অ্যাবার সদস্যরা কল্পনাও করতে পারেননি, তাদের গান ‘চিকিতিতা’ সামাজিক সঙ্কট মোকাবেলার হাতিয়ার হয়ে উঠবে।
Published : 04 Jan 2023, 09:15 AM
সুইডিশ গানের দল ‘অ্যাবা’র একটি সুপারহিট অ্যালবাম চার দশকে বিক্রি হয়েছে লাখ লাখ কপি, অথচ সেখান থেকে একটি পয়সাও নেননি এর শিল্পীরা।
এর কারণ, ‘চিকিতিতা’ অ্যালবামের কপিরাইট তারা দিয়ে দিয়েছেন ইউনিসেফকে।
অ্যাবার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য বিয়র্ন ওলভিউস বিবিসিকে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “গত কয়েক বছরে চিকিতিতার প্রচুর স্ট্রিমিং হয়েছে, প্রচুর রেকর্ডও বিক্রি হয়েছে। আমি খুব খুশি।”
‘চিকিতিতা, টেল মি হোয়াটস রং’ গানটি ব্যাপক আলোড়ন তোলে সত্তরের দশকে। এছাড়া অ্যাবার ‘ওয়াটর লু’. ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’, ‘টেইক ইট ইজি’ গানের সঙ্গেও পরিচিত সংগীতপ্রেমীরা।
‘চিকিতিতা’ ইউনিসেফের শিশু বছরের জন্য লেখা অ্যাবার গান, স্প্যানিশ ভাষায় শব্দটির মানে ছোট্ট মেয়ে। এটাই স্প্যানিশ ভাষার পপ দলটির প্রথম গান।
গানটি প্রকাশের পরপরই এর লিরিক-সুরের জাদুতে মোহাচ্ছন্ন হয় লাতিন আমেরিকার মানুষ। বিয়র্ন ওলভিউস জানান, শুরু থেকেই তারা স্পষ্ট করেছেন, গানের রয়্যালটির অর্থ কী কাজে তারা ব্যবহার করতে চান।
“আমি মনে করি, পৃথিবীতে সবচেয়ে জরুরিভিত্তিতে যে কাজটা করা দরকার, কা হল মেয়ে আর নারীদের ক্ষমতায়ন। এটা করা সম্ভব হলে বদলে যাবে গোটা বিশ্ব।
“কিন্তু দুঃখজনক হল বিশ্বজুড়ে অনেক সংস্কৃতি আর ধর্ম আছে, যারা মেয়েদের পুরুষদের সমান সুযোগ দেয় না। তাই আমরা প্রথম দিকে ইউনিসেফকে বলেছিলাম, আমাদের উপার্জিত অর্থ আমরা তাদেরই দিতে চাই।”
গুয়াতেমালার দরিদ্রতম অঞ্চল আল্টা ভেরাপাসের লা টিনটা শহরের একটি হলে আদিবাসী মেয়েদের একটি দল ‘চিকিতিতা’ গানটি মায়া ভাষায় অনুবাদ করে বিভিন্ন পালা পার্বনে গেয়ে থাকে।
অ্যাবার গানের তহবিল ব্যবহার হয় অ্যাসোসিয়েশন অব ফ্রেন্ডস অব ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড পিস (এডিপি) এর স্বাস্থ্য এবং মানসিক কর্মশালায়। মেয়েদের স্বাস্থ্যসেবা ও উন্নয়নে কাজ করে গুয়াতেমালার অন্যতম পুরনো এ এনজিও।
মধ্য আমেরিকার এই দেশে প্রজনন স্বাস্থ্য শিক্ষার ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে, বিশেষ করে আদিবাসীদের মধ্যে সে সমস্যা প্রকট। আল্টা ভেরাপাস এলাকায় ১৪ বছর বয়সী ৩৪৬ জন কিশোরী মা হয়েছে গত বছর। এছাড়া ১৬ বছর বয়সী কিশোরী মায়ের সংখ্যাও কম নয় ওই অঞ্চলে।
