লোকাল বাস এন্টারটেইনমেন্ট’কে তারা উকিল নোটিসও পাঠিয়েছে।
অন্যদিকে অনেকে নাটকটি সরিয়ে নেওয়ারও সমালোচনা করেছে। তাদের যুক্তি, এক পক্ষের বিরূপ প্রচারের চাপে পড়ে বাস্তবতাকে অস্বীকার করা প্রযোজনা সংস্থার উচিত হয়নি।
টিভি নাটকের শিল্পীদের সবচেয়ে বড় সংগঠন অভিনয় শিল্পী সংঘ প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানকে ইউটিউবে নাটকটি আবারও মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
কী আছে নাটকে?
প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ‘রূপান্তর’ নাটকটি ইউটিউব থেকে সরিয়ে নিলেও নাটকের কপি ছড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন ইউটিউব চ্যানেলে। ৪০মিনিট ২৩ সেকেন্ড দৈর্ঘ্যের এ নাটকের শুরুতেই সতর্ক বার্তা দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘এই গল্পে ব্যবহৃত সমস্ত স্থান এবং চরিত্র সম্পূর্ণ কাল্পনিক। জীবিত কিংবা মৃত কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের সাথে কোনো প্রকার ঘটনা আংশিক বা পুরোপুরি মিল থাকলে তা সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত ও কাকতালীয়। এমন অনিচ্ছাকৃত মিলের জন্যে কর্তৃপক্ষ কোনভাবেই দায়ী নয়।’
নাটকের গল্প আবর্তিত হয়েছে চিত্রশিল্পী সৌরভকে ঘিরে, যিনি শৈশবে একটি ট্রেন দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যান। তবে ওই ঘটনায় তিনি মা কে হারান। এরপর সৌরভ বড় হন শিশু সদনে। এক পর্যায়ে খ্যাতি পান পোর্ট্রেট শিল্পী হিসেবে। নাটকের নায়িকা রিমঝিমেরও পোর্ট্রেট আঁকেন তিনি।
নাটকে রিমঝিমের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন সামিরা খান মাহি। নিজের পোর্ট্রেট দেখে মুগ্ধ রিমঝিম শিল্পীকে খুঁজে বের করেন, কিন্তু মেয়েলি পোশাকে সৌরভকে দেখে ধাক্কা খান।
ওই বৈপরিত্যের পরও সৌরভের প্রেমে পড়েন রিমঝিম। তার পরিবার থেকে বিয়ের প্রস্তাব যায় সৌরভের কাছে। কিন্তু সৌরভ ‘না’ বলে দেন।
নাটকে দেখানো হয়, সৌরভ হরমোনজনিত এক বিরল জটিলতায় ভুগছেন। একজন চিকিৎসককে দিয়ে বলানো হয়, সৌরভ ডিএসডি (ডিজঅর্ডার অব সেক্স ডেভেলপমেন্ট) নামের এক জটিলতায় আক্রান্ত। জিনগতভবে তিনি একজন মেয়ে হলেও ওই জটিলতার কারণে শুরুতে তার মেয়েলি হরমোন বিকশিত হয়নি। সে কারণে তিনি দেখতে পুরুষের মত। কিন্তু পরে মেয়েলি হরমোন বিকশিত হওয়ায় তার মধ্যে মেয়েলি বৈশিষ্ট্যও বিকশিত হয়।
পক্ষে-বিপক্ষে
সোশাল একটি অংশের অভিযোগ, এই নাটকের মাধ্যমে দেশে ‘ট্রান্সজেন্ডার সংস্কৃতি’র প্রচার করা হচ্ছে। সে কারণে ফারহান আহমেদ জোভান, রাফাত মজুমদার রিংকু ও ওয়ালটনকে বয়কটের ঘোষণা দিচ্ছেন তারা।
কিন্তু এই সমালোচনার কারণ বুঝতে পারছেন না রাফাত মজুমদার রিংকু। তার ভাষ্য, কোনো এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য বা কোনো ধর্ম বা ব্যক্তিকে ছোট করে এই নাটক নির্মাণ করা হয়নি।
“রূপান্তর নাটকটি একটি কাল্পনিক চরিত্রের গল্প। আমরা একটা ভিন্ন ধরনের গল্প পেয়েছি, যেখানে জোভান শুধুমাত্র গল্পটার একটি চরিত্র আর আমি নির্মাতা হিসেবে একটা চরিত্র নির্মাণ করেছি। একজন মানুষের গল্প বলতে চেয়েছি।
