“নর্দমায় শুয়ে শুয়ে আমি ভাবছিলাম, ঈশ্বর আমাকে বাঁচালেন! এবার বুঝি সিনেমা থেকে তাহলে এখন আমাকে বাদ দেওয়া হবে।
Published : 22 Oct 2024, 01:58 PM
অস্কার জেতা এবং যুগ যুগ ধরে দর্শক প্রিয়তা ‘ধরে রাখা’ যে হলিউডি সিনেমা ‘দ্য গডফাদার’ করে অভিনেতা আল পাচিনোর অভিনয় যাত্রার বাঁক বদলে যায়, শুরুতে এই কাজটি নিয়ে দারুণ জেরবার হয়েছিলেন তিনি; এমনকি নির্মাতা যেন তাকে সিনেমা থেকে ছাটাই করে দেয়, এজন্য বহুবার ঈশ্বরকেও ডেকেছিলেন এই অভিনেতা।
একে তো নবীন অভিনেতা হওয়ার ‘দায়ে’ প্রযোজনা সংস্থা প্যারামাউন্ট পিকচার্সের রোষানল, তার ওপর অল্প বয়সের চিন্তাভাবনার ‘অপরিপক্কতা’ পাচিনোকে কাজটি থেকে কিছুটা ‘বিমুখ’ করেছিল বলে ভাষ্য তার।
এছাড়া সিনেমার পরিচালক ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলাও এক পর্যায়ে পাচিনোকে বলে বসেছিলেন যে, মাইকেল কর্লিওনির চরিত্রটি পাচিনো তেমন করে ‘ফুটিয়ে তুলতে পারছেন না’। তাই পাচিনো ভেবেছিলেন প্রযোজনা সংস্থার বেশি লোকসান হওয়ার আগেই যেমন করে হোক ‘দ্যা গডফাদার’কে বিদায় জানাতে হবে, তবে সেই ছারপত্র যেন আসে প্রযোজকদের কাছ থেকে।
তবে সে সবের কিছুই হয়নি। সব বদলে যায় সিনেমায় রেস্তোরাঁর একটি শুটিং দৃশ্য ঘিরে।
‘দ্য গডফাদার’ মুক্তির পর পাচিনো নিজেকে হলিউডে ‘অভিনেতা’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন বলে ভাষ্য কপোলার এবং সিনেমা সমালোচকদের।
১৯৭২ সালে মুক্তি পাওয়া 'দ্য গডফাদার’ সিনেমায় হলিউডি অভিনেতা আল পাচিনো।
'দ্য গডফাদারে' সুযোগ আসাটাই ‘অলৌকিক’ বলে আজও মনে করেন পাচিনো।
অভিনয়ের প্রস্তাব নিয়ে পাচিনোকে পরিচালক কপোলার প্রথম ফোন, নির্মাতার চাওয়া অনুযায়ী নিজেকে তুলে ধরার ব্যর্থতা এবং ফের নিজেকে যোগ্য প্রমাণের যাত্রার কিছু গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় অভিনেতা আল পাচিনো তুলে ধরেছেন তার 'সনি বয়' শীর্ষক বইতে।
আর বইটির আলোকে কিছু ঘটনা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে দ্য গার্ডিয়ান।
আলোর গতিতে বদলে গেছিল সব
আল পাচিনো মনে করেন ১৯৭২ সালে ইতালীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন ঔপন্যাসিক মরিয়ো পুজোর উপন্যাস অবলম্বনে ‘দ্য গডফাদার’ সিনেমা বানিয়ে পরিচালক ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলা তার জীবনকে ‘বদলে’ দিয়েছিলেন।
পাচিনোর ভাষ্য, “আমার জীবনে সিনেমাটি গভীর প্রভাব ফেলেছিল, বলা যায় আলোর গতিতে বদলে গেছিল সব।“
‘দ্য গডফাদার’ সিনেমার পরিচালক ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলা।
আল পাচিনো তখন নবীন অভিনেতা, খ্যাতির দিশা খুঁজছিলেন। অপরাধ জগতের কাহিনী নিয়ে নির্মাণ করা ওই সিনেমার গল্প পাচিনো তার বইয়ে বর্ণনা করেছেন এভাবে, “এক বিকেলে আমি একটি ফোন পেয়েছিলাম, রিসিভার কানে তুলতে অপর প্রান্ত থেকে যার কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম, তিনি তিনি হলেন ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলা।
“কালজয়ী সিনেমাটির করিগর কপোলা কথার শুরুতেই আমাকে জানিয়ে দেন তিনি ‘দ্য গডফাদার’ নামের একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে চলেছেন, আমাকে ওই সিনেমায় অভিনয় করতে হবে। আমার কি মনে হয়েছিল জানেন? ‘আমার সঙ্গে বুঝি উনি রসিকতা করছেন। কারণ আমি কে বলুন? আমাকে কেন কপোলা তার সিনেমায় অভিনয়ের প্রস্তাব দেবেন?”
