জ্বালানি তেল বেচে মুনাফার হিসাবে গরমিল দেখা দেওয়ায় এখন সিএজি কার্যালয়ের মাধ্যমে নিরীক্ষার সুপারিশ এসেছে।
Published : 10 Aug 2022, 10:18 PM
রাষ্ট্র মালিকানাধীন বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন-বিপিসি ছয় বছরে যে মুনাফার অঙ্ক দেখিয়েছে, তার সঙ্গে বড় ধরনের ফারাক দেখা যাচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে।
অর্থ বিভাগের বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০২২ অনুযায়ী, ২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত বিপিসি প্রকৃত মুনাফা করেছে ৪৬ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা।
কিন্তু বুধবার বিপিসির চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ এক সংবাদ সম্মেলনে এই সাত বছরে ৪২ হাজার ৯৯২ কোটি টাকা মুনাফার তথ্য দেন।
ফলে সরকারের অর্থ বিভাগ যে হিসাব দিচ্ছে, তার সঙ্গে বিপিসির হিসাবে ফারাক থাকছে ৩ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা।
জ্বালানি তেলের নজিরবিহীন মূল্যবৃদ্ধির মধ্যে ছয় বছরে বিপিসির বিপুল মুনাফা নিয়ে আলোচনার মধ্যেই এই গরমিলের হিসাব এল।
সঙ্কটের মধ্যে সম্প্রতি জ্বালানি তেলের দাম এক ধাপে ৪২-৫১ শতাংশ বাড়ানোর পর অনেকে বলছিলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোর ব্যাপক মুনাফার কারণে এখন দাম এতটা না বাড়ালেও চলত।
এখন ডিজেলে লোকসান ৬ টাকা, অকটেনে লাভ ২৫ টাকা: বিপিসি
অর্থ বিভাগের হিসাবের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় কোনো সংস্থা বা কোম্পানির প্রকৃত মুনাফার হিসাবে এত গরমিল সচরাচর দেখা যায় না।
অর্থনৈতিক সমীক্ষার হিসাবের সঙ্গে গরমিলের বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন করা হয় বিপিসির চেয়ারম্যানকে।
উত্তরে তিনি বলেন, “আজকে আমি ডাউনলোড (অর্থনৈতিক সমীক্ষা) করেছি। সেখানে আপনার দেওয়া এই তথ্য নাই। আপনার কাছে (সাংবাদিক) যদি থাকে, আমাকে দেখাবেন। আমি পরে অবশ্যই আপনাকে ক্লারিফাই করব।”
“আমার এখানে নাই, আপনার তথ্যটাকে জাস্টিফাই করার মতো এই মুহূর্তে….আপনার বেসিসটা দিলে আমি হয়ত এটা নিয়ে কথা বলতে পারব,” সামনে থাকা নানা কাগজপত্র হাতড়াতে হাতড়াতে বলছিলেন তিনি।
এই ধরনের গরমিলের কোনো সুযোগ নেই মন্তব্য করে অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের (সিএজি) মাধ্যমে নিরীক্ষার সুপারিশ রেখেছেন।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কে ঠিক, তা নির্ণয় করার জন্য বিষয়টি সিএজির মাধ্যমে অডিট হওয়া উচিৎ। কোন কারণে পার্থক্য হচ্ছে বা কোনো কারণ আছে কি না, তা বের করা উচিৎ।”
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান মনসুর বলেন, “সরকারের উচিৎ হবে সব কিছু জনসম্মূখে তুলে ধরা। কারণ এগুলো জনগণের টাকা। অডিটের মাধ্যমে যেটা বেরিয়ে আসবে সেটাই গ্রহণ করতে হবে।”
সরকারি আয়-ব্যয়ে স্বচ্ছতা বাড়ানোর উপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের সরকারি খাতের বাৎসরিক আয় ব্যয়ে স্বচ্ছতা বলতে কিছু নেই। আমরা বার বার বলে আসছি যে ফিসক্যাল ট্রান্সপারেন্সি দরকার।
“স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠান- দুপক্ষ থেকেই অনিচ্ছা রয়েছে। এরফলে সবকিছুই অস্বচ্ছ। এই কারণেই এই সমস্যাগুলো হয়।”
বাংলাদেশে পেট্রোলিয়াম পণ্য আমদানি, মজুদ, বিপণন, বিতরণ সংক্রান্ত সব কাজ তত্ত্বাবধান, সমন্বয় ও নিয়ন্ত্রণ হয় বিপিসির মাধ্যমে, যা বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা।
বিপিসির লাভের গুড় খাচ্ছে ইউক্রেইন যুদ্ধ
ভর্তুকির কারণে বছরের পর বছর লোকসান গোনা সংস্থাটি সাম্প্রতিক অর্থবছরগুলোতে লাভের মুখ দেখতে থাকে। বিশেষ করে কোভিড মহামারীর শুরুতে জ্বালানি তেলের দাম তলানিতে ঠেকলে বিপিসির লাভও হু হু করে বাড়ে।
কিন্তু চলতি বছরের শুরুতে ইউক্রেইন যুদ্ধ শুরু হলে বিপিসির আকাশচুম্বী মুনাফার হিসাব জট পাকাতে শুরু করে।
গত ডিসেম্বরে বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত তেল প্রতি ব্যারেল যেখানে ৬৫ ডলার ছিল, তা বাড়তে বাড়তে ১২০ ডলারও ছাড়িয়ে যায়। এখন তা কমে ১০০ ডলারের নিচে নামলেও তেল আমদানিতে সরকারের ব্যয় আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে।
ফলে ভর্তুকির চাপ এড়াতে জ্বালানি তেলের মধ্যে ডিজেলের দাম ৪২ শতাংশ এবং পেট্রোল-অকটেনের দাম ৫১ শতাংশ বাড়ানো হয়। চলমান পরিস্থিতিতে এছাড়া বিকল্প ছিল না বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে।
ডিজেল ও কেরোসিনের দাম এক ধাক্কায় ৪২.৫%; অকটেন ও পেট্রোলে ৫১% বাড়ল