‘জয় বাংলা কনসার্ট’ ফিরল তারুণ্যের উচ্ছ্বাস নিয়ে

বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণকে স্মরণ করে ইয়াং বাংলার নিয়মিত আয়োজন এই জয় বাংলা কনসার্ট।

শাহরিয়ার নোবেলবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 March 2023, 06:06 PM
Updated : 8 March 2023, 06:06 PM

বাংলা ব্যান্ডের তালে তারুণ্যের চিত্ত জেগে উঠল আর্মি স্টেডিয়ামের সবুজ মাঠে, হাজারো তরুণের উচ্ছ্বাসে ধ্বনিত হল সময়ের লাগাম ধরে সামনে বাড়ার প্রতিশ্রুতি। মহামারীর দাপট পেছনে ফেলে দুই বছর পর ফিরল জয় বাংলা কনসার্ট।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষণকে স্মরণ করে তরুণদের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে ২০১৫ সাল থেকে ইয়াং বাংলার নিয়মিত আয়োজন এই জয় বাংলা কনসার্ট। করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে গত দুই বছর আর্মি স্টেডিয়ামে তারুণ্যের এই উচ্ছ্বাস দেখা যায়নি।

চলতি বছরে শবে বরাতের কারণে একদিন পিছিয়ে ৮ মার্চ বুধবার হল জয় বাংলা কনসার্ট। দিনটি ছিল আন্তর্জাতিক নারী দিবস। তাই নারীদের কনসার্টে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে ‘ইয়াং বাংলা’ ফেইসবুক পেইজে আলাদা নিবন্ধনও চালু করে। তাতে সাড়াও মেলে। কনসার্টে নারীদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। নারীদের জন্য করা হয় আলাদা কর্নারও।

ফার্মগেইট থেকে কনসার্টে যোগ দেওয়া ফাহিমা তাজরিন আভিজা বলেন, “দেশের স্বাধীনতার উচ্ছ্বাসের এই আয়োজনে নারীদের এই অংশগ্রহণই প্রমাণ করে নারী কতটা এগিয়ে যাচ্ছে।”

দুবছর পর আর্মি স্টেমিয়ামে তারুণ্যের উচ্ছ্বাসে মাততে মাহফুজুর রহমান রোকন বন্ধুদের সঙ্গে আসেন জয় বাংলা কনসার্টে। তিনি বলেন, “ভীষণ উপভোগ করছি। সবার সঙ্গেই নারীবন্ধু আছে। এখানে নিরাপত্তাও দারুণ। খুব ভালো লাগছে।”

এদিন জড়ো হওয়া তারুণ্যকে উদ্বেল করে বাংলা ব্যান্ডগুলো। তাদের কণ্ঠে ওঠে একাত্তরের রণাঙ্গনে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিহরণ জাগানিয়া গান। এসব গানের সাথে নতুন প্রজন্মের পছন্দের রক মিউজিকের তাল তারুণ্যকে স্মরণ করিয়েছে একাত্তরের সেই দিনগুলোর কথা।

মিরপুর থেকে আসা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী দেবব্রত রায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের বাংলা ব্যান্ডের সুনাম সারাবিশ্বে। ঐতিহাসিক ৭ মার্চ স্মরণে এই কনসার্টে তারা যখন স্বাধীনতার গানগুলো গায়, তখন আমাদের মধ্যে একটা আন্দোলন তৈরি হয়। দেশপ্রেমের একটা অনুপ্রেরণা আমরা পাই। ভীষণ এনার্জিটিক লাগছে।”

ঢাকার সিদ্দিক বাজারে বিস্ফোরণে নিহতদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় এবারের ‘জয় বাংলা কনসার্ট। একে একে পরিবেশনা নিয়ে আসে অ্যাভয়েড রাফা, ক্রিপটিক ফেইট, আর্টসেল, চিরকুট, নেমেসিস, লালন, আরেকটা রক ব্যান্ড, মেঘদল ও কার্নিভাল।

বিকাল ৩টার দিকে আলী মহসিন রেজার লেখা ও খাদেমুল ইসলাম বসুনিয়ার সুর করা স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রের গান ‘আমারই দেশ সব মানুষের’ গান নিয়ে মঞ্চে আসে ‘আরেকটা রক ব্যান্ড’। এরই মধ্যে দিয়ে বেজে ওঠে এবারে জয় বাংলা কনসার্টের ড্রামস। এই গানের পর তার গায় নিজেদের গান ‘তাসের প্রাসাদ’ ও ‘ঘুম পাড়ানোর গান’। ‘সব কটা জানালা খুলে দাও না’ গান দিয়ে পরিবেশনা শুরু করে কার্নিভাল। শোনায় ‘ভ্রম’, ‘আমার সত্য’ ও ‘সেইসব দিনরাত্রি’ গানগুলো।

কার্নিভালের পরপর মঞ্চে ওঠে মেঘদল। মুক্তির মন্দির সোপান তলে দিয়ে শুরু করে একে একে শোনায় ‘এসো আমার শহরে’, ‘চার চার চৌকো জানালায়’, ‘নির্বাণ’ শেষে নতুন গান ‘হাওয়ায়’ ভাসায় জনস্রোতকে।

তাদের পরপর স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের গান ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’ গেয়ে শুরু করে লালন ব্যান্ড। শোনায় ‘সময় গেলে সাধন হবে না’, ‘এক চোখেতে হাসন কান্দে’, ‘রুহানি’, ‘ভবের পাগল’ গানগুলো।