পাচিনো বলেন, তার মারিয়ো পুজোর ‘দ্য গডফাদার পড়া ছিল। এবং উপন্যাসটি যুগ যুগ ধরে পাঠকরা কীভাবে ‘গোগ্রাসে গিলেছে’ সে সম্পর্কেও তার ধারণা ছিল।
“ আমি ভাবলাম নিঃসন্দেহে এই ধরনের কাজে যুক্ত হতে পারা অনেক বড় ঘটনা। আর একজন তরুণ অভিনেতার জন্য তো বটেই। কিন্তু এ ধরনের একটি অভাবনীয় সুযোগ পাওয়ার বিষয়টি আমার কাছে বিশ্বাস হচ্ছিল না। নিতান্তই অলৌকিক ঘটনা, কেমন বেতাল লাগছিল।
“তারপর মনে হল, এটা সম্ভবও হলেও হতে পারে। কারণ কিছুদিন আগে সান ফ্রান্সিসকোতে আমি কপোলার সঙ্গে কিছুটা সময় কাটিয়েছিলাম। সেসময় তাকে আমি লক্ষ্য করে বুঝেছিলাম যে তার নিজের ক্ষমতার প্রতি অগাধ বিশ্বাস আছে। কপোলার আরও ছিল নেতৃত্বদানের গুণ এবং ঝুঁকি নেওয়ার মানসিকতা। এ কারণে ওই সময়ে তার কথার ওপর আমার ভরসা জন্মে যায়।“
কপোলার প্রস্তাব পাচিনোর কাছে আরও অবিশ্বাস্য ঠেকেছিল ওই সময়ের হলিউডের পরিবেশের কারনেও।
“প্যারামাউন্ট’র মত স্টুডিও খ্যাতিমান প্রবীণ পরিচালকদের কাছে না গিয়ে, নতুন চিন্তাভাবনা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো তরুণ এক বুদ্ধিজীবী পরিচালকের শরণাপন্ন কেন হচ্ছে! এই ব্যাপারটির সঙ্গে হলিউড সম্পর্কে আমার চিরাচরিত ধারণা মিলছিল না।“
পরের ধাপের কথাবার্তায় কপোলার কাছ থেকে সিনেমার অন্যতম চরিত্র ‘মাইকেল কর্লিওয়নি’ করার প্রস্তাব আসে পাচিনোর কাছে।
মারিয়ো পুজো তার কলমের বয়ানে অপরাধজগতের যে কাহিনী তুলে ধরেছেন তার, মূল চরিত্র ইতালি থেকে আসা ভিটো কর্লিওনি। যিনি কর্লিওনি পরিবারের কর্তা। ভিটোর তিন ছেলে। ঠিক করাই ছিল যে ভিটোর পর বড় ছেলে সনিই হবেন পরিবারের পরবর্তী কর্তা, মেজ ছেলে ফ্রেডো কিছুটা দুর্বল চিত্তের মানুষ। ছোট ছেলে মাইকেল বাবার ব্যবসায় আগ্রহী নন, কলেজে পড়াশোনা করছে, এছাড়া ভিটোর একমাত্র কন্যা কনির বিয়ে হয়ে গেছে।
এই পরিবারটির শত্রুর শেষ নেই। একাধিক মাফিয়া পরিবার ভিটোদের দুনিয়া থেকে সপরিবারে নির্মূল চায়। জুয়া ও মাদক কারবার এবং আধিপত্য বিস্তার নিয়ে জটিলতায় ভিটোর বড় ছেলে খুন হয়, পরে ভিটোও গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। এরপর এই মাফিয়া পরিবারটির হাল ধরেন ছোট ছেলে মাইকেল কর্লিওনি। কাহিনী যত এগিয়ে যায়, দেখা যায় মাইকেল বাবার তুলনায় আরও নিষ্ঠুর, ঠাণ্ডা মাথার এবং সফল এক মাফিয়া নেতা।
মাইকেল কর্লিওনির প্রস্তাব পেয়ে পাচিনোর যা মনে হয়েছিল সে ব্যাপারে তিনি লিখেছেন, “আমার সঙ্গে সঙ্গে মনে হল, এই ভদ্রলোক এবার বোধহয় গল্পের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন। আবার এটাও মনে হল আমি কী আসলে কপোলার সঙ্গেই কথা বলছি?”
