শিল্পকলায় অবদানের জন্য এবছর একুশে পদক পেয়েছেন চিত্রশিল্পী কনকচাঁপা চাকমা। এছাড়াও বেশ কিছু আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন এ শিল্পী। পাহাড়ি এই শিল্পী তার অঞ্চলের মানুষের শিল্প, সংস্কৃতি, যাপিত জীবনকে ফুটিয়ে তোলেন তুলির আঁচড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা থেকে ১৯৮৬ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেইনিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পড়েন। ২০১৪ সালে ঢাকায় বেঙ্গল আর্ট লাউঞ্জে তার ৮০টি শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হয়।
Published : 22 Feb 2023, 04:39 PM
একুশে পদক-২০২৩ পেলেন, কেমন লাগছে?
খুবই ভালো লাগছে। কারণ আমি শিল্পকর্মের জন্য দেশ-বিদেশে অনেক সম্মাননা পেয়েছি। এই প্রথম আমার দেশ আমাকে সম্মানিত করেছে, পুরস্কৃত করেছে, এজন্য বেশি আনন্দিত। দেশের সংস্কৃতিকে আমি বাইরে নিয়ে যাচ্ছি; বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের সংস্কৃতিকে। একই দেশে বসবাস করেও সমতলভূমির সংস্কৃতির সঙ্গে পাহাড়ি সংস্কৃতির সাদৃশ্য ও বৈপরীত্য খুবই সুন্দরভাবে তুলে ধরেছি। সেটা দেশে এবং বিদেশে সংঘাতিকভাবে পরিচিতি পেয়েছে। এই লম্বা জার্নির জন্যই একুশে পদক দেওয়া হয়েছে। আমি দেশের প্রতি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ ও আনন্দিত।
আপনি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে উঠে এসেছেন। পাহাড়ি এলাকা থেকে জাতীয় ও আন্তর্জতিক অঙ্গনে পৌঁছতে কী কী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়েছে?
আমি যেখান থেকে উঠে এসেছে ওখান থেকে উঠে আসাটাই বড় চ্যালেঞ্জ। ছোটবেলা থেকেই আমি ছবি আঁকতাম। স্কুলে থাকতে অনেক সম্মাননা পেয়েছি। কিন্তু ঢাকায় এসে যে শিক্ষাটা গ্রহণ করব, তার সঙ্গে আমি মানিয়ে নিতে পারব কি না, সেটা ছিল অনেক বড় চ্যালেঞ্জ; কিন্তু আমি দারুণভাবে বিষয়টা গ্রহণ করেছি। মন দিয়ে লেখাপড়া করেছি। আমার সিনিয়ররা, শিক্ষকরা স্নেহ দিয়েছেন। তাদের যত্ন ও অনুপ্রেরণায় দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এ জায়গায় আসতে পেরেছি।
চিত্রশিল্পে বিচরণের পেছনে নির্দিষ্ট কোনো ভাবনা কিংবা অনুপ্রেরণা কাজ করেছে?
চিত্রশিল্পে কাজের পেছনে বড় অনুপ্রেরণা ছিলেন আমার মা। তিনি জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত ডিজাইনার ছিলেন। ছোট থেকে আমি দেখেছি মাকে কাপড় বুনতে। নকশা তুলতে। জিনগতভাবে আঁকার বিষয়টা আমি পেয়েছি। তবে আমি মায়ের মতো বুননশিল্পী না হয়ে ক্যানভাসটাকে বেছে নিয়েছি। মা ছাড়াও আদিবাসীদের বর্ণিল সংস্কৃতি আমাকে উৎসাহিত করেছে ছবি আঁকতে।
অন্য শিল্পীদের থেকে আপনার ছবির ভিন্নতা কোথায়?
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, পাহাড়, ঝর্না ও বর্ণিল সংস্কৃতি আমার ছবির প্রধান বিষয়। আমার ক্যানভাসে ভিন্নধারা প্রবাহিত হয়েছে। মানুষও এটাকে সমাদরে গ্রহণ করেছে। এই জায়গাটাই অন্য শিল্পীদের থেকে আমার কাজ আলাদা বলে মনে হয়।
কোন ভাবনা থেকে আপনার নিজস্ব সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করা?
ছোট থেকেই ভাবনা ছিল নিজস্ব সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করব। কারণ, আমি দেখেছি আমাদের চারুকলা থেকেও সমতলের শিল্পীরা অ্যাবস্ট্রাক্ট নিয়ে কাজ করছে, সমতলের বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করছে। তখন মনে হয়েছে যেহেতু আমি আলাদা একটা অঞ্চল থেকে এসেছি, আমার চলন বলন গড়নে আলাদা একটা বৈশিষ্ট্য আছে; আমার ছবি আঁকার ধরনটাও আলাদা করে গড়ে নেব। যাতে আমার কাজও অন্যদের সাথে মিশে না যায়। সেই সঙ্গে আমার অঞ্চলটা যেন দেশ-বিদেশের দর্শকদের সঙ্গে পরিচিত করে দিতে পারি।
আপনার শিল্পকর্মের কোন বৈশিষ্ট্যগুলো দেশ-বিদেশে বেশি সমাদৃত হয়েছে?