সূর্য যখন হেলে পড়েছে পশ্চিমে তখন মঞ্চে আসে হেভি মেটাল ব্যান্ড ‘ক্রিপটিক ফেইট’। তাদের কণ্ঠে তখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিহরণ জাগানিয়া গান ‘তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেব রে’। ঠিক সেই সময় জয় বাংলা কনসার্ট দেখতে আর্মি স্টেডিয়ামে পৌঁছান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

কাতারের দোহায় স্বল্পোন্নত দেশগুলোর পঞ্চম জাতিসংঘ সম্মেলনে যোগদান শেষে বুধবার বিকালেই ঢাকা ফেরেন প্রধানমন্ত্রী। এরপর সন্ধ্যায় যোগ দেন জয়বাংলা কনসার্টে।

সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এসএম শফিউদ্দিন আহমেদ এবং বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের (সিআরআই) ট্রাস্টি রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন। ভিআইপি বক্স থেকে হাত নেড়ে স্টেডিয়ামে উপস্থিত তারুণ্যের প্রতি শুভেচ্ছা জানান প্রধানমন্ত্রী।

Also Read: জয় বাংলা কনসার্টে প্রধানমন্ত্রী

মঞ্চ তখন কাঁপছে হেভি মেটাল মিউজিকে। ক্রিপটিক ফেইটের ‘ভোরের অপেক্ষা’, ‘রাতের শেষ’, ‘রং’, ‘প্রতিবাদ’, ‘ভবঘুরে’ ও ‘আক্রমণ’ গানগুলোর তালে ততক্ষণে মেতে ওঠেছে তরুণরা।

পরিবেশনা শেষে ক্রিপটিক ফেইটের লিড ভোকাল সাকিব চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা ভাগ্যবান যে প্রতিবার এই মঞ্চে উঠতে পারি। শেখ মুজিবের ভাষণ খুব পাওয়ারফুল, যা সবসময় আমাদের রক মিউজিকের যে শক্তি, সেটাকেও অনুপ্রেরণা দেয়। ফলে সাতই মার্চের আয়োজনে আমরা আসতে চাই। এটা একটা উৎসব। অন্যান্য শো এর চাইতে এই শো তে উঠতে পারা এখানে যারা পারফর্ম করে তাদের সবার জন্যেই গর্বের।”

ব্যান্ডদলগুলোর পারফরম্যান্সের পাশাপাশি আর্মি স্টেডিয়ামের মঞ্চে বড় পর্দায় দেখানো হয় বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে নির্মিত বিশেষ প্রামাণ্যচিত্র। সেই ভাষণের আগে দেশাত্মবোধক গানের সঙ্গে নৃত্য নিয়ে মঞ্চে আসেন নৃত্যশিল্পীরা।

ঢাকার পাশের জেলা নারয়ণগঞ্জ থেকে আসা রোদিতা ইসলাম বলেন, “ভীষণ উপভোগ করছি। দারুণ লাইনআপ। একদিকে আমরা যেমন আনন্দ করছি। তেমনি স্ক্রিনে আমরা শেখ মুজিবের ভাষণ দেখছি, আগামীর তারুণ্যের নানা সমৃদ্ধিশীল কাজের ডকুমেন্টারিও দেখাচ্ছে, এটা দারুণ। যুদ্ধদিনের সেই গানগুলোর আজ শুনতে পারছি, এটা অন্যরকম অনুভূতি।”

স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের আরেক গান ‘মাগো ভাবনা কেন’ নিয়ে মঞ্চে আসে নেমেসিস। আর্মি স্টেডিয়াম তখন কানায় কানায় ভরে গেছে। নেমেসিসের ‘জানালা’, ‘কোনোদিন’, ‘বীর’, ‘অবচেতন’, ‘গণজোয়ার’ ও ‘কবে’ গানগুলোর তালে নেচে গেয়ে মেতে ওঠেছে তারুণ্য ।

নেমেসিস মঞ্চ ছাড়ার পর অপেক্ষা তখন চিরকুট আর আর্টসেলের। মঞ্চ অন্ধকার। চলছে সাউন্ডচেক, খানিক বাদেই চারদিক ভরে উঠলো আলোর ঝলকানিতে। মঞ্চে দেখা গেলো চিরকুটকে। নানান আলোর মঞ্চে তারা গাইল “বিচ্ছুরণের আলোয় যখন দ্বিগুণ হারে জ্বলছো, এই পৃথিবীর কোথাও তুমি বাংলার কথা বলছো”, চিরকুটের ভোকাল সুমি পেছন থেকে ভোকাল দেওয়া একদল তরুণ-তরুণীর মধ্য থেকে সামনে নিয়ে এলেন অং চাকমাকে, তাকে সঙ্গে নিয়ে গাইলেন ‘জাদুর শহর’, দিলেন বৈচিত্র্যের বাংলাদেশের বার্তা। না বুঝি দুনিয়া, কানামাছির মতো সিনেমার প্লে ব্যাকগুলোর তালে মাতালেন সবাইকে।

কনসার্টে সবার পরে মঞ্চে ওঠে আর্টসেল। নিজেদের গানের আগে তারা জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবিতা কাণ্ডারী হুঁশিয়ারকে গানে রূপ দেয়া পরিবেশনাকে আবার নিয়ে আসে জয় বাংলা কনসার্টের মঞ্চে। বিদ্রোহের সেই পঙক্তি আর হেভি মেটালের বাজনা তারুণ্যকে করে তোলে আন্দোলিত, গানের তালে চিৎকার করে দেশ আর বাংলা ব্যান্ডের প্রতি ভালবাসা জানায় তরুণ প্রজন্ম।