ওই সময়ের নিজের মানসিক পরিস্থিতির বর্ণনায় পাচিনো বলেন, “নার্ভাস ব্রেকডাউনের মত পরিস্থিতি আমার। আমি একজন পরিচালকের কাছ থেকে মাইকেল কর্লিওনির মত একটি চরিত্র পাচ্ছি, তাও আবার প্রস্তাব এসেছে ফোনে, কোনো এজেন্টের কাছ থেকে নয়, সরাসরি পরিচালকের কাছ থেকে!”
একেবারে ‘হতভম্ব’ হয়ে গিয়েছিলেন পাচিনো।
এই অভিনেতা বলেছেন, মাইকেল কর্লিয়ানির মত চরিত্র তার মত আনকোরা কেউ আসুক সেটি প্রযোজনা সংস্থা প্যারামাউন্ট পিকাচার্স চায়নি। প্রথমত তারা ইতালীয় কোনো অভিনেতার কথা ভাবছিলেন, যাতে উপন্যানের সুর ঠিক থাকে।
অভিনেতা জ্যাক নিকলসনকে বা রবার্ট রেডফোর্ডকে ভেবেছিল প্যারামাউন্ট। আবার ওয়ারেন বিটি বা রায়ান ও'নিলও প্যারামাউন্টের পছন্দে ছিল।
প্যারামাউন্ট ধর্তব্যেই নেয়নি আমাকে
‘গডফাদার’ কত বড় একটি কাজ হতে চলেছে সেটি নিয়ে কোনো ধারণা পাচিনোর ছিল না বলে ভাষ্য এই অভিনেতার। এই ‘নির্বুদ্ধিতার’ পেছনে অল্প বয়সের চিন্তাভাবনার সীমাবদ্ধতা মূল কারণ হিসেবে বর্ণনা করেন পাচিনো।
মারিয়ো পুজো তার উপন্যাসে ভিটোর তৃতীয় সন্তান মাইকেল কর্লিওনিকে তুলে ধরেছিরেন ছোটখাট আকৃতির মানুষ হিসেবে, যার মাথাভরা কালো চুল এবং সুর্দশন। এই বর্ণনার সঙ্গে প্যারামাউন্টের পছন্দের নায়কদের সাদৃশ ছিল না। আর উপন্যাসের বইয়ের নায়কের সঙ্গে মিল ছিল মূলত পাচিনোর।
“কিন্তু তাই বলে আমি খুব সহজেই কাজটা পেয়ে গেলাম তা না। আমাকে প্রথমে স্ক্রিন টেস্ট করতে বলা হয়, যা আমার জন্য নতুন অভিজ্ঞতা ছিল। এই কাজে আমাকে বিমানে করে ক্যালিফোর্নিয়ায় ডেকে পাঠানো হয়।
“আমার এই দুই কাজের কোনোটিই পছন্দ ছিল না। বিমান ভ্রমণে ভীতি ছিল ওই সময়। তাই ক্যালিফোর্নিয়ায় যেতে চাইনি।“
এরপর পাচিনোর ম্যানেজার মার্টি ব্রেগম্যান তাকে জোরজবস্তি করে ক্যালিফোর্নিয়ার প্লেনে তুলে দেন।
“তিনি আমার সঙ্গে এক পাইন্ট হুইস্কিও দিয়ে দেন, যাতে ভ্রমণ উপভোগ করতে পারি।“
কপোলা এর মধ্যে যেসব অভিনয়শিল্পীদের নির্বাচর করেছিলেন ‘দ্য গডফাদারের’ জন্য, প্যারামাউন্ট প্রথমই সেটি বাতিল করে দিয়েছিল বলে লিখেছেন পাচিনো। তাদের মধ্যে ওই সময়ে প্রতিষ্ঠিত অভিনেতা জিমি কান ও বব ডুলানও ছিলেন।