আজ থেকে ৪০ বছর আগের কথা যদি ভাবেন, তখন কিন্তু আদিবাসিদের এত ফোকাসে আনা হয়নি। দেশের মানুষ তাদের সম্বন্ধে এতকিছু জানত না। আমার ছবির মাধ্যমে এই বিষয়গুলো উঠে এসেছে। আদিবাসীদের জীবন-যাত্রা, সংস্কৃতি, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না যা ফুটে উঠেছে সেগুলোই দেশের মানুষকে বেশি ছুঁয়েছে। দেশের মানুষ আদিবাসীদের সম্পর্কে ধারণা পেয়েছে, তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়েছে। দেশের বাইরেও এই বিষয়গুলো দেখেই সবাই মুগ্ধ হয়েছে।
প্রদর্শনী নিয়ে আপনার সাম্প্রতিক কোনো ভাবনা আছে কি?
এই বছরে একক চিত্র প্রদর্শনীর কোনো ভাবনা নেই। আমি একটা প্রদর্শনী করতে চার-পাঁচ বছরের মতো সময় নেই। এরজন্য অনেক কাজ করতে হয়। গবেষণা ও হোমওয়ার্ক করতে হয়। যে অঞ্চল নিয়ে কাজ করতে চাই সে অঞ্চলে যেতে হয়। ফলে একক প্রদর্শনীর পরিকল্পনা আপাতত নেই। তবে যৌথ প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করতে পারি।
পাহাড়ি শিল্পীদের উন্নয়নে কী ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন?
পাহাড়ি শিল্পীদের অনেক বেশি সাপোর্ট দরকার। আমি সাধ্যমতো চেষ্টা করছি। গত চার-পাঁচ বছরে যারা পাশ করেছে তাদের নিয়ে একটা গ্রুপ করেছি। তাদের নিয়ে বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায় যাচ্ছি। পাহাড়ি শিল্পীদের নিয়ে প্রদর্শনী করা, তাদের ছবি বিক্রিতে সাপোর্ট দেওয়া এগুলো আমি শুরু করেছি। সামগ্রিকভাবে এই কাজগুলো করতে পারলে তাদের প্রতিভা বিকশিত করার সুযোগ পাবে; এবং তাদের কাজগুলোও সুন্দর হবে।
একজন মানুষের শিল্পী হয়ে উঠতে কোন বিষয়টা অপরিহার্য বলে আপনার মনে হয়?
সবচেয়ে বেশি দরকার নিজের শক্তিটা। নিজের প্রতিভা, মনন, ইচ্ছা... এগুলো জাগ্রত করতে হবে। কারও ভেতর যদি ইচ্ছাশক্তি না থাকে আপনি কাউকেই শিল্পী বানাতে পারবেন না। সেটা গানে বলুন, নাটকে বলুন, সিনেমা বা ছবি আঁকাতে বলুন। ওই ইচ্ছাটাকে লালন করতে হবে, প্রতিফলন ঘটাতে হবে। এরসঙ্গে লাগে একটু পেট্রোনাইজেশন আর সাপোর্ট। তবে ইচ্ছাশক্তিটাই প্রধান।
জীবন নিয়ে আপনার ভাবনা কী?
যতদিন বাঁচব ছবি আঁকব। আর নতুন প্রজন্ম নিয়ে ভাবব। সেটা আমার আদিবাসী বা পাহাড়ি প্রজন্ম হোক কিংবা সমতলের। নতুন প্রজন্মকে নিয়ে অনেক কিছু করার আছে। তাদের সঙ্গে নিয়ে সুন্দর কিছু কাজ করে যেতে হবে। তাদের কাজের পরিবেশ তৈরি করে দিয়ে যেতে পারি। নতুন প্রজন্ম একটু সাপোর্ট পেলে দেশের ভাবমূর্তি বিশ্বের সামনে উজ্জ্বল করতে পারবে।
এই পর্যায়ে এসে জীবন ও ক্যারিয়ার নিয়ে কোনো অপ্রাপ্তি আছে কি?
না। আমার মনে হয়, জীবনে যতটা প্রাপ্য ছিল তার চেয়ে অনেক বেশি পেয়েছি। সবচেয়ে বড় কথা হলো, আমি মানুষের অনুপ্রেরণা ও ভালোবাসা পেয়েছি। এখন তো একুশে পদক পেলাম; তার পাহাড় বলেন বা সমতল বলেন- সব জায়গার মানুষ আমাকে সাহস জুগিয়েছেন, ভালোবাসা দিয়েছেন, যার কারণে আমার পথ চলতে কোনো অসুবিধা হয়নি। আমি এখনও কাজ করতে চাই, এখনও শিখতে চাই এবং ছবি আঁকতে চাই।