“এ ধরনের ঘটনা কিন্তু আমাদের চারপাশে ঘটে। হরমোনাল পরিবর্তন এই ব্যাপারটা তো মিথ্যা না৷ এটা সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক। সৃষ্টিকর্তার কাউকে এরকম বানালে কারো কিছু করার আছে? কারো কী ক্ষমতা আছে সেটা নিয়ে কথা বলার? আমি শুধু হরমোনাল এই পরিবর্তন নিয়ে নাটক নির্মাণ করেছি।”
নির্মাতা বলেন, “নাটকটি ইউটিউব থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে, প্রযোজকরা নামানোর কারণ বলেননি। আমি যখন জানতে চাইলাম, কেন নামান হল… তখন বলা হল বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠানের চাপে নামানো হয়েছে। যারা শিক্ষিত, এ বিষয়টি বুঝে তারা নাটকের পক্ষে। নাটকটি মুক্তির পর খুব ভালো সাড়া পাচ্ছিল। অনেকে নাটকটি না দেখেই অপপ্রচার চালাচ্ছে। ”
নাটক সরিয়ে ফেলার বিষয়ে প্রয়োজনা প্রতিষ্ঠান একান্ন মিডিয়া আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য দেয়নি। নাটকটির ক্রিয়েটিভ প্রোডিউসার রাসেল আজমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তিনি পরে কথা বলবেন বলে এড়িয়ে যান।
সমালোচনার জেরে এক বিবৃতিতে নাটকটির স্পনসর কোম্পানি ওয়ালটন দুঃখ প্রকাশ করে বলেছে, নাটকের বিষয়বস্তু সম্পর্কে তাদের অবহিত না করেই ওয়ালটনকে স্পনসর করেছে বিজ্ঞাপনী সংস্থা।
এ কারণে উকিল নোটিস পাঠানোর পাশাপাশি বিজ্ঞাপনী সংস্থা ‘লোকাল বাস এন্টারটেইনমেন্ট’ এর সঙ্গে চুক্তি বাতিল করার কথাও ওয়ালটন বলেছে। তবে এ বিষয়ে ‘লোকাল বাস এন্টারটেইনমেন্ট’ এর বক্তব্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম জানতে পারেনি।
নাটকটি ইউটিউব চ্যানেল থেকে সরিয়ে ফেলার সমালোচনা করে অভিনয় শিল্পী সংঘের সভাপতি আহসান হাবিব নাসিম গ্লিটজকে বলেন, “‘আমরা অভিনয় শিল্পী সংঘ থেকে বিষয়টি নিয়ে বসেছি, আলোচনা করেছি। নাটকটি আমরা দেখে যেটা বিশ্লেষণ করেছি, সেটা হল এটা কোনো রাষ্ট্রবিরোধী কাজ না। কোনো শ্রেণিকে হেয় করা হয়নি, কোনো বিশেষ শ্রেণিকে প্রমোট করা হয়নি।
“এটা সমাজের বিশেষ একটি শ্রেণির গল্প বলা হয়েছে। নাটক, সিনেমা তো সমাজের সব বিষয় নিয়েই নির্মিত হয়। এটা বিশেষ মানুষকে নিয়ে নির্মিত হয়েছে এটা ক্ষতির কিছু না।”
শিল্পী ও নির্মাতার ‘পাশে থাকার’ ঘোষণা দিয়ে নাসিম বলেন, “যারা এসব সমালোচনা করে তারা সবসময় বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে এভাবে প্রতিবন্ধকতার মধ্যে ফেলতে চায়। আমরা তীব্রভাবে এটার নিন্দা জানিয়েছি। এ ধরনের গল্প নির্মাণ অপরাধ না। আমাদের সমাজে এমন অনেক ছেলে আছে যারা নিজেকে মেয়ে ফিল করে। তাদের এ সমাজে বেঁচে থাকার অধিকার আছে, সমাজের সকল সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করার অধিকার আছে। আমরা মনে করি সমাজের জন্য এটা প্রয়োজনীয় একটা গল্প। আমরা এটার শিল্পী, নির্মাতার পক্ষে আছি।”
ইউটিউবে আবারও নাটকটি মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে শিল্পী সংঘের সভাপতি বলেন, “এই গল্পটা দর্শকের দেখা উচিত। আমরা প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানকে বলেছি নাটকটি আবারও আপলোড করা হোক। অনেকেই এটার পক্ষে লিখছে। ১৮ কোটি মানুষের মধ্যে ৫০ হাজার মানুষের মন্তব্য একটি নাটকের মানদণ্ড হতে পারে না। নাটকটি আবারও আপলোড হওয়ার কথা যদি না হয় আমরা এটি নিয়ে অবশ্যই চাপ দেব।”