“এই সিনেমার জন্য প্রথমবার স্টুডিওতে ঢুকেই বুঝতে পারলাম, আমাকে প্যারামাউন্ট ধর্তব্যেই নিচ্ছে না আমাকে, আবার প্রতিষ্ঠিতদেরও তারা আমলে নিচ্ছেন তাও বলা যাবে না। আমার প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয় আমারই মত কয়েক তরুণের সঙ্গে। ওই অভিজ্ঞতা আজও পীড়া দেয়।“
স্ক্রিন টেস্টে যা হল
পাচিনো বলেছেন, স্ক্রিন টেস্ট করানোর আগে তার চুল কাটানোর হুকুম আসে নির্মাতার কাছ থেকে।
“কপোলা আমাকে একজন নাপিতের কাছে নিয়ে যান, কারণ তিনি দাঁড়িয়ে থেকে কাজটি করাতে চাইছিলেন। পরিচালক চাইছিলেন আমার চুলে চল্লিশের দশকের কাট থাকবে।
“আমরা ‘দ্য গডফাদার’ সিরনেমা বানাচ্ছি এ কথা শোনামাত্র নাপিত কিছুটা পিছনে সরে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে তিনি চুল কাটতে এলেন ঠিকই, তবে তার হাত কাঁপছিল। দুঃখের কথা হল পরে জানতে পারি তার হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল।“
চুল কাটার পরের কাজ হল স্ক্রিন টেস্টের জন্য ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানো। ওইদিন প্যারামাউন্টের কর্তব্যক্তিরা নিজেদের মধ্যে কোনো ব্যাপার নিয়ে দারণ ক্ষেপে ছিলেন।
ওই দিনের ঘটনা নিজের ভেতরে কেমন আলোড়ন তুলেছিল তার বর্ণনায় পাচিনো লিখেছেন,
“মনে মনে বলতে থাকলাম, আমি টেস্টে উৎরে যাব, আমার কাজ একটাই, চরিত্রের ভেতরে ঢুকে যেতে হবে।“
পরিচালক পাশে থাকলে আর কিছু লাগে না
পরিচালক কপোলার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে পাচিনো বলেছেন, তিনি যে নির্মাতার পছন্দের অভিনেতা ছিলেন, এই বিষয়টি তাকে সাহস যুগিয়েছে।
“একজন পরিচালক যখন কোনো অভিনেতার পাশে দাঁড়ান, তখন আর তেমন কিছু লাগে না।“
ওই স্ক্রিন টেস্টের ভিডিও কপোলা প্যারামাউন্ট কর্তৃপক্ষকে দেখিয়েছিলেন এবং পাচিনোর যোগ্যতা নিয়ে পরিচালকে নানা ধরনের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছিল বলে অভিনেতা তার বইতে লিখেছেন।
“আমি কাজ শুরু করেছিলাম অস্বস্তি নিয়ে। শুটিংয়ের সময় ফ্লোরে লোকজন এবং ক্রুদের মধ্যে সাবলীল ব্যবহার দেখিনি।“
পাচিনো বলেছেন, এক সময় গুজবও ছড়িয়ে পড়েছিল যে পাচিনো গডফাদার থেকে বাদ পড়ছেন।
“শুটিং শুরুর কয়েকদিন পর বুঝতে পারছিলাম, আমাকে দিয়ে কাজটা হচ্ছে না। যদিও কপোলা চাইছিলেন আমি চরিত্রটা করি। কাজ শুরুর দেড় সপ্তাহ পরে একদিন রাতে তিনি আমাকে রেস্তোরাঁয় ডেকে পাঠালেন, সেখানে তিনি তার পরিবারের সদস্যসহ আরো কয়েকজনের সঙ্গে রাতের খাবার খাচ্ছিলেন।
