জেমস ক্যামেরন: এক ‘সাহসী’ চলচ্চিত্র নির্মাতা

ক্যামেরনকে কৃতিত্ব দেওয়া হয় যে তিনি প্রায় একক প্রচেষ্টায় হলিউডের মৃতপ্রায় সায়েন্স ফিকশনধর্মী চলচ্চিত্র ধারাকে নতুন জীবন দিয়েছেন।

গ্লিটজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 August 2022, 03:32 AM
Updated : 16 August 2022, 03:32 AM

চলচ্চিত্র সমালোচনাকারী ওয়েবসাইট রোটেনটম্যাটোস তাকে আখ্যা দিয়েছে একজন ‘সাহসী পরিচালক’ হিসেবে। সিনেমা নির্মাণের স্বপ্ন পূরণে তিনি প্রযুক্তি উদ্ভাবনের পথে হাঁটতেও পিছপা হননি, হয়েছেন মামলার মুখোমুখি।

হলিউডে একের পর এক ‘ব্লকবাস্টার হিট’ সিনেমা উপহার দেওয়া এই নির্মাতার সিনেমা বক্স অফিসে মুখ থুবড়েও পড়েছে। তবে সিনেমা নির্মাণ নিয়ে তার উচ্চাভিলাষকে দমাতে পারেনি।

জেমস ফ্রান্সিস ক্যামেরন একজন কিংবদন্তি চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে জীবদ্দশায়ই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন। মঙ্গলবার ৬৮তম জন্মবার্ষিকী পালন করছেন তিনি।

১৯৫৪ সালের ১৬ আগস্ট কানাডার অন্টারিও প্রদেশের কাপুসকাসিংয়ে জন্মগ্রহণ করেন ক্যামেরন। বাবা ফিলিপ ক্যামেরন ছিলেন ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার এবং মা শার্লি ছিলেন একাধারে চিত্রশিল্পী ও নার্স। স্কটল্যান্ডের শেকড়ধারী এই পরিবারের পাঁচ সন্তানের মধ্যে বড় ছিলেন ক্যামেরন।

তার বয়স যখন ১৭ বছর, ক্যামেরনের পরিবার কানাডা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় চলে যায়। সেখানে পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে পড়ার স্বপ্ন নিয়ে ১৯৭৩ সালে কমিউনিটি কলেজ ‘ফুলারটন কলেজ’-এ ভর্তি হন। ভালো না লাগায় পদার্থবিজ্ঞান ছেড়ে ইংরেজি সাহিত্য পড়তে শুরু করেন। ১৯৭৪ সালে কলেজ ছেড়ে দেন।

শুরু করেন ‘অড জব’। ট্রাক চালনা শেখেন এবং ট্রাক ড্রাইভার হিসেবে জীবিকা নির্বাহ শুরু করেন।

কিন্তু ১৯৭৭ সালে ‘স্টার ওয়ারস’ সিনেমা তার জীবনের বাঁক বদলে দেয়। ওই সিনেমা দেখার পরই রুপালি পর্দায় নিজের নাম লেখাতে উদগ্রীব হয়ে ওঠেন তরুণ ক্যামেরন। ট্রাকচালকের ক্যারিয়ার ছেড়ে প্রবেশ করেন চলচ্চিত্রের মায়াবী জগতে।

অবশ্য অস্থিরতার ওই সময়ে অপটিক্যাল প্রিন্টিং, ফ্রন্ট স্ক্রিন প্রজেকশন, ডাই ট্রান্সফার এবং চলচ্চিত্র প্রযুক্তির সঙ্গে সম্পর্কিত অনেক কিছুই শিখেছেন প্রবল আগ্রহভরে। তার সহপাঠীদের ভাষ্যে, ক্যামেরন খেলাধুলা তেমন একটা উপভোগ করতেন না। তবে এমন কিছু উপভোগ করতেন ‘যা হয় মাথার ওপর দিয়ে যায়, অথবা মাটির গভীর দিয়ে যায়।’

