কবির উপন্যাস নিয়ে হয়েছে সিনেমা; কিন্তু তাতে দর্শক না হওয়ায় ঝরছে হতাশা।
Published : 12 Dec 2022, 08:48 PM
নির্মলেন্দু গুণের উপন্যাস থেকে নির্মিত হয়েছে ‘দেশান্তর’; ঢাকায় থেকেও যারা সিনেমাটি দেখেননি, তাদের উপর থেকে ‘ভালোবাসা প্রত্যাহার’ করেছেন এই কবি।
‘জরুরী বিজ্ঞপ্তি প্রসঙ্গ দেশান্তর’ শিরোনামে সোমবার ফেইসবুকে এক পোস্টে এই ঘোষণা দেন স্বাধীনতা পুরস্কার ও একুশে পদকজয়ী নির্মলেন্দু গুণ।
ভারত ভাগের পটভূমি নিয়ে গুণের উপন্যাস অবলম্বনে ‘দেশান্তর’ সিনেমাটি পরিচালনা করেছেন আশুতোষ সুজন। গত ১১ নভেম্বর দেশের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় সিনেমাটি; কবির উপন্যাসের নামেই।
নির্মলেন্দু গুণ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দেশান্তর সিনেমাটি আমাকে কাঁদিয়েছে। এই সিনেমাটি আমার পরিচিত বন্ধুজনরা দেখবেন বলেই আশা করছিলাম। ঢাকার সাহিত্যের অনেকেও সিনেমাটি দেখেননি।”
সিনেমাটি মুক্তির পর থেকেই একের পর এক ফেইসবুক পোস্ট লিখে নিজের আবেগ প্রকাশ করে যাচ্ছেন নির্মলেন্দু গুণ।
এই কবি ফেইসবুকে লিখেছেন, “যাঁরা আমার ব্যক্তিগত বন্ধু, যাঁদের সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। ঢাকায় থাকার পরও তাঁদের মধ্যে যাঁরা আমার প্রিয় উপন্যাস দেশান্তর অবলম্বনে নির্মিত ‘দেশান্তর’ ছবিটি দেখেননি, বা দেখা থেকে সজ্ঞানে বিরত থেকেছেন, আমি তাদের ওপর থেকে আমার ৫০% বন্ধুতা ও ভালোবাসা প্রত্যাহার করে নিয়েছি।
“ঢাকার চারটি হলে তিন সপ্তাহ ধরে চলার পরও যাঁরা ‘দেশান্তর’ দেখার সময় করে উঠতে পারেননি, বা দেখার যোগ্য বলে মনে করেননি, আমার ফেসবুকের বন্ধু তালিকা থেকে আমি তাঁদের স্বেচ্ছায় সরে দাঁড়ানোর জন্য সবিনয় অনুরোধ করছি। আমি আশা করছি, আপনারা সততার সঙ্গে এই কাজটা সম্পন্ন করবেন।”
নির্মাতা আশুতোষ সুজন জানিয়েছেন, আগামী ১৬ ডিসেম্বর থেকে নির্মলেন্দু গুণের পৈত্রিক এলাকা ময়মনসিংহের ছায়াবানী হলে ‘দেশান্তর’ দেখা যাবে।
নির্মলেন্দু গুণের কবিতা নিয়ে ফের সিনেমা
স্বাধীনতা-একুশে পদক ‘বেচে দেবেন’ নির্মলেন্দু গুণ, সময় এক মাস
দেশান্তর উপন্যাস লেখার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে নির্মলেন্দু গুণ গত ২১ নভেম্বর ফেইসবুকে লিখেছিলেন, “সম্ভবত ১৯৮২ সালে, ময়মনসিংহে থাকাকালে আমি ‘দেশান্তর’ উপন্যাসটি লিখেছিলাম। সাপ্তাহিক সচিত্র সন্ধানী পত্রিকার ঈদ সংখ্যায় দেশান্তর ‘কবির লেখা প্রথম উপন্যাস’ হিসেবে ছাপা হয়। ঐ উপন্যাস পাঠকমহলে কিছুটা নাড়াও দিয়েছিলো তখন।
“তারপরের বছরেই বই আকারে দেশান্তর প্রকাশ করে মুক্তধারা। ঐ বইটির প্রচ্ছদ আঁকার জন্য আমি বেশ ক’জন শিল্পীর দ্বারস্থ হয়েছিলাম। দুরন্ত চপলা কিশোরী মনসার ছবিটি কোনো শিল্পীই আঁকতে পারেননি। শেষে হাশেম খানের একটি এবস্ট্রাক্ট ছবি প্রচ্ছদে দিয়েই দেশান্তর প্রকাশিত হয়।”
হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন, মইনুল আহসান সাবের ও আনিসুল হকের ‘উপন্যাস-ঝড়ের তাণ্ডবে’ কবির উপন্যাস তখন আড়ালে পড়ে গিয়েছিল বলে নির্মলেন্দু গুণের ভাষ্য।
তিনি লিখেছেন, “এই উপন্যাস পরে কখনও আলোচনায় আসবে, আমি ভাবিনি। কিশোর উপন্যাস ‘কালো মেঘের ভেলা’র পর এটিই ছিলো আমার দ্বিতীয় উপন্যাস। বড়দের জন্য লেখা একমাত্র উপন্যাস। পাঠক আমার প্রিয় উপন্যাসটিকে গ্রহণ না করার কারণে আমি উপন্যাস রচনা থেকে নিজেকে সরিয়ে নিই। মনে মনে বলি, যা বাবা, এখন নাকে তেল দিয়া ঘুমা। আমার সেই ঘুম এখনও চলছে।”
৪০ বছর পর সিনেমার পর্দায় উপন্যাসের চরিত্রদের দেখে লুকিয়ে লুকিয়ে কেঁদেছেন জানিয়ে নির্মলেন্দু গুণ বলেন, “ঐ বই লিখে, বা বই আকারে প্রকাশিত হওয়ার পর পাঠ করে আমি কষ্ট পেয়েছি। কিন্তু আমার কখনও কান্না আসেনি। কিন্তু রচনার চল্লিশ বছর পর সিনেমার পর্দায় আশুতোষ সুজন পরিচালিত দেশান্তর ছবিটি দেখে আমি লুকিয়ে লুকিয়ে কেঁদেছি। আমার বুক বারবার ভারী হয়ে এসেছে। চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছে জলে।
“তবে তো চলচ্চিত্রকে উপন্যাসের চেয়ে অধিকতর শক্তিশালী শিল্পমাধ্যম হিসেবেই মানতে হয়। আমার বাবার কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের ‘দেবতার গ্রাস’ কবিতার আবৃত্তি শুনে উত্তাল সমুদ্রে নিক্ষেপিত রাখালের জন্য আমি প্রকাশ্যে কেঁদেছিলাম। তখন আমার বয়স ৭-৮ হবে। ‘আমার ছেলেবেলা’ বইতে তার বিশদ বর্ণনা আছে।”
৭৮ বছরে পদার্পণ করে নিজের লেখা উপন্যাসনির্ভর চলচ্চিত্র দেখে অপ্রকাশ্যে এই কান্নার চেয়ে আনন্দের কান্না আর হয় না বলেও মন্তব্য করেন নির্মলেন্দু গুণ।
এছাড়া ২২ নভেম্বর ফেইসবুকে নির্মলেন্দু গুণ লিখেছিলেন, “বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসেই শুধু নয়, আমি বিশ্বাস করি বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসেই ‘দেশান্তর’ এক অনন্য সৃষ্টি হিসেবে বিবেচিত হবে। যদি ছবিটিকে বহির্বিশ্বে, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শন করাটা সম্ভব হয়। কেননা, প্রেক্ষাপট ও ভাষা ভিন্ন হলেও মানবজাতির ইতিহাসই হচ্ছে দেশান্তরের ইতিহাস। আমি যে আমার জীবদ্দশায় দেশান্তর দেখে যেতে পারলাম, এ আমার জীবনের এক পরম পাওয়া।”
সরকারি অনুদানে নির্মিত দেশান্তর সিনেমায় অভিনয় করেছেন মামুনুর রশীদ, শুভাশিস ভৌমিক, মৌসুমী, আহমেদ রুবেল, মোমেনা চৌধুরী, ইয়াশ রোহান, টাপুরসহ অনেকে।