“তার টেবিলের সামনে পৌঁছানোর পর তিনি আমাকে তাদের সঙ্গে বসতে পর্যন্ত বললেন না। যেন আমি সাহায্যপ্রার্থী, আমি অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম, আমার সঙ্গে এমন ব্যবহারের কারণ কি! অবশেষে কপোলা বললেন, তোমার উপরে আমার কী রকম বিশ্বাস ছিল তুমি জানো, কিন্তু বাস্তবতা হল তোমাকে দিয়ে অভিনয় হচ্ছে না।“
যে পরিচালকের ভরসাতে মাইকেল কর্লিওনির মত চরিত্রে কাজ শুরু করেছিলেন পাচিনো, সেই নির্মাতার এমন কথায় অভিনেতা ঘামতে শুরু করেন।
কপোলার কাছে তখন জানতে চাই, “এখন আমাকে কী করতে বলেন?”
পরিচালক পরামর্শ দেন, যতখানি শ্যুট করা হয়েছে, সেগুলো যেন পাচিনো মন দিয়ে দিয়ে দেখেন।
“পরদিন স্ক্রিনিং রুমে ঢুকে পুরো ভিডিও দেখলাম। আমার নিজের কাজ সম্পর্কে আমার ধারণা হল, এসব কাজ দেখার কিছু নেই। এরপর আমার কী করা বা বলা উচিত বুঝে উঠতে পরিনি।“
প্রত্যেক অভিনয় শিল্পীরই কাজ নিয়ে পরিকল্পনা থাকে বলে ভাষ্য পাচিনোর।
“মাইকেল চরিত্র নিয়ে আমি ভেবেছিলাম, শুরুতে আমি মাইকেলকে কারোর নজরে আনতে চাইনি। চেয়েছিলাম মাইকেল হঠাৎ করে সবার মনে দাগ কাটবে।চরিত্রায়নের শক্তি এভাবেই আনতে চেয়েছিলাম। আমি ভেবেছিলাম, মাইকেলের উত্থান এমন হবে যে দর্শকের কাছে বিভ্রম বা ধাঁধা তৈরি করবে। আমার মনে হয় কপোলাও তাই ভেবেছিলেন। কিন্তু আমাদের শুরুর ব্যর্থতা ছিল, এই ব্যাপারটি একজন আরেকজনের কাছে ব্যাখ্যা করে উঠকে পারিনি।
পাচিনো লিখেছেন, কেবল তাকে যোগ্য প্রমাণে কপোলা ফ্রান্সিস রেস্তোরাঁয় গুলির দৃশ্যের শুটিং এগিয়ে আনেন। যাতে হলিউডের সন্দেহবাদীরা এই অভিনেতাকে সিনেমা থেকে বাদ দেওয়ার আর কোনো যুক্তি না পান।
দৃশ্যটি কেমন ছিল
যে দৃশ্য গডফাদারে পাচিনোর ভাগ্য নির্ধারণ করে দিয়েছিল সেটির বিশদ বর্ণনা অভিনেতা লিখেছেন তার বইয়ে।
“এপ্রিলের এক রাতে ওই দৃশ্যের শুটিং হয়। সেদিন একটা ছোট্ট রেস্তোরাঁয় ১৫ ঘণ্টা কাটিয়েছিলাম। দীর্ঘ সময় সঙ্গে ছিলেন লিটল আল লেত্তিয়েরি এবং স্টার্লিং হেইডেন। তারা দুজন সত্যিই সেদিন আমার সঙ্গে আন্তরিক ব্যবহার করেছিলেন।
“তারা বুঝতেন আমি ভালো সময়ের মধ্যে নেই। যে কোনো দিন আমাকে নিয়ে কোনো একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, বা আমিই সিদ্ধান্ত নেব, তারা জানতেন। আমার মনোবল শক্ত রাখতে পাশে ছিলেন এই অভিনেতারা।“
পাচিনোর ভাষ্য, “দৃশ্যটা এমন ছিল যে রেস্তোরাঁ বসে থাকা আমি কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে ওয়াশরুমে যাওয়ার কথা বলব। সেখানে গিয়ে একটু লুকানো পিস্তল বের করে আবার খাবারের জায়গায় ফিরে ওই লোকগুলোকে খুন করে সেখান থেকে বের হয়ে একটি চলন্ত গাড়িতে উঠে পালিয়ে যাব।“
ওই দৃশ্যের জন্য পাচিনোর কোনো ‘স্ট্যান্ড-ইন ছিল এবং স্টান্টম্যান’ রাখা হয়নি।
পাচিনো বলেন, “স্ক্রিপ্ট মত সব করা হল। রেস্তোরাঁ থেকে বের হয়ে আমি যেই চলন্ত গাড়িতে লাফ দিয়ে উঠতে গেলাম, গাড়িটি মিস করলাম। আমি প্রায় উড়ে গিয়ে ব্রঙ্কসের হোয়াইট প্লেইনস রোডের একটি নর্দমায় চিৎ হয়ে পড়ে গেলাম, কিন্তু উঠতে পারলাম না। কারণ আমার গোড়ালি মুচড়ে গিয়েছিল।
“শুটিং টিমের ক্রুরা দৌড়ে এসে আমাকে ওঠানোর চেষ্টা করছিলেন, আমাকে বারবার জিজ্ঞাসা করা হচ্ছিল আমি হাঁটতে চলতে বা দাঁড়াতে পারব কী না।“
এই দুর্ঘটনায় ‘স্বস্তি পেয়ে’ পাচিনো ভেবেছিলেন, পা যদি ভেঙেই গিয়ে থাকে তো তিনি বেঁচে গেলেন!
“নর্দমায় শুয়ে শুয়েই আমি ভাবছিলাম, ঈশ্বর আমাকে বাঁচালেন! এই সিনেমা থেকে তাহলে এখন আমাকে বাদ দেওয়া হবে।আমার মনের অবস্থা বুঝে আমি নিজেই বিস্মিত! ভাবছিলাম, প্রতিদিন যোগ্যতার প্রমাণ দেওয়া থেকে বাঁচলাম! নিজেকে ছোট ভাবা, অধীনস্তের মত অনুভব করার যন্ত্রণা, গ্লানি থেকে মুক্তি পেলাম। গোড়ালির আঘাত যদি গুরুতর হয়ে থাকে তাহলে এই বন্দিদশা থেকে আমার মুক্তি হতে পারে।“
পাচিনো মাইকেলের চরিত্র থেকে মুক্তি পেতে চাইলেও তেমনটা হয়নি।
“কপোলা এক স্টান্টম্যান যোগাড় করে চলন্ত গাড়িতে ওঠার দৃশ্য ধারণ করেন এবং আমি সেরে না ওঠা পর্যন্ত গোড়ালিতে কর্টিসোন ইনজেকশন চলল। তারপর টিমের সবাইকে জড়ো করে একদিন ধারণ করা রেস্তোরাঁর দৃশ্য দেখান হল।
“আমি হয়ত প্রত্যাশার চাইতে ভালো কাজ করেছিলাম, কপোলাসহ সবাই বলল সিনেমাটি আমার করা উচিত। আমিও আর ছাঁটাই হলাম না, এর পর অভিনয় চালিয়ে গেলাম।“
পাচিনোর ভাষ্য শেষ পর্যন্ত পরিচালক তার ওপরে ভরসা রেখেছেন।