রটেনটম্যাটোস লিখেছে, ‘এলিয়েনস’, ‘টারমিনেটর’, ‘অ্যাভাটার’-এর নির্মাতা ক্যামেরনকে কৃতিত্ব দেওয়া হয় যে তিনি প্রায় একক প্রচেষ্টায় হলিউডের মৃতপ্রায় সায়েন্স ফিকশনধর্মী চলচ্চিত্র ধারাকে পুনরুজ্জীবিত করেছেন।

চলচ্চিত্র জগতে পথচলা

পরিচালক হিসেবে জেমস ক্যামেরনের ক্যারিয়ারের শুরু বলা যায় ১৯৭৮ সালে। দন্ত চিকিৎসকদের একটি সংস্থা থেকে টাকা ধার করে তার এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে নির্মাণ করেন স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘জেনোজেনেসিস’।

এরপর তিনি ‘রক অ্যান্ড রোল হাই স্কুল (১৯৭৯)’ এর প্রযোজনা সহকারী হিসেবে কাজ করেন। চলচিত্র নির্মাণের কলাকৌশল শেখার এই অভিযাত্রায় রজার কোরম্যান স্টুডিওতে ‘মিনিয়েচার মডেল’ নির্মাতা হিসেবে চাকরি শুরু করেন। ১৯৮২ পর্যন্ত শিল্প নির্দেশক, বিশেষ দৃশ্য ধারণ সহকারী, প্রডাকশন ডিজাইনারসহ বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত ছিলেন তিনি।

প্রযোজক ওভিডিও অ্যাসোনাইটিসের সঙ্গে সৃজনশীল মতপার্থক্যের জন্য পরিচালক মিলার ড্রেইক ‘পিরানহা টু: দ্য স্পনিং’ চলচ্চিত্র থেকে সরে দাঁড়ানোয় ১৯৭৮ সালে প্রথম একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা পরিচালনার সুযোগ পান ক্যামেরন ক্যামেরন। যদিও পরে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘পিরানহা টু’-কে তিনি নিজের প্রথম সিনেমা হিসেবে মেনে নিতে পারেন না। এটা বরং অনেক বেশি অ্যাসোনাইটিসের সিনেমা।

টার্মিনেটর

জন কার্পেন্টারের হরর সিনেমা ‘হ্যালোইন (১৯৮২)’ তাকে অনুপ্রাণিত করে সাই-ফাই অ্যাকশন চলচিত্র ‘দ্য টার্মিনেটর (১৯৮৪)’ নির্মাণে। সাবেক স্ত্রী, সহকর্মী এবং প্যাসিফিক ওয়েস্টার্ন প্রোডাকশনের প্রতিষ্ঠাতা গ্যাল অ্যান হার্ড ক্যামেরনের চলচিত্রটি পরিচালনা করার শর্তে এক ডলারের বিনিময়ে স্ক্রিপ্টটি কিনে নেন।

ক্যামেরনের পরিচালনা এবং হার্ডের প্রযোজনায় হেমডেল পিকচার্স চলচিত্রটি নির্মাণ করে। আর এই সিনেমার মধ্যে দিয়েই রূপালী পর্দায় আরেক হলিউড তারকা আরনলড শোয়ার্জনেগারের সঙ্গে জুটি গড়ে ওঠে ক্যামেরনের।

ডিস্ট্রিবিউশন হাউজ ওরিয়ন পিকচার্সের ‘টার্মিনেটর’ ছিল বক্স অফিস হিট যা বিশ্বব্যাপী আয় করে ৭৮ মিলিয়ন ডলারের বেশি।

২০০৮ সালে চলচিত্রটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘ন্যাশনাল ফিল্ম রেজিস্ট্রি’-তে সংরক্ষনের জন্য নির্বাচিত হয়। গুনী এই পরিচালকের প্রশংসায় বিবিসি-এর জর্জ পেরি লেখেন,‘ক্যামেরন যেমন দারুনভাবে অ্যাকশন এবং বিদ্রুপাত্মক কৌতুকের মেলবন্ধন করতে পারে তেমনি যেকোন মুহূর্তে সন্ত্রাস হামলার ইঙ্গিত দিতে পিছপা হন না।’

‘দ্য টার্মিনেটর’-এর ব্যাপক সাফল্যের পর এর সিক্যুয়াল নির্মাণের অ্যালোচনা শুরু হয়। ‘টার্মিনেটর ২: জাজমেন্ট ডে’ ১৯৯১ সালে মুক্তি পায়। এই চলচ্চিত্রটিও ছিল ‘বক্স অফিস হিট’, যা চারটি অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড অর্জনের পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী আয় করে ৩০ কোটি ডলারের বেশি।

টাইটানিক

কিংবদন্তী এই পরিচালক পরবর্তীতে হাত দেন ওই সময়ের সবচেয়ে ব্যয়বহুল সিনেমা ‘টাইটানিক’ এর নির্মাণ কাজে। চলচ্চিত্রে ব্যবহারের জন্য টাইটানিক জাহাজের ধ্বংসস্তুপের ফুটেজ ধারণ করতে ১৯৯৫ সালে আটলান্টিক মহাসাগরের তলদেশে বেশ কয়েকবার ডুব দেন ক্যামেরন।

রোজারি বিচে তৈরি হয় জাহাজের প্রতিরূপ, প্রধান ফটোগ্রাফি শুরু হয় ১৯৯৬-এ। চলচিত্রটি মুক্তির আগেই ‘ওভার বাজেট’-এর তকমা পায়। লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিও এবং কেট উইনসলেট জুটির এই সিনেমা মুক্তি পায় ১৯৯৭ সালে এবং জিতে নেয় ১১টি অস্কার। দর্শক থেকে শুরু করে সমালোচক মহলে তুমুল প্রশংসা পাওয়া সিনেমাটি টানা এক যুগ ইতিহাসে সর্বোচ্চ উপার্জনকারী চলচ্চিত্রের আসনটি ধরে রাখে।

২০১৭ সালে নির্মাণের ২০ বছর পূর্তিতে ‘টাইটানিক’ হয়ে হয়ে ক্যামেরনের দ্বিতীয় চলচিত্র যা যুক্তরাষ্ট্রের ‘ন্যাশনাল ফিল্ম রেজিস্ট্রি’-তে সংরক্ষণের জন্য নির্বাচিত হয়। ওই বছরই স্টিফেন কামিংস নামের এক ব্যক্তি ক্যামেরনের বিরুদ্ধে মামলা করেন যে ক্যামেরন তার পরিবারের গল্প চুরি করে ‘টাইটানিক’ নির্মাণ করেছেন। অবশ্য মামলার পরবর্তী কার্যক্রম আর এগোয়নি।

অ্যাভাটার

‘অ্যাভাটার’ প্রকল্প নিয়ে ক্যামেরন কাজ শুরু করেন ১৯৯৫ সালে। কিন্তু প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতার কারণে এক যুগের বেশি সময় অপেক্ষায় থাকতে হয় তাকে। অবশেষে ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে মুক্তি পাওয়া এই সিনেমা আবারও তাক লাগিয়ে দেয় বিশ্বকে।

প্রথম থ্রি-ডি প্রযুক্তিতে নির্মিত এই চলচ্চিত্র বিশ্বব্যাপী আয় করে ২৭৪ কোটি ডলারের বেশি এবং ‘টাইটানিক’-কে ছাড়িয়ে হয়ে যায় সর্বকালের সর্বোচ্চ উপার্জনকারী চলচ্চিত্র। তিনটি অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডস অর্জন করা এই সিনেমার বর্ধিত অংশ নিয়ে ২০১০ সালে আবার মুক্তি দেওয়া হয় চলচিত্রটি যা ছিল বক্স অফিস হিট।

২০২০ সাল পর্যন্ত যে পাঁচটি সিনেমা বিশ্বজুড়ে ২০০ কোটি ডলারের বেশি আয় করেছে তার দুটি - ‘টাইটানিক’ ও ‘অ্যাভাটার’ জেমস ক্যামেরনের সিনেমা।

ক্যামেরনের অন্যান্য অভিযান

‘টাইটানিক’ এর সাফল্যের পর ক্যামেরন তথ্যচিত্র নির্মাণে ঝুঁকে পড়েন। এরআগে ২০০০ সালে তিনি টেলিভিশন জগতে পা রাখেন। ২০০২ সালে স্টিভেন স্পিলবার্গ নির্মিত ‘সোলারিস’ সিনেমার প্রযোজকও ছিলেন ক্যামেরন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জার্মানির রণতরী বিসমার্কের ওপর ‘এক্সপেডিশন: বিসমার্ক’ তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন। তার পরের বছর টাইটানিক জাহাজের ওপর নির্মাণ করেন ‘ঘোস্টস অব দ্য অ্যাবিস’।

এছাড়া ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে ১৯৮৪ সালে হলিউড সুপারস্টার সিলভেস্টার স্ট্যালোনের সঙ্গে বসে রচনা করেন ‘র‍্যাম্বো: ফার্স্ট ব্লাড পার্ট ২’-এর চিত্রনাট্য। ১৯৮৬ সালে পরিচালনা করেন সাইন্স ফিকশন হরর ‘এলিয়েন’-এর সিক্যুয়াল ‘এলিয়েনস’ যা বিশ্বব্যাপী আয় করে ১৩০ মিলিয়ন ডলারের বেশি।

১৯৯০ সালে তিনি লরেন্স কাসানোফকে সঙ্গে নিয়ে ‘লাইটস্টর্ম এন্টারটেইনমেন্ট’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং পরের বছর ‘পয়েন্ট ব্রেক’-এর নির্বাহী প্রযোজক ছিলেন। ১৯৯৩ সালে ভিজ্যুয়াল ইফেক্ট প্রোডাকশন কোম্পানি ‘ডিজিটাল ডোমেইন’ এর সহপ্রতিষ্ঠাতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।

১৯৯৮ সালে তিনি এবং তার ভাই ‘আর্থশিপ প্রোডাকশন’ কোম্পানি গঠন করেন যা গভীর সমুদ্রে ডকুমেন্টারি স্ট্রিমিংয়ের অনুমতি পায়।

সমুদ্রের তলদেশের প্রতি প্রবল আকর্ষণ রয়েছে ন্যাশনাল জিওগ্রাফির ‘সি এক্সপ্লোরার’ ক্যামেরনের। তিনি সমুদ্র তলদেশ নিয়ে অসংখ্য ডকুমেন্টারি নির্মাণ করেছেন।

জেমস ক্যামেরন প্রথম একক ডুবুরি হিসেবে পৃথিবীর গভীরতম স্থান প্রশান্ত মহাসাগরের মারিয়ানা ট্রেঞ্চে পৌঁছানোর অনন্য রেকর্ড গড়েন ২০১২ সালে।

ব্যক্তি জীবনে পাঁচ বার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া ক্যামেরনের প্রথম চারটি বিয়ের মেয়াদ ছিল দুই থেকে ছয় বছর করে। তিনি ২০০০ সালে স্যুজি এমিসেকে বিয়ে করেন। তারা এখনও একসঙ্গে রয়েছেন এবং এই দম্পতি এক ছেলে ও দুই মেয়ের জনক। ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে থেকে পাট চুকিয়ে নিউ জিল্যান্ডে স্থায়ী হয়েছেন ক্যামেরন। সেখানে তিনি জৈব পদ্ধতিদে চাষাবাদ নিয়ে মেতেছেন।

জেমস ক্যামেরন নাসার উপদেষ্টা পরিষদ এবং মঙ্গল গ্রহ-কেন্দ্রিক ‘মার্স সোসাইটি’রও সদস্য। নাসার সঙ্গে মিলে তিনি ক্যামেরা তৈরির কাজ করেছিলেন যা মঙ্গল গ্রহে পাঠানোর কথা ছিল। পরীক্ষার সময় স্বল্পতার কারণে ‘কিওরিওসিটি রোভার’টি ক্যামেরনের প্রযুক্তি ছাড়াই পাঠানো হয়।

২০১০ সালে টাইম ম্যাগাজিন প্রকাশিত বিশ্বের প্রভাবশালী ১০০ ব্যাক্তির তালিকায় নাম ছিলো জেমস ক্যামেরনের।