তাদেরই মধ্যে একজন কিশোরী মা এমা (ছদ্মনাম), যে এডিপির মাধ্যমে নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে আসছে। এই কিশোরী মায়ের কপালে গৃহ নির্যাতন তো জুটেইছে, ধর্ষণেরও শিকার হয়েছে সে।
এডিপি সমাজে নারী সহিংসতা রোধেও কাজ করে। আর এসব কাজে অর্থায়ন হয় অ্যাবার ‘চিকিতিতা’র তহবিল থেকে।
এমা বলেন “আমি মানসিক নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে অনেক কিছু শিখেছি। এখন নিজেকে আগের চাইতে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী মনে হয়। আমার বাচ্চার যত্ন নেওয়াও এখান থেকে শিখেছি আমি।”
এমার এই কষ্টের গল্প আল্টা ভেরাপাসের নারীদের জন্য নতুন কিছু নয়। সেখানে নিপীড়নের শিকার হতে হয় বহু মেয়েকেই। এমার ছোট বোনও যৌন নির্যাতনের শিকার এক কিশোরী মা।
এডিপির শিশু মনোবিজ্ঞানী লেসলি পু সোটো বলেন, “পুরুষতান্ত্রিক নিপীড়ন যেন মায়া সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে আছে। এখানকার নারীরা এলাচ, কফি, কোকো, ভুট্টা আর মটরশুঁটি উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত। আর পুরুষদের শারীরিক শক্তি ব্যবহৃত হয় নারীদের নিয়ন্ত্রণ করার কাজে।”
পু সোটো বলেন, এখানে সাধারণত নারীরা পড়াশোনা করার অনুমতি পায় না। তারা সবসময় নিয়ন্ত্রিত, পুরুষ যা চায়, তাই মেনে চলতে হয়।
আরেক নারীর অভিযোগ, “পুরুষরা আমাদের সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করেছে। কিন্তু পরিস্থিতি বদলে যাচ্ছে। আমরা জানি, আমাদেরও অধিকার আছে। আমাদেরও সম্মান করতে হবে।”
গত চার দশকের বেশি সময় ধরে দারিদ্র্য নিরসন, গার্হস্থ্য সংহিংসতা কমিয়ে আনা, ধর্ষণ বন্ধসহ বহু অপরাধ দমনে ‘চিকিতিতা’ তহবিল ভূমিকা রেখে চলেছে। এমনকি আদিবাসীদের মধ্যে মদপান কমাতেও ওই টাকা কাজে এসেছে।
বিয়র্ন ওলভিউসের কাছে প্রশ্ন ছিল, যখন গানটি তিনি লিখেছিলেন, তখন কি তার কল্পনাতেও ছিল যে গানটি কখনও সামাজিক সমস্যা সামাধানের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করবে?
জবাবে তিনি বলেন, “ভেবেছিলাম গানটি হিট হবে, মানুষের ভালো লাগব।”
মুক্তির পর থেকে ৪৩ বছরে চিকিতিতার রয়্যালটি ব্যবহার করা হয়েছে মধ্য আমেরিকার জটিল কিছু সমস্যার সমাধানের চেষ্টায়। এর মধ্যে রয়েছে চরম দারিদ্র্য থেকে গার্হস্থ্য সহিংসতা এবং ধর্ষণ পর্যন্ত। এমা বা মার্তার মত বহু চিকিতিতার জীবন বদলে দিয়েছে ওই তহবিল।
কিন্তু ওলভিউসের দূরতম কল্পনাতেও ছিল না, গানটি দিয়ে এত বছর ধরে এত উপার্জন সম্ভব হবে এবং সেই টাকা এত ধরনের সামাজিক কাজে ব্যবহার হবে।
তার ভাষায়, একটি গানের কাছে একজন যা চাইতে পারে, প্রাপ্তিতে মিলেছে তার সর্বোচ